এ বার হরিপালে আত্মঘাতী চাষি, শুরু চাপানউতোর
লিজে নেওয়া দশ কাঠা জমিতে চাষ করা ধান এখনও বিকোয়নি। দশ কাঠা জমির আলু এখনও মাঠে। নিজের পাঁচ কাঠা জমির অর্ধেকটায় চাষ করা পালং সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। বাকি আড়াই কাঠায় যে বেগুন ফলেছে, এলাকার ‘ফড়ে’রা তার দাম দিচ্ছে ‘নামমাত্র’। এর উপরে ছিল ‘দেনার দায়’। মঙ্গলবার ভোরে হুগলি জেলার হরিপালের চাষি গণেশ দুর্লভ (৪৫) কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার পিছনে এ সব সমীকরণই কাজ করেছে বলেই পরিবারের দাবি। তাঁদের সংযোজন, বছর কয়েক আগে ‘ফসলের দাম না পাওয়া’তেই গণেশবাবুর দাদাও আত্মঘাতী হয়েছিলেন।
গত কয়েক দিনে রাজ্যে যে কৃষিজীবীরা আত্মঘাতী হয়েছেন (বিরোধীদের হিসেবে গণেশবাবুকে নিয়ে সংখ্যাটা ২২), তাঁদের কেউই ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে মানতে চায়নি রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো এ-ও দাবি করেছেন, আত্মঘাতীদের তালিকায় কেউ কেউ কৃষিজীবীই নন। চন্দননগরের মহকুমাশাসক অভিজিৎ মিত্র এ দিন বলেন, “ফসলের দাম না পেয়ে গণেশ দুর্লভ আত্মঘাতী হয়েছেন, এমন তথ্য পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্টে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পিছনে অন্য কারণ থাকতে পারে। আমরা সব দিক খতিয়ে দেখছি।” যদিও গণেশবাবুর স্ত্রী আশাদেবীর বক্তব্য, “একে তো দেনায় ডুবে ছিলেন। তার উপরে এ বারেও ফসলের দাম না পেয়ে আমার স্বামী এই পথ বেছে নিলেন।”
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রের দাবি, কখনও অতিফলন, কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য পর পর কয়েক বার চাষে লাভের মুখ দেখতে পাননি গণেশবাবু এবং বন্দিপুর পঞ্চায়েতের উত্তর ভ্যাটরা (এখানেই থাকতেন গণেশ) গ্রামের বহু কৃষিজীবী। সকলেই প্রায় প্রান্তিক চাষি। ধার করে চাষ করেছেন। গণেশও করেছিলেন। তাঁর পরিবারের দাবি, সমবায় সমিতি, মহাজন, সারের দোকান সব মিলিয়ে ধারের পরিমাণ বেশ কয়েক হাজার টাকা। তার উপরে গত পাঁচ বছরের মধ্যে দুই মেয়ে, এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। দেনার দায়ে কার্যত গলা অবধি ডুবে ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যটি। সংসারের এমনই হাল, শেষকৃত্যের জন্যও গণেশবাবুর পরিবারকে দু’হাজার টাকা ধার করতে হয়েছে মহাজনের থেকে।
ওই কৃষিজীবীর মৃত্যুকে ঘিরে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ‘দোষারোপের’ পালা শুরু হয়েছে। হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক তথা সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের অন্যতম নেতা বেচারাম মান্না বলেন, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু না বলেও পারছি না, ওই পঞ্চায়েত এলাকার গ্রামগুলির প্রায় সব মানুষেরই আর্থিক হাল খুব খারাপ। পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি সবই সিপিএমের হাতে। ৩৪ বছর ধরে ওরা মানুষকে এই পরিস্থিতির মুখে এনে ফেলেছে।” যা শুনে সিপিএমের কৃষক সভার হুগলি জেলা সম্পাদক তথা প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসু বলেন, “আর কত দিন ওঁরা আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে খালাস পাবেন? চোলাই খেয়ে মারা গেলে সরকার ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কিন্তু রাজ্যে একের পরে এক চাষি ফসলের দাম না পেয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন!”
হরিপালে মৃত গণেশের পরিবার।
বিপিএল তালিকায় নাম ছিল গণেশবাবুদের। কিন্তু সে বাবদ সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিছুই মেলেনি বলে জানালেন আশা। এক টুকরো টালির চালের ঘরে ঠেসাঠেসি করে থাকেন কয়েকজন। গত বর্ষায় একটি ঘর ভেঙে গিয়েছে। ইন্দিরা আবাসের টাকা মেলেনি। গণেশবাবুর বৃদ্ধা মা শিশুদেবী বার্ধক্যভাতা, বিধবা ভাতা কিছুই পাননি। আশাদেবী জানালেন, বউমাকে রেখে তাঁর ছেলে কাজের খোঁজে গিয়েছেন বেঙ্গালুরু। কিন্তু এখনও টাকা-পয়সা কিছুই পাঠাতে পারেনি। আশাদেবীর কথায়, “প্রতি বারই চাষ হলে ভাবতেন, এ বার বোধ হয় দাম পাবেন। ধার-দেনা শোধ হবে। কিন্তু প্রতি বারই লোকসান। দিন দিন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিলেন মানুষটা। সারা দিন দুশ্চিন্তা করতেন।” কেন সরকারি ভাতা থেকে বঞ্চিত দুর্লভ পরিবার? স্থানীয় পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান এবং উত্তর ভ্যাটরারই বাসিন্দা কাঞ্চন দুর্লভ এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি। তিনি শুধু বলেন, “শখ করে তো কেউ বিষ খায় না। গ্রামে অনেক দুঃস্থ আছেন, এটা ঘটনা।”
আশাদেবী জানিয়েছেন, এ দিন ভোরে বেগুন খেতে দেবেন বলে কীটনাশকের শিশি নিয়ে বেরিয়েছিলেন গণেশবাবু। যখন ঘরে ফেরেন, তখনই তাঁকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল। হরিপাল গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। ফসলের দাম না পেয়ে
গণেশবাবুর দাদা মৃত্যুনও বছর কয়েক আগে আত্মঘাতী হয়েছিলেন জানিয়ে তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা বলেন, “গ্রামের সব লোকেরই তো এই অবস্থা। কারও ঘরেই ভাল মতো হাঁড়ি চড়ে না। এখানে ঘরে ঘরে যা অবস্থা, যে কোনও দিন এমন ঘটনা ফের ঘটবে।”

ছবি: প্রকাশ পাল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.