প্রবন্ধ...
পরিবর্তনেরও বয়স হবে
প্রসঙ্গটি চমৎকার এনেছিলেন রামচন্দ্র গুহ। সবে এই রাজ্যের মসনদে ঐতিহাসিক ‘পালাবদল’ ঘটেছে। গোটা দেশের চোখ থেকে তখনও মুগ্ধতা কাটেনি। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ‘অচলায়তন’ ভেঙে প্রবাহিত হচ্ছে আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার হাওয়া। একটি ইংরেজি দৈনিকে লেখা এক প্রবন্ধে এই প্রবীণ ইতিহাসবিদ অতীতের তিনটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। একটি জাতীয় স্তরের, একটি রাজ্যের এবং একটি বিদেশের।
রামচন্দ্র বলেছিলেন, ১৯৭৭-এ কেন্দ্রে জনতা পার্টি, ১৯৮৩-তে অন্ধ্রপ্রদেশে নন্দমুরি তারক রামরাও এবং পোল্যান্ডে লেচ ওয়ালেসা-র জয়লাভের মধ্যে একটা সাযুজ্য আছে। এঁরা সবাই নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন বটে, কিন্তু এই জয়ের প্রত্যাশা দু’-এক বছর আগেও তাঁদের ছিল না। এর মধ্যে আবার প্রথম ও তৃতীয় ক্ষেত্রে দু’-এক বছর আগেও ভাবা যায়নি যে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে। জনতা পার্টি, তেলুগু দেশম বা সলিডারিটি বিরোধী পক্ষে থাকাকালীন যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল ক্ষমতালাভের পরে তা অচিরেই বিলীন হয়ে যায়। পাশাপাশি এই ইতিহাসবিদ এই সতর্কবাণীও দিয়েছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস যদি এই দিক থেকে তাদের সমকক্ষ হতে চান তা হলে অচিরেই আরও এক বার বিরোধী অবস্থানে নিজেদের আবিষ্কার করবেন!
তবে, রামচন্দ্র গুহ এ কথাও জানাতে ভোলেননি যে, জরুরি অবস্থার পরে ’৭৭ সালে জনতা পার্টির জয়ের মতোই মমতা ও তাঁর দলের জয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ থেকেই সম্ভব হয়েছে। এন টি রাম রাওয়ের মতো এটাও সংগঠনের ক্ষমতার বিপরীতে একক ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তির ইতিবাচক পরিণতি। লেচ ওয়ালেসা ও সলিডারিটি-র সঙ্গে এখানেও মিল যে, এই জয়ও মানুষের নামে কথা বলা কমিউনিস্টদের মানুষের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতার বাস্তব সত্যকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
মাত্রই আট মাস! নবজাতক সরকার হয়তো এখনও ভাল করে হাঁটতেও শেখেনি। তার মধ্যেই নানা ক্ষেত্রে নানা ‘বিশৃঙ্খলা’র সমালোচনা ইতিউতি শোনা যাচ্ছে।
৩৪ বছরের শাসনকে নির্মম প্রত্যাখ্যানের উৎসব এখনও শেষ হয়নি। আকাশচুম্বী প্রত্যাশার ফানুস এখনও হাওয়ায় উড়ছে। তার মধ্যে ‘নৈরাজ্য’র অভিযোগ বেসুরো শোনায় বইকী! কিন্তু, ইতিহাসই তো শেখায় বাস্তবকে কাটাছেঁড়া করতে, নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে, পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণকে আরও শক্তিশালী করতে!
বাঙালি জীবনে দীর্ঘ কালের অভ্যস্ত বামফ্রন্ট সরকারকে ২০১১-র যে ১৩ মে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিল, সেই দিনটিকে প্রতীক করে নানা ক্ষেত্রের মানুষ নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন বামফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতা, কংগ্রেস-তৃণমূল জোট সরকারের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা। নতুন বাংলা গড়ার নতুন পথের সন্ধানও করেছেন কেউ কেউ। রাজ্য-তথা জাতীয় রাজনীতি তোলপাড় করা সেই কাল-কে ধরার চেষ্টা করেছে মধুময় পাল সম্পাদিত ‘পালাবদল ’১১ প্রত্যাশা ও প্রশ্ন’ গ্রন্থটি (গাঙচিল)।
ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে গ্রন্থটি নানা প্রশ্ন তোলে, পথও দেখায়। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ রাজ্যের নানা প্রান্তের নানা সমস্যা, অনালোকিত নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন রাজনীতিক, প্রাক্তন আমলা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে অনেকেই। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায়ের কথাই ধরা যাক। বিচ্ছিন্নতার উৎস কোথায় লুকিয়ে থাকে, শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের কাছে আপাত-ছোট ঘটনা প্রান্তিক মানুষের কাছে কত বড় হয়ে দাঁড়ায়, দেখানোর চেষ্টা করেছেন দেবপ্রসাদ। বলেছেন, ‘তিস্তা-গঙ্গা’ উৎসবে যদি কেবল কলকাতার আর উত্তরবঙ্গের কিছু শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেন, মেচেনি, সখিয়ালা, সত্যপিরের মতো লোকসংস্কৃতি স্থান না পায়, তবে সে উদ্যোগ কিছু মানুষের বিনোদনের উপকরণ হতে পারে, সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে পারে না। আদিবাসী অধ্যুষিত চা-বাগানে দুর্গাপুজোর ছুটি থাকবে, দীপাবলির ছুটি থাকবে আর আদিবাসীদের সব থেকে বড় পরব ‘করম’ উৎসবে ছুটি থাকবে না, আদিবাসী সমাজ তা হলে কী করে নিজেদের মূলস্রোতের অংশীদার বলে মনে করবে?’
