কয়েক দিন আগে আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, কলকাতার উপকণ্ঠে সল্টলেকে অবস্থিত ‘ইন্দিরা ভবন’ নামে ‘অতিথি ভবন’ বা গেস্ট হাউসটি ‘নজরুল আকাদেমি’-তে রূপান্তরিত হবে। এই শুভ সংকল্পের জন্য প্রথমেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই। নজরুল পরিবারের এক সদস্যা আমি। সেই কারণেই আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি এই আনুগত্য বা কৃতজ্ঞতা দেখানোর মধ্যে পক্ষপাতের কোনও সুঘ্রাণ গ্রহণের চেষ্টা করবেন না দয়া করে। ‘ইন্দিরা ভবন’-কে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরে যে রাজনৈতিক ‘তরজা’ বা ‘কাজিয়া’ দেখেছি ও শুনেছি এ যাবৎ, তা বড়ই ভয়ানক। বেদনাদায়কও বটে।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় সম্পদ। ‘নজরুল আকাদেমি’ হোক বা না হোক, প্রস্তাবিত স্থানে অথবা অন্য কোথাও, তিনি যে অবস্থানে ছিলেন, সেই অবস্থানেই থাকবেন। তাঁর সৃষ্টির জন্য আমাদের সকলের কাছে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবি রূপেই চিরস্মরণীয়। দীর্ঘ সময় ব্রাত্য থাকার পর নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে বর্তমান সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রশংসার যোগ্য। পাশাপাশি যাঁরা সস্তা রাজনীতির মোড়কে কবির প্রতিভাকে কেবলই ধ্বস্ত করতে চাইছেন, তাঁদের প্রতি বিনীত অনুরোধ যে, কবির প্রতি আপনাদের শ্রদ্ধা না-হয় না-ই রইল, কিন্তু তাঁকে রাজনীতির নোংরা খেলার অংশীদার করবেন না। |
‘নজরুল আকাদেমি’ ‘ইন্দিরা ভবন’-এ হোক বা অন্য কোথাও অথবা যদি না-ই হয়, তবে কি কাজী নজরুল তাঁর অস্তিত্ব থেকে বিচ্যুত হবেন? বোধহয় নজরুল ইসলাম সেই মাপের কবি নন। অদ্ভুত ভাবে লক্ষ করা গেল, বিতণ্ডা যখন প্রবহমান, তখন রাজ্যের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী-কুল যাঁরা অবশ্যই বুদ্ধিজীবী হওয়ার দাবিদার, তাঁরাও উত্তাপহীন রয়ে গেলেন। যেখানে কথায় কথায়, যে কোনও প্রশ্নে আমরা তাঁদের পথে নামতে দেখেছি, সেখানে এই মৌন কীসের লক্ষণ, তা ঠিক বোঝা গেল না। এটি বিস্ময়ও বটে!
বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রাম চুরুলিয়ার এক বর্ধিষ্ণু মুসলমান পরিবারে তাঁর জন্ম। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে নিজ ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি কটাক্ষ তাঁর বহু লেখায় প্রকট। তার পর ধর্মীয় সব বাধা অতিক্রম করে এক হিন্দু নারীকে বিবাহ। শ্যামা মায়ের পুজো করা, শ্যামাসংগীত রচনা করা এবং হিন্দু ধর্মের অনুরাগী হয়ে ওঠা, নিজের ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েও বোধকরি তাঁর চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি এ যুগেও এক বিরল দৃষ্টান্ত। কাজেই যাঁরা নজরুল ইসলামকে ইসলাম ধর্মের প্রতিভূ মনে করেন এবং ওই সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করেন, তাঁদের অজ্ঞতা নিরসনের জন্য আর জ্ঞানচক্ষু খুলে দেওয়ার জন্যই এই কথাগুলি। নজরুল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন, নেতাজির সুহৃদ, শরৎচন্দ্রের আশীর্বাদধন্য। দমকা হাওয়ার মতো গতিময়, দৃপ্ত, উন্নতশির, নির্ভীক নজরুল শুধুমাত্র সাহিত্যসেবী ছিলেন না, ছিলেন দেশহিতৈষী, পরাধীন দেশের নানা প্রকার সংগঠনমূলক কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তাঁর বহুবিধ কর্মকাণ্ডের অনেকটাই পাঠককুলের অজ্ঞাত। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সকলের। তিনি কোনও জাতির নন। নন কোনও ধর্মের। সৃজনশীল মানুষরা জাতপাতের ঊর্ধ্বে।
সত্তর দশকের শুরুতে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আমন্ত্রণে নজরুলের জন্মদিন পালনের জন্য তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে সেখানকার নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং ‘জাতীয় কবি’-র মর্যাদা দেওয়া হয়। নজরুলের তিরোধানের পর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। অথচ আমাদের দেশের কবিকে আমরা আমাদের দেশে রাখতে পারলাম না। এ লজ্জা আমাদের। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রতি অত্যন্ত বিনীত মত পোষণ করে বলি, নজরুল ইসলাম কিন্তু এত বৃহৎ কর্মকাণ্ড চাননি। তিনি অনেক অভিমানে লিখে গেছেন, “আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম, প্রেম দিতে এসেছিলাম আর সেই প্রেম পেলাম না বলে প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে বিদায় নিলাম”। এর পরেও যখন ‘দক্ষ’ এবং ‘চৌখস’ রাজনীতিকরা নজরুল জন্মদিবসের সভামঞ্চে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাটি এই বলে শেষ করেন যে “কাজী নজরুল ইসলাম শুধু হুজুগের কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন যুগের কান্ডারি।”। তবে তার মতো হাস্যকর মঞ্চসফল পালা আর কী হতে পারে!
সব শেষে অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথাতেই আর একবার বলি, ...
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তার ঘুচে যাক।
অনিন্দিতা কাজী। কলকাতা-৬৮ |