বামফ্রন্ট শাসনে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন-এর সঙ্গে কথা বললেন স্বাতী ভট্টাচার্য
|
পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানায় প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়েছিল। এ রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গোটা দেশের মডেল হিসেবে কাজ করেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এ রাজ্যের মানুষ কী পেয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থেকে?
প্রণব: সবচেয়ে বড় সুফল হল গরিব মানুষের মর্যাদার বোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতার বৃদ্ধি। ভারতের অন্যান্য জায়গায় এগুলো এসেছে অন্য ভাবে, যেমন জাতপাতের ভিত্তিতে আন্দোলনের ফলে দলিতদের মধ্যে মর্যাদার বোধ তৈরি হয়েছে অনেক রাজ্যে। কিন্তু এ রাজ্যে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে সক্ষমতার ধারণা তৈরি হয়েছে অনেকটাই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করে পঞ্চায়েতের হাতে গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করা এবং টাকা খরচ করার যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, তা থেকে এটাই প্রধান লাভ বলে আমি মনে করি।
কিন্তু গরিবের আর্থিক উন্নতি? বামফ্রন্ট সরকার বরাবর দাবি করেছে যে ভূমিসংস্কার এবং বিকেন্দ্রিত প্রশাসনের জন্য গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র কমেছে। দুটোই কার্যকর হয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে।
প্রণব: পঞ্চায়েত যে গরিবের জন্য কিছুই করেনি, এমন নয়। আমরা বেশ কিছু দিন ধরে এ রাজ্যের ৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতে সমীক্ষা করে দেখেছি, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সরকারি অনুদান সত্যিই পৌঁছিয়েছে কিছু গরিবের কাছে। জনসংখ্যায় দরিদ্রের যা অনুপাত, অনুদান প্রাপকদের মধ্যে তাঁরা রয়েছেন তার চেয়ে বেশি অনুপাতেই। পঞ্চায়েত গরিবকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, তা বলতেই হবে। কিন্তু যত গরিবের সহায়তা প্রয়োজন ছিল, তার খুব সামান্য অংশের কাছে এই সহায়তা পৌঁছেছে। তাই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কিছু গরিব মানুষের উপকার হলেও, তারা মোট গরিবের মধ্যে এতই কম যে গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে প্রধানত এই কারণে দারিদ্র কমেছে বলে দাবি করা চলে না।
ভূমিসংস্কারের জন্য দারিদ্র কমার বিষয়টা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলেছি। আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সেচ এবং মিনিকিট বিতরণ রাজ্যের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে অপারেশন বর্গার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই রাজ্যে গ্রামীণ ক্ষেত্রে দারিদ্র কমানোর প্রধান কারণ ভূমিসংস্কার, তা-ও বলা চলে না। তবে সেচের বৃদ্ধির সঙ্গে ভূমিসংস্কার পরোক্ষ ভাবে জড়িত। |
পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফলে প্রশাসনে গরিব মানুষের যোগদান বাড়ল, অথচ দারিদ্র কমল না। এর কারণ কী?
প্রণব: এর কয়েকটা কারণ লক্ষ করা যায়। এক, কেরলে রাজ্য সরকার রাজ্যের আয়ের ৪০ শতাংশ পঞ্চায়েতগুলোর হাতে তুলে দিয়েছিল। এ রাজ্যে দেওয়া হয়েছে খুব সামান্য টাকা। অন্য দিকে পঞ্চায়েতকেও কর আদায় বা অন্যান্য উপায়ে স্থানীয় স্তরে সম্পদ তৈরি করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই গ্রামে দারিদ্র দূর করার জন্য পঞ্চায়েত তার ভূমিকা সে ভাবে পালন করতে পারেনি। দুই, পঞ্চায়েতের থেকে যা গরিবদের দেওয়া হয়েছে তা মূলত ব্যক্তিগত সম্পদ-- ইন্দিরা আবাসের বাড়ি, বীজের মিনিকিট, ভর্তুকি-দেওয়া চাল, ইত্যাদি। পঞ্চায়েতের হাতে আরও সম্পদ থাকলে সামগ্রিক ভাবে স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নের যে ব্যবস্থাগুলো করা যেত, যেমন রাস্তাঘাট তৈরি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পরিবহণের উন্নতি, সেগুলো অনেকটাই করা যায়নি। পঞ্চায়েত মূলত ব্যক্তিগত সম্পদ বণ্টন করেছে বলে গরিবদের ‘ভোট কেনা’ ব্যাপারটাও ঘটেছে। সরকারি অনুদান কিছু গরিবদের কাছে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দা করেছে দলগুলো। অন্য রাজ্যে দেখা যায়, গ্রামের ধনীরা সরকারি অনুদান লোপাট করে দিচ্ছে। এ রাজ্যে দেখা যাচ্ছে, গরিবকেই অনুদান দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা রাজনৈতিক সমর্থনের শর্তে-- তাদেরকে কোনও একটি দলের ‘ক্লায়েন্ট’ (পোষ্য) করে ফেলা হচ্ছে।
সরকারি অনুদান বণ্টনে সমস্যাটা কোথায়? তা কি মূলত রাজনৈতিক?
