অতি ফলনের ধাক্কায় হিমঘরে এখনও মজুত থাকা পুরনো আলু বিক্রির রাস্তা প্রায় বন্ধ। অবস্থা এতটাই খারাপ যে ৫০ কেজির আলুর বস্তার জন্য মোটে ৩৫ টাকা করে ‘ক্ষতিপূরণ’ দাবি করছেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া চাষিরা।
গত বেশ কিছু দিন ধরেই ফসলের অভাবী বিক্রি এবং চাষির আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। এখন ভাড়ার টাকা তুলতে হিমঘর তাঁদের আলুর বস্তা বিক্রি করেছে বলে অভিযোগ করে চাষিরা এই যে সামান্য ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন, তাতেও তাঁদের সঙ্কটের গভীরতা স্পষ্ট। সোম ও মঙ্গলবার বর্ধমানের কালনায় দু’টি হিমঘরে পরপর চাষিদের বিক্ষোভের জেরে এই চিত্র সামনে এসেছে।
এ দিনই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “শুনেছি, চাষিরা না কি আলু বিক্রি করতে পারছেন না। হিমঘরগুলিতে এখনও আলু আছে। জেলাশাসকদের বলেছি, ভাল ও উন্নত মানের আলু শনাক্ত করতে। সেই সব আলু ইন্দোনেশিয়া ও অন্য দেশে রফতানি করা হবে।” যদিও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওই সব আলু যেখানে দেশের বাজারেই বিক্রির অবস্থায় নেই, তা কী করে অন্য দেশে রফতানি করা যাবে তা পরিষ্কার নয়। পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সম্পাদক লালু মুখোপাধ্যায় বলেন, “জানুয়ারি মাসে হিমঘরে থাকা আলু আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না। তাই তার বাজারও নেই।”
মঙ্গলবার কালনা শহরের কাছে রানিবন্ধ এলাকায় একটি হিমঘরের সামনে বেশ কিছু আলুচাষি বিক্ষোভ দেখান। তাতে সামিল প্রকাশ মোদক, হরনাম মোদকদের অভিযোগ, “হিমঘরে অনেকেরই দু’শো, পাঁচশো, হাজার বস্তা আছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, হিমঘর কাউকে কিছু না জানিয়ে এই আলুর বেশির ভাগটাই বিক্রি করে দিয়েছে।” হিমঘর থেকে পুরনো আলু বের করে নেওয়ার সময়সীমা ছিল গত বছর ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। পরে সরকার দুই দফায় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়। তার পরেও বর্ধমান, হুগলি, দুই মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া মিলিয়ে প্রায় ২৫ লক্ষ বস্তা আলু জমে রয়েছে। ইতিমধ্যে খেত থেকে নতুন আলু উঠতে শুরু করেছে। ফলে পুরনো মজুত বের করে নতুন আলু রাখার প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া হিমঘরগুলির উপায় নেই।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গত বোরো ও আমন মরসুমে ধানের অতিফলনও। বহু চাষিই এক চাষের আয়ের টাকায় পরের চাষের বীজ, সার, কীটনাশক কেনেন। হুগলি-বর্ধমানের অনেক চাষিই আলু ও ধান, দুই-ই চাষ করেন। পরপর তিনটি চাষে অতিফলন এবং ফসলের দাম না পাওয়ায় তাঁরা কার্যত খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে অন্য রাজ্য থেকে আলু ও ধান বাজারে ঢোকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
এ দিন রানিবন্ধের হিমঘরে গিয়ে চাষিরা দাবি করেন, হয় তাঁদের রাখা আলু ফেরত দিতে হবে অথবা বস্তা পিছু ৩৫ টাকা (চাষের খরচ অন্তত দশ গুণ) ‘ক্ষতিপূরণ’ দিতে হবে। সোমবার ওই এলাকারই গুপ্তিপুরে এক হিমঘরে গিয়ে ‘চাপ’ দিয়ে কিছু চাষি এই মর্মে ‘চুক্তিপত্র’ও লিখিয়ে নেন বলে অভিযোগ। রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁরা আলু বের করেননি, খরচ তুলতে তাঁদের রাখা আলুই হিমঘর বিক্রি করেছে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে হিমঘরের কাছে আলু বা টাকা চাওয়ার অধিকার কারও নেই। তবে তার আগে কোনও হিমঘর আলু বিক্রি করেছে বলে নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে তদন্ত হবে।” কিন্তু চাষির সঙ্কট কাটবে কী করে? বর্ধমান জেলা কৃষি উপ-অধিকর্তা শ্যামল দত্তের মতে, “কৃষি দফতর নিজের কাজ করেছে। তাই ফলন বেড়েছে। সরকারের এখন বেসরকারি উদ্যোগপতিদের সঙ্গে নিয়ে রাজ্যের বাইরে বিপণন শুরু করা জরুরি।” জেলা কৃষক সভার সম্পাদক আব্দুল রজ্জাক মণ্ডল বলেন, “অন্য জায়গায় বিপণনের সরকারি ব্যবস্থা না থাকলে এই বিপর্যয় হতে বাধ্য।” মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আগের সরকার তো এই বিষয়ে কিছু ভাবেইনি। আমি ভেবেছি।” |