সরকারকে ‘স্বৈরতন্ত্রী’ বললেন মনোজ, কংগ্রেসেও শুরু দ্বন্দ্ব
হাকরণে দাঁড়িয়ে এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে ‘স্বৈরতন্ত্রে’র অভিযোগ তুললেন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য মনোজ চক্রবর্তী। মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে রাজ্যের পরিষদীয় এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সদ্য-অপসারিত মনোজবাবু সাফ জানান, তিনি আর এই সরকারে থাকতে চান না। তাঁর কথায়, “মানসিক ভাবে এই মন্ত্রিসভায় থাকতে চাই না, চাই না, চাই না! আমার পদত্যাগ পত্র (চিঠিটি তুলে ধরে) লেখা আছে। শুধু তারিখ বসানো নেই। দলের অনুমতি নিয়ে তারিখ বসিয়ে দেব।”
মনোজবাবুর অভিযোগ, “এই সরকারে স্বৈরতন্ত্র চলছে।” তাঁর বক্তব্য, “কাজের মূল্যায়নের (পারফরম্যান্স) কথা যদি ওঠে, তা হলে তো মুখ্যমন্ত্রীর কাজের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন করছে। আমি নয়। মানুষ।” আর তিনি নিজে? ‘২০০ শতাংশ সফল’!
দফতর ছাঁটায় সোমবারেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি বাদানুবাদে জড়িয়েছিলেন মনোজবাবু। এ দিন মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিতে অনুমতি চেয়ে তিনি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছেন। যার প্রতিলিপি পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাহুল গাঁধী, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, এআইসিসি নেতা শাকিল আহমেদ এবং দলের সাংসদ অধীর চৌধুরীকে। এ দিন মহাকরণ ছাড়ার সময় মনোজবাবু বলে গিয়েছেন, “হাইকম্যান্ডের স্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া আর এখানে মন্ত্রী হিসেবে আসব না। কোনওমতেই আর মন্ত্রিসভায় থাকব না। সর্বস্তরে ইতিমধ্যেই ইস্তফার অনুমতি চেয়েছি। বলেছি, আমার বদলে অন্য কাউকে মন্ত্রিসভায় পাঠানো হোক। মহাকরণ বা ময়ূখ ভবনে আর যাব না। হাইকম্যান্ডের অনুমতি পেলেই সরকারি গাড়িও ছেড়ে দেব।”
মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি কেন পদত্যাগপত্র পাঠাননি? মনোজবাবু জবাব, “হাইকম্যান্ডের অনুমতি পেলেই পাঠিয়ে দেব।”
আর অনুমতি না-পেলে? মনোজবাবুর উত্তর, “হাইকম্যান্ড হুইপ জারি করলেও অনুরোধ করব। হাইকম্যান্ডের অনুমতি নিতে না-হলে তো পিওনের হাত দিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ইস্তফা পাঠিয়ে দিতাম। প্রণববাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁকে বলেছি, আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। প্রণববাবু বলেছেন, তিনি দেখছেন।” (দিল্লি সূত্রে খবর, মনোজবাবু ইস্তফা দিয়ে দিন, এমনটাই চাইছে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে মরিয়া কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। তাদের বক্তব্য, এতে প্রতিবাদটাও থাকবে, আবার সঙ্কটও এড়ানো যাবে।) অধীরবাবু তাঁকে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলেও মনোজবাবু জানান।
মহাকরণে মনোজ চক্রবর্তী।
মনোজবাবুর ‘বিস্ফোরণ’কে কার্যত ‘উপেক্ষা’ই করেছে তৃণমূল শিবির। প্রশ্নের জবাবে মহাকরণে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “পাগলে কী না বলে! ছাগলে কী না খায়!” আর সদ্য-মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কথায়, “রাস্তায় অনেকে অনেক কিছু বলে। অনেক সময় পাগলেও চিৎকার করে। সব কিছুর জবাব দিতে হয় নাকি!” প্রশ্ন ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে খোদ মহাকরণে এক মন্ত্রীর এমন মন্তব্য কতটা শোভন? অরূপ বলেন, “সভ্যতা-ভব্যতার অভাব যে আছে, এটা হয়তো আপনারাও মানবেন। এমন কথায় শিক্ষার অভাব ফুটে ওঠে। ভাল ভাবে পড়াশোনা করলে কেউ হয়তো এমন বলতেন না।”
ক্ষুব্ধ মনোজবাবু সাংবাদিক সম্মেলনে কখনও হাতের আস্তিন গুটিয়েছেন। কখনও টেবিল চাপড়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করার পাশাপাশিই তাঁর দল কংগ্রেসের নেতা তথা মন্ত্রিসভার সদস্য মানস ভুঁইয়ার বিরুদ্ধেও ‘দ্বিচারিতা’র অভিযোগ এনেছেন। যার ফলে আবার কংগ্রেসের অন্দরের দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়েছে। চাপানউতোর শুরু হয়েছে প্রদীপ ভট্টাচার্য ও মানসবাবুর গোষ্ঠীর মধ্যে। মন্ত্রিসভার রদবদল এবং কংগ্রেসের দুই মন্ত্রীর দফতর কাটছাঁট করার বিষয়টি মানসবাবুকে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু প্রদীপ-ঘনিষ্ঠ নেতাদের অভিযোগ, মানসবাবু তা ‘সময়মতো’ দলকে জানাননি। মানসবাবু আবার জানিয়েছেন, তিনি প্রদীপবাবু থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা তথা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং এআইসিসি নেতা শাকিল আহমেদকে জানিয়েছিলেন। প্রদীপবাবু কোনও মন্তব্য করতে না-চাইলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, “সব হয়ে যাওয়ার পর মানসবাবু দিল্লিকে জানিয়েছিলেন।”
