পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের এক মন্ত্রীর দফতর বদলকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্কের যতই অবনতি হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখনই কোনও সংঘাতের পথে যেতে রাজি নন সনিয়া গাঁধী। ২৩ জানুয়ারি কলকাতা সফরের সময় সনিয়ার নির্দেশে এই বার্তা নিয়েই মমতার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন মনমোহন সিংহ সরকারের মন্ত্রী জয়রাম রমেশ।
সনিয়ার মতে, দফতর বদলের এক্তিয়ার সম্পূর্ণ ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর। কিন্তু ঘটনা হল, শরিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বাস্তবে সেটা সব সময় খাটে না। এই অবস্থায় কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়া মনোজ চক্রবর্তী বরং ইস্তফা দিন। তা হলে এক দিকে যেমন তাঁর প্রতিবাদ নথিভুক্ত করা হবে, তেমনই আবার তৃণমূলের সঙ্গে টানাপোড়েনও কেটে যাবে। তবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল আজ বলেন, “পরিবারে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। সংসার চালাতে গেলে একটু-আধটু ঠোকাঠুকি হয়। কিন্তু আমরা জোট রাখতে চাই।”
কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, মমতার সঙ্গে কোনও ধরনের সংঘাতের পথে যেতে গেলে অনেকগুলি প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব মাথায় রাখা দরকার। মমতা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ নেতা। কংগ্রেস যদি এখনই সংঘাতের পথে যায়, তা হলে কি মমতার পতন হবে? উত্তর হল ‘না’। পশ্চিমবঙ্গে কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল করবে? তারও উত্তর ‘না’। মমতার সঙ্গে সংঘাতে গেলে কি কংগ্রেস তাঁর বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে? জবাব সেই ‘না-ই’। তা হলে সংঘাতের পথে হেঁটে লাভ কী?
তা ছাড়া, কেন্দ্রে মমতার বিকল্প হিসেবে মুলায়ম সিংহ যাদবকে ভাবা হচ্ছে। কিন্তু তারও বাস্তব ভিত্তি রয়েছে কি? উত্তরপ্রদেশে ভোটের পর মুলায়ম ইউপিএতে এসে যাচ্ছেন, এই প্রচারের বিরোধিতা ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাঁদের মতে, উত্তরপ্রদেশে ভোটের ফল কী হবে, কেউ জানে না। আর মুলায়ম তো এখনও সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করছেন। ফলে তিনি এলেও মমতাকে বাদ দিতে হবে, এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ নেই। |
পাশাপাশি, সিপিএমের সঙ্গে নতুন করে সমঝোতার পথে হাঁটতেও নারাজ কংগ্রেস। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদের কথায়, “কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আর সিপিএম-কে সঙ্গে নিয়ে চলার পক্ষপাতী নয়। এক বার প্রকাশ কারাটদের নিয়ে হাত পুড়িয়েছি আমরা। আর তার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে রাজি নই।”
অর্থাৎ, রাজ্য স্তরে তৃণমূলের সঙ্গে তিক্ততা যতই বাড়ুক, জাতীয় স্তরে তার আঁচ যাতে না পড়ে, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে কংগ্রেস। এ ব্যাপারে সনিয়ার নির্দেশ, রাজ্য কংগ্রেস নিজের অধিকার বজায় রাখবে। সংগঠনও মজবুত করতে হবে। কিন্তু এমন কিছু করা চলবে না, যাতে বাড়াবাড়ি রকমের সংঘাতের আবহ তৈরি হয়।
কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে মমতা আজকের মমতা হয়েছেন। রাজ্যে কংগ্রেসে সেই মুখ কোথায়? সেখানে এখনও অনেক শূন্যস্থান রয়েছে। সেই শূন্যস্থান কাকে দিয়ে পূরণ হবে? রাজ্য রাজনীতির থেকেও কেন্দ্রে প্রণববাবুর গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনেক বেশি। প্রদীপ ভট্টাচার্য, মানস ভুইয়াঁ, অধীর চৌধুরি, দীপা দাশমুন্সি কিংবা নতুন প্রজন্মের মৌসম নুরের মতো নেতারা আছেন। যদি নতুন প্রজন্মের কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবা হয়, তা হলে তার জন্য অনেকটা সময় দিতে হবে।
মমতার সঙ্গে জোট অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে জেলায় জেলায় কৃষি আন্দোলনের কর্মসূচি থেকেও প্রদেশ কংগ্রেসকে পিছিয়ে আসতে বলেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সনিয়ার কাছ থেকে এই বার্তা পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এআইসিসি নেতা শাকিল আহমেদ তা প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যকে তা জানিয়েও দিয়েছেন।
রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে মাত্র আট মাস। সিপিএম মনে করছে, মমতার কাছে সাধারণ মানুষের যে গগনচুম্বী প্রত্যাশা রয়েছে, এই সময়কালে তাতে চিড় ধরেছে মাত্র। কিন্তু তাঁর প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে, এমন নয়। কংগ্রেস নেতৃত্বও একই অভিমত পোষণ করেন। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অম্বিকা সোনির বক্তব্য, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মমতা দীর্ঘ লড়াই করে রাজ্যে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। সেই কৃতিত্ব তাঁকে দিতেই হবে। আর তাঁর শাসনের মাত্র আট মাসে কী এমন ঘটে গেল যে, রে রে করে এখনই রাস্তায় নেমে পড়তে হবে!
আর কেন্দ্রে সরকার চালাতে গিয়ে মমতাকে নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের বক্তব্য, তৃণমূল নেত্রীকে নিয়ে চলতে গেলে কিছু বাধা আসতেই পারে। তিস্তা চুক্তি, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি, লোকায়ুক্ত, পেনশন বিলের মতো একের পর এক বিষয়ে মমতা যখন বিরোধিতা করেছেন, তখন শত চেষ্টা করেও তাঁকে বোঝানো যায়নি। কংগ্রেস নেতারা জানেন, মমতার যে ভাবে দর কষাকষি করেন, তাতে তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু এর ইতিবাচক দিকটাও মাথায় রাখতে হবে।
অম্বিকা সোনির কথায়, “মমতা মমতাই। তাঁর কাজ করার একটি নিজস্ব শৈলী রয়েছে। ফলে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে হলে তাঁর শৈলী বুঝেই এগোতে হবে।” অনেক কংগ্রেস নেতাই বলছেন, জোট রাজনীতিতে সেটাই দস্তুর। মমতা ব্যতিক্রম নন। জয়ললিতা থেকে মায়াবতী সকলের ক্ষেত্রেই এই কথাটা খাটে।
কপিল সিব্বল, জয়রাম রমেশের মতো নেতাদেরও বক্তব্য, মমতা সৎ রাজনীতিক। তাঁর মতো নেত্রী গোটা দেশে বিরল। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ও দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমেই সিপিএমের সুদীর্ঘ জমানার অবসান হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তিনি সরকার চালাচ্ছেন মাত্র আট মাস। শরিকদের মধ্যে মতপার্থক্য হতেই পারে। রাজনীতিতে অনেক সময় কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রাখার বিষয়েই ঐকমত্য হয়। তাই বলে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়, যেখানে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাত চরমে পৌঁছয়। আর সিপিএম শেষ হাসিটা হাসে। |