রাজপুতানায় সন্ন্যাসী
‘রাজগুরু’কে আঁকড়ে বাঁচতে চায় স্মৃতির শহর
নিম-কা-থানা পেরিয়ে এলাম। সামনে সিঙ্গল লাইনের লেভেল ক্রসিং, ভাঙাচোরা রাস্তায় পাথরবোঝাই ট্রাক থেকে উটের গাড়ি সব একসঙ্গে। দু’পাশে বালিয়াড়ি, দূরে আরাবল্লী পাহাড়।
এটাই জয়পুর থেকে খেতড়ি যাওয়ার রাস্তা। উত্তর-পূর্ব রাজস্থানে এই খেতড়ির রাজা অজিত সিংহ গেরুয়াধারী এক বাঙালি সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। গুরুকে তিনিই পাকাপাকিভাবে স্বামী বিবেকানন্দ নামটি রেখে দিতে অনুরোধ করেন। শিকাগো যাওয়ার জন্য ‘ওরিয়েন্ট’ জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনে দেন। এমনকী ধর্মমহাসভায় গৈরিক উষ্ণীষ আর আলখাল্লা পরা বিবেকানন্দের যে পরিচিত ছবি, সেই পোশাকও অজিত সিংহের অবদান। প্রথম বার বিদেশ থেকে ফিরে ১৮৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক বক্তৃতাতে বিবেকানন্দও বলেন, “ভারতের উন্নতির জন্য যা কিছু আমি করতে পেরেছি, খেতড়িরাজের সঙ্গে পরিচয় না হলে সম্ভব হত না।”
তাঁর সার্ধশতবর্ষে কেমন আছে সেই খেতড়ি? বিবেকানন্দ তিন বার খেতড়ি গিয়েছেন। শিকাগো যাওয়ার আগে ১৮৯১ ও ১৮৯৩ সালে। শিকাগো থেকে ফেরার পর ১৮৯৭ সালে রাজার উদ্যোগে খেতড়িতে তাঁর সম্বর্ধনা। তিন দফায় মোট ১২১ দিন। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে ছিলেন মোট ১৭৮ দিন। ইতিহাস বলছে, বেলুড়ের পর খেতড়িতেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন বিবেকানন্দ।
রাজপ্রাসাদের তিনতলায় স্বামীজির সেই ঘর। সামনেই দোতলার সেই বারান্দা