প্রণব: জেলাগুলিকে অনুদানের ভিত্তি ঠিক করে দেওয়ার কথা রাজ্য অর্থ কমিশনের। কিন্তু আমরা যখন রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনকে প্রশ্ন করেছি, কীসের ভিত্তিতে জেলাগুলোকে অনুদান বরাদ্দ করা হচ্ছে, তাঁরা কিন্তু কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। জেলার সভাধিপতিদের সঙ্গে কথা বলে দেখছি, তাঁরাও জানেন না কীসের ভিত্তিতে তাঁদের বরাদ্দ নির্ধারিত হচ্ছে। আমাদের সমীক্ষায় দেখছি, যে সব অঞ্চলে সম্পদবণ্টনে বিসমতা বেশি, যেমন যেখানে জমির মালিকানার বেশির ভাগটাই অল্প কিছু মানুষের হাতে, সে সব জায়গায় সরকারি টাকা বরাদ্দ হয়েছে বেশি। এটা রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রভাবিত করেই সম্ভব হচ্ছে।
যদি পঞ্চায়েতগুলোকে টাকার জন্য রাজ্য সরকারের উপর নির্ভরশীল করে না রেখে তাদের আরও বেশি সম্পদ স্থানীয় স্তরে সংগ্রহ করার ক্ষমতা দেওয়া হত, তা হলে স্থানীয় মানুষের কাছে জবাবদিহি করার দায়ও বাড়ত রাজনৈতিক দলগুলোর। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক কার্যপদ্ধতি থাকত, তা হলে নীচের তলা থেকে ঠিক হত কী কী বিষয় নিয়ে লড়াই হবে নির্বাচনে। নীচের তলা থেকে উঠে আসত নতুন নতুন নেতা। তখন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনের প্রতি অনেক বেশি সজাগ হতে পারত।
ভুল রাজনীতির কারণেই কি পঞ্চায়েত গরিবের চাহিদা মেটাতে পারছে না?
প্রণব: বামফ্রন্টের এক বড় নেতা, এ রাজ্যের প্রাক্তন এক মন্ত্রী সঙ্গত ভাবেই আমাকে বলেছিলেন, গ্রামে পঞ্চায়েত রাজনীতি বা শহরে ছাত্র রাজনীতি নতুন নতুন রাজনৈতিক কর্মী তৈরি করার সুযোগ তৈরি করে। কে অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে বেশি, দলের জন্য মানুষকে রাস্তায় নামাতে পারে বেশি, তার পরীক্ষা হয়ে যায় পঞ্চায়েতে। কিন্তু আমি মনে করি, কে ভাল নেতা তা বিচার করার মাপকাঠি বদলানো দরকার। যে ছাত্র নেতা অন্য অনেক ছাত্রকে রাস্তায় নামাল বা ব্রিগেড ভরাল সে-ই ভাল নেতা, না কি যে হস্টেলের খাবারের মান ভাল করল, সে-ই ছাত্র নেতা হিসেবে আরও বড়? স্থানীয় উন্নয়ন কে বেশি ভাল করতে পারছে, এটাও স্থানীয় রাজনীতির একটা শর্ত করতে হবে।
আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী বলেছিলেন, অনেক সময় পঞ্চায়েতকে আরও ক্ষমতা দেওয়ার রাস্তা রোধ করে দাঁড়ায় নিজের দলেরই বিধায়করা। এই রাজনৈতিক সমস্যাটা সব রাজ্যেই আসে। এর একটা সমাধান সম্ভব ছিল: কে বিধায়ক হবে, সেটা যদি দল উপর থেকে স্থির না করে স্থানীয় মানুষ ভোট দিয়ে স্থির করত। ইংল্যান্ডের টাউন হল মিটিংগুলোতে এমনই হয়ে থাকে। সেখানে সারা বছর নানা মিটিং হয় এবং যারা বিভিন্ন বিষয়ে ভাল নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে থেকে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।
পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতেও তো সকলের আলোচনার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, গ্রামসভাকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে।
প্রণব: কিন্তু রাজনৈতিক দলের উপরমহল থেকে কোন বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, কে গুরুত্বপূর্ণ তা স্থির করার যে প্রথা চালু হয়ে গিয়েছে, তার ফলে গ্রামসভার মতো মঞ্চগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষে মনে করে, ‘সভায় গিয়ে কী হবে, সিদ্ধান্ত যা পাশ হওয়ার তা তো পাশ হয়েই গিয়েছে।’ এটা খুবই বিপজ্জনক। এ ভাবেই কিন্তু আফ্রিকার অনেক দেশে গণতন্ত্র ভেঙে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। যে জনগোষ্ঠী সংখ্যায় কম, তারা আলোচনার দ্বারা প্রশাসনের পদ্ধতির উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
এ রাজ্যেও মনে হচ্ছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা কমে গিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বি ডি ও-দের নেতৃত্বের উপর বেশি জোর দিচ্ছে।
প্রণব: তৃণমূল সরকারের এই বিকেন্দ্রীকরণ-বিমুখতার একটা কারণ হয়তো এই যে এখনও অনেকগুলি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে সি পি আই এম-এর হাতে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিকেন্দ্রিত প্রশাসনের উপর এই অনাস্থার থেকে বেরোনো সম্ভব হতে পারে, যদি টাকা খরচ বিষয়ে কমিটিগুলিতে বিরোধীদের উপস্থিতি বাড়ানো যায়। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই বড় খরচের মূল্যায়নে অডিট কমিটিগুলোতে বিরোধী সদস্যরা পঞ্চায়েতে তাঁদের অনুপাতের চাইতে বেশি সংখ্যায় যদি থাকেন, তা হলে বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থা থেকে সরে না এসেও উন্নয়নের কাজ করা সম্ভব। একই সঙ্গে চিন্তা করতে হবে, রাজনীতিতে দায়বদ্ধতা কী করে বাড়ানো যায়। এখন অধিকাংশ দল হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ভদ্রলোকের পার্টি’। একশো দিনের কাজ হল কি হল না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যে মাথাব্যথা নেই, ভূমিহীন খেতমজুরের সমস্যাগুলো যে গ্রামের রাজনীতিতে প্রাধান্য পায় না, তার কারণ নীচের স্তরের নেতারা যথেষ্ট সংখ্যায় উঠে আসছে না দলের নেতৃত্বে। এটা ঠিকই যে, গোটা বিশ্বেই বিকেন্দ্রীকরণের উপর যে আস্থা ছিল নব্বইয়ের দশকে, গত দশ বছরে তা অনেকটাই কমে এসেছে। বিকেন্দ্রীকরণের বেশ কিছু সমস্যা টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে তিন দশক পরে বলা চলে, স্থানীয় স্বশাসন খুব বেশি সফল না হয়ে থাকলেও, তাকে উঠিয়ে দিয়ে বা কমজোর করে ফেলে লাভ হবে না। দরকার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, এবং আরও বেশি টাকা পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেওয়া। পঞ্চায়েতের হাতে আরও সম্পদ ও স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা না দেওয়ার ফলে দারিদ্র কমানোর একটা বড় সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়েছে বামফ্রন্ট আমলে। সেই ভুল যেন আবার না করা হয়। |