মানসবাবু বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে এআইসিসি-র এক নেতা জানান, মানসবাবু ‘সময়মতোই’ বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তৃণমূলের দুই নতুন মন্ত্রীকে সরকারে স্থান দিতে তিনি যে কিছু দফতরে রদবদল করবেন, তা-ও মানসবাবুকে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার বিকালেই তা দিল্লিকে জানান মানসবাবু। সোমবার রাতে রদবদল নিয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তি হাতে পেয়ে মানসবাবু দেখেন, আবু হেনার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের সঙ্গে উদ্যান দফতরটিও ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। মানসবাবু বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান। মানস-শিবিরের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, ওটা ‘ছাপার ভুল’। হেনার হাতে উদ্যান আছে। মানসবাবু তা-ও দিল্লিকে জানান। হেনাও অবশ্য এ দিন মানসবাবুর ভূমিকায় ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “মানস কে? উনিও পূর্ণমন্ত্রী। আমিও পূর্ণমন্ত্রী। আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন মুখ্যমন্ত্রী। এটা ঠিক যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ইচ্ছেমতো মন্ত্রীদের দফতর বদল করতে পারেন। তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু এটা সৌজন্যের প্রশ্ন।” হেনা জানান, সোমবার বিকেল ৪টে পর্যন্ত তিনি মহাকরণে ছিলেন। তার পর যান খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মেলার উদ্বোধনে। সেখানে সংবাদ মাধ্যমের কাছে দফতর বদলের খবর পান। কংগ্রেসের এই মন্ত্রীর বক্তব্য, “মানস নয়, রদবদল নিয়ে দলের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন ছিল।”
একই অভিমত প্রদীপবাবুরও। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের দফতর বদল করতেই পারেন। কিন্তু জোট রাজনীতিতে শরিক নেতৃত্বকে না-জানিয়ে সেটা করাকে আমি সঠিক বলে মনে করি না। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল।’’ প্রদীপবাবুর বক্তব্যকে কার্যত ‘সমর্থন’ করেন শাকিল। আজ, বুধবার মনোজবাবুর সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা প্রদীপবাবুর।
মানসবাবু নিজে কোনও মন্তব্য না-করলেও মুখ খুলেছে তাঁর শিবির। প্রদেশ কংগ্রেসের এক পদাধিকারীর কথায়, “প্রদীপদা অর্থহীন কথা বলছেন। যে মুখ্যমন্ত্রী প্রদেশ সভাপতির চিঠির উত্তর দেন না, তাঁর ফোন ধরেন না, যে রাজ্য নেতৃত্ব দিল্লির ধমকে ধান-পাটের আন্দোলন গুটিয়ে নেয়, সেই কংগ্রেসের মন্ত্রীদের বিষয়ে প্রদীপবাবুদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আলোচনা করবেন ভাবাটাই বাড়াবাড়ি!”
মানসবাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে অনুযোগ করেছেন, এমন যে হতে পারে, তা তিনি আগেই বলেছিলেন। বিধানসভা ভোটে তিনি যখন ৯৮টি আসনের দাবিতে ‘অনড়’ ছিলেন, তখন প্রদেশ নেতাদের অনেকেই তাঁকে ‘জোট-বিরোধী’ বলেছিলেন। তখন তাঁর কথা মেনে নিলে ৭০টি আসনে জিতত কংগ্রেস। এই অবস্থা হত না! প্রদেশ কংগ্রেসের এক সাধারণ সম্পাদকের দাবি, জোট সরকার গঠনের সময় মানসবাবু তৃণমূলের সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা বলেছিলেন। ওই নেতার কথায়, “মানসবাবু লিখিত ভাবে দলীয় নেতৃত্বকে বলেছিলেন, তিনি মন্ত্রিত্বে যাবেন না। সভাপতি হিসেবে সংগঠনের কাজ করবেন। তার পরেও তাঁকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। এখন প্রদেশ নেতৃত্ব নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ওঁকে দোষ দিচ্ছেন।”
মনোজবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘উনি (মানসবাবু) মন্ত্রী-টন্ত্রী থাকতে ভালবাসেন। পদে থাকতেও ভালবাসেন।” তিনি আরও বলেন, “সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ মানসবাবু আমায় ফোন করে বলেন, তখন তাঁর ঘরে অনেক লোক। আমি যেন একটু পরে যাই। মুখ্যমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রিসভায় ছোট্ট রদবদল করেছেন। মানসবাবুকে বলেছিলাম, আমার সঙ্গে কথা না-বলে উনি সম্মতি দিলেন কী করে? এটা উনি ঠিক করেননি।”
সরকার সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীকে আমার প্রশ্ন, অনবরত দফতর বদলালে সরকারের কাজ হবে কী করে? প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাই লক্ষ্য হলে সরকার কাজ করবে কখন?” আর নিজের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “সাত মাস মন্ত্রী হয়েছি। প্রথমে পরিষদীয় দফতর। প্রতিবাদ করার পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্প দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়ে সারা রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছি। দফতরকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছি। মুর্শিদাবাদে কোনও শিল্প নেই। এই দফতরে এসে মুর্শিদাবাদের উন্নয়নে কাজ শুরু করেছিলাম।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.