বাম জমানায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক কারখানা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী। বন্ধ কারখানার জমিতে গড়ে উঠেছে আবাসন। কর্মহীন মানুষগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছেন! পালাবদলের পরে কী হবে? বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছে ‘নাগরিক মঞ্চ’। মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বিকল্প পথেরও সন্ধান দিয়েছেন। নব লিখছেন, ‘কংগ্রেস ও তৃণমূল জোটের শাসনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্প্রতি এই বন্ধ ও রুগ্ণ শিল্প খোলা ও পুনরুজ্জীবন সংক্রান্ত বিষয়ে সদর্থক ঘোষণা করেছেন যে, বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার জমি শিল্পের কাজেই ব্যবহার হবে। কোনও ভাবেই অন্য কিছু, অর্থাৎ আবাসন বা শপিং মল জাতীয় কিছু করতে দেওয়া হবে না। এটা খুবই সঠিক পদক্ষেপ যদি সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হয়।’ আর একটি প্রস্তাবে তিনি বলছেন, বন্ধ বা রুগ্ণ কারখানায় অস্তিত্বহীন ট্রেড ইউনিয়নের অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের বাদ দিয়ে সরাসরি শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলে সরকার তাদের মতামত গ্রহণ করুক। সরাসরি শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের জন্য সরকার সক্রিয় হোক।
জঙ্গলমহল নিয়ে পালাবদলের আগে ও পরে চর্চা নিরন্তর। নির্বাচনের ঠিক পরেই শাল-শিমূলের আনাচ-কানাচ ঘুরে বেড়িয়েছেন গৌরীশংকর সরকার। তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ শোনায়, ৩৪ বছরের বাম শাসন কী ভাবে জঙ্গলমহলের প্রাণস্পন্দন স্তব্ধ করে দিয়েছিল। একটু সাহস দেখিয়ে ঝান্ডা উঁচিয়ে যাঁরা তৃণমূলের মিছিলে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ আচমকা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। ‘হার্মাদ’ শিবিরের বাসিন্দাদের জন্য রান্না, ঘর সাফ করতে, জামাকাপড় কেচে দিতে হয়েছে। কেশপুর, গড়বেতা, শালবনি, গোয়ালতোড়, লালগড় প্রভৃতি গ্রামের মানুষের নানা কাহিনি প্রশ্ন জাগায়, এই ‘পরিবর্তন’ সত্যিই হবে তো?
নির্বাচনী ইস্তেহারে তৃণমূল ঘোষণা করেছিল, ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে রিভিউ কমিটি গড়বে। কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে। ভিন্ন এক প্রস্তাব দিয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী, ‘যে তালিকাই দেওয়া হোক, পুলিশ, আমলারা ওজর আপত্তি করবেই। গোপনে এসবি, আইবি ঢ্যাড়া দেবে, তার চেয়ে খোলা কমিটিতে সাধারণের সমক্ষে তাদের বক্তব্য পেশ করতে বাধ্য করাই তো ভাল।’
‘পরিবর্তন’ও এক দিন পুরনো হয়ে যাবে। তার গায়েও ক্ষমতার মেদ জমবে। ক্ষমতার ভাষা শিখতে শুরু করবে সে। হয়তো বা করেছেও! সমালোচনা সহ্য করার সহনশীলতা কমবে ধীরে ধীরে। সে বলতে শুরু করবে, ‘টাচ মি ইফ ইউ ক্যান!’ কিন্তু ‘পরিবর্তন’ তো স্বপ্নও দেখতে শিখিয়েছে! কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকায় আর একটু পরিবর্তনের স্বপ্ন! ক্ষমতার ভাষাকে একটু পাল্টে দিয়ে স্বপ্ন দেখি না কেন, হয়তো কোনও দিন উন্নয়নের ডানা মেলে উড়াল দেবে আমাদের রাজ্যও! বলবে, ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান!’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.