|
|
|
|
খসড়া দলিল |
আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আপত্তি কারাটের, ‘বিতর্ক’ সিপিএমে |
প্রসূন আচার্য • কলকাতা |
পাহাড়ে সংগঠন ধরে রাখতে পাহাড়বাসীর জাতিসত্তা তথা আত্মপরিচয়কে মেনে নিয়েই সম্প্রতি দলিল পেশ করেছে সিপিএমের দার্জিলিং জেলা কমিটি। পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর অন্ধ্রপ্রদেশ সিপিএমে প্রশ্ন উঠেছে, আত্মপরিচয়ের আন্দোলন থেকে দূরে থাকলে শেষ পর্যন্ত তেলেঙ্গানায় দল থাকবে তো? বিষয়টি নিয়ে পার্টির মধ্যে বিতর্ক তুঙ্গে। কারণ, সিপিআই এবং মাওবাদীরা পৃথক তেলেঙ্গানাকে সমর্থন করছে।
পিছড়েবর্গ ও দলিতদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে অস্বীকার করায় হিন্দি-বলয় থেকে সিপিএম কার্যত যে মুছে গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের নেতারা তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন। তা সত্ত্বেও পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক খসড়া দলিলে ভারতের জাতভিত্তিক সমাজকে কার্যত ‘অস্বীকার’ করে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধেই লড়াইয়ের ডাক দিচ্ছে সিপিএম। আগামী দিনে দলের নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট মঙ্গলবার বলেছেন, “আমাদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ওই রাজনীতি কখনও প্রগতিশীল হতে পারে না।” তাঁর মতে, জাত বা জাতিসত্তার পরিচয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে শ্রেণি-আন্দোলনকে সামনে রেখেই দলকে এগোতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের যে সব আন্দোলন হচ্ছে, তার পিছনে রয়েছে বিদেশি শক্তি, বুর্জোয়া শক্তি এবং বিদেশি টাকায় চলা কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (এনজিও)। বিধাননগরে সিপিএমের এক সভায় কারাট ওই মন্তব্য করেন।
কারাটের মন্তব্য নিয়ে দলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে তা রাজনৈতিক খসড়া দলিল প্রকাশিত না-হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ্যে আপত্তি করতে চাইছেন না কোনও নেতা। কিন্তু ঘনিষ্ঠমহলে তাঁরা বলছেন, কারাট ভারতের বাস্তবতা অস্বীকার করতে চাইছেন। এতে দল আরও পিছিয়ে পড়বে।
দার্জিলিং জেলা কমিটি পাহাড়বাসীর জাতিসত্তা তথা আত্মপরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে যে দলিল পেশ করেছে, তিনি তো তার বিপরীতে হাঁটছেন! জবাবে কারাট বলেন, “এমন কোনও দলিল পেশ হয়েছে বলে আমি জানি না। হয়ে থাকলে পার্টি কংগ্রেসে তা এলে দেখা যাবে।” কারাটের মতে, “পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে পরাস্ত করতেই জাতিসত্তার আত্মপরিচয়কে তুলে ধরে পাহাড়ে আন্দোলন হয়েছে। তা হলে কী ভাবে তা সমর্থন করা সম্ভব?” ওই আন্দোলন সমর্থনযোগ্য নয়, তা বোঝাতে গিয়ে কারাট একদা কমিউনিস্ট-শাসিত যুগোস্লাভিয়া সাত টুকরো হয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে বলেন, “আত্মপরিচয়ের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিলে দেশ ক্রমেই বিভক্ত হবে। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। বরং জাতিসত্তা ক্রমেই খন্ডিত হয়।” এ ব্যাপারে রাজ্য কমিটির সদস্য তথা দার্জিলিং জেলার নেতা অশোক ভট্টাচার্যকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কারাটের বক্তব্য দলীয় মুখপত্রে দেখেছি। মনে হচ্ছে, উনিও আমাদের কথাই বলতে চেয়েছেন। তবে আমরা যে দলিল তৈরি করেছি, তা অন্য জেলাতেও প্রশংসিত হয়েছে। আত্মপরিচয়ের আন্দোলনের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক উপাদান আছে, তা গ্রহণ করেই আমাদের জাতিসত্তার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে।”
দার্জিলিং জেলা কমিটির দলিলে বলা হয়েছে, ‘দার্জিলিং জেলায় গোর্খাদের অবস্থান একটি বিশেষ ভৌগোলিক এলাকায়। তাদের আছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য। তাদের কতগুলি বিশেষ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিকাঠামোগত সমস্যা আছে। আছে পরিচিতিসত্তার প্রশ্নও। উন্নয়নের পরিকল্পনায় বা তার বাস্তবায়নে নিজেদের নিবিড় ভাবে যুক্ত করার দাবি ন্যায়সঙ্গত দাবি। তাই তাদের স্বশাসনের দাবি অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক’। অশোকবাবুর নেতৃত্বাধীন দার্জিলিং জেলা কমিটি আরও বলেছে, ‘এই দাবিকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে আবেগ বা ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা আমাদের অবজ্ঞা করার কোনও প্রশ্নই নেই।’
দলের একাংশ অবশ্য বলছে, কারাট অনেক সময়েই সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে এমন দলিল বা প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দিলেও পরে তা ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেন। যেমন ২০০৫-এ দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে (যে বার কারাট প্রথম সাধারণ সম্পাদক হন) বিমান বসুর নেতৃত্বে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন সম্পর্কে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, গত সাত বছরে তা নিয়ে কারাট কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। অথচ, হিন্দি-বলয়ে দলের গণভিত্তি বাড়াতেই ওই প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে বিমানবাবু ঘনিষ্ঠ-মহলে একাধিক বার ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। এ বারও আত্মপরিচয় সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাব বা পার্টি কংগ্রেসে এলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দলেই সন্দেহ রয়েছে। |
|
|
|
|
|