ব্রিটিশদের পর অস্ট্রেলিয়া। বিদেশের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতীয় দলের নাজেহাল অবস্থা দেখিয়া দর্শকদের মন ভাঙিয়াছে। তাঁহাদের দোষ দেওয়ার নহে। শীতের লেপের মায়া কাটাইয়া ভোর পাঁচটায় টেলিভিশনের সম্মুখে বসিয়া যদি একই বিপর্যয় বার বার দেখিতে হয়, তাহাতে হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার হয় না। কিন্তু, ভাবিয়া দেখিবার, এই বিপর্যয় কি অপ্রত্যাশিত? অস্বাভাবিক? না। কারণ, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় যে প্রকার পিচে খেলা হয়, ভারতীয় ক্রিকেটাররা তেমন পিচে অভ্যস্ত নহেন। তাঁহারা উপমহাদেশের পিচে আজন্ম লালিত যেখানে বল হাঁটুর নীচে থাকে, ঘোরে। সেই পিচে তাঁহারা ভাল খেলেন, রেকর্ডও গড়িয়া থাকেন। দেশের পিচে ভাল খেলিতে পারেন, অথচ বিদেশে কূল পান না এই অবস্থাটি লজ্জার নহে। ক্ষুব্ধ দর্শকরা ভাবিয়া দেখিতে পারেন, ভারত যখন দেশের মাটিতে খেলে, তখন প্রতিপক্ষ আকাশ হইতে নামিয়া আসে না অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার দলগুলিই খেলিতে আসে। অর্থাৎ, তাঁহারাও নিজেদের দেশে যতখানি দক্ষ, ভারতে ততখানি নহেন। ইহা সমাপতন নহে, ইহাই স্বাভাবিক। ক্রিকেটের জন্মলগ্ন হইতেই প্রতিটি দেশ নিজের খেলোয়াড়দের দক্ষতা মাপিয়া পিচ বানাইয়াছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস বোলিংয়ের স্বর্ণযুগে বার্বাডোজ বা জামাইকার সবুজ পিচ না ঢাকিয়া রাখাই দস্তুর ছিল। তবুও তাহা ভিন্ন যুগের গল্প। তখনও ক্রিকেট এমন সর্বান্তকরণে বাণিজ্যিক হইয়া উঠে নাই। এখন ক্রিকেট মানে বিপুল বাণিজ্য। দেশের মাঠে দেশের দল জিতিলে সেই বাণিজ্য পুষ্পে-পর্ণে আরও বিকশিত হয়। কাজেই, দেশের খেলোয়াড়দের দক্ষতার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাই এখন আন্তর্জাতিক দস্তুর। বাণিজ্যিকীকরণ যত বাড়িবে, এই অভ্যাসও ততই গভীর হইবে। প্রশ্ন হইল, এই পরিস্থিতিতে মানাইয়া লইবার উপায় কী? একটিই উপায়: খেলোয়াড় তৈরি করা। সচিন তেন্ডুলকরের ন্যায় দুই এক জন বিরল প্রতিভা প্রতি কুড়ি বৎসরে এক বার হয়তো আসিবেন, যাঁহারা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই দক্ষ ভাবে খেলিতে পারিবেন। কিন্তু, তাঁহার মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকা যায় না। যে তরুণ খেলোয়াড়দের দেখিয়া বোধ হইবে যে তাঁহারা যথেষ্ট প্রশিক্ষণ পাইলে বাউন্সি বা সিমিং উইকেটে খেলিতে দক্ষ হইয়া উঠিতে পারেন, তাঁহাদের জন্য সেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পয়সার অভাব নাই। কাজেই, প্রয়োজন বোধে এই খেলোয়াড়দের দীর্ঘ দিন ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় রাখিতে হইবে, সেইখানে খেলাইতে হইবে। যে খেলোয়াড়রা চরিত্রগত ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে খেলিতেই দক্ষ হইবেন, তাঁহাদের জন্য দেশেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। অর্থাৎ, দুইটি বা তিনটি টেস্ট দল প্রস্তুত রাখিতে হইবে। যে পরিবেশে খেলা হইবে, সেই পরিবেশের উপযোগী দল মাঠে নামানোই বিধেয়। টেনিস খেলায় কোর্ট কখনও দ্রুত হয়, কখনও মন্থর। কোনও খেলোয়াড় দ্রুত কোর্টে অনবদ্য হইলেই যে তিনি মন্থর কোর্টেও দুর্দান্ত খেলিবেন, তাহা নহে। যে দেশ উভয় প্রকারের খেলোয়াড়কেই লালন করে, সেই দেশই সফল হয়। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। কোনও খেলোয়াড় ইংল্যান্ডের পিচে খেলিতে না পারিলেই তাঁহার অযোগ্যতা প্রমাণ হয় না। কলম দিয়া মাটি কোপানো যায় না, কিন্তু তাহাতে কলমের মাহাত্ম্য বা গুরুত্ব কমে না। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কলমটিকে লেখার জন্য রাখিয়া মাটি কোপাইতে কোদাল ব্যবহার করেন। তাহাতে কলমও বাঁচে, মাটিও কোপানো হয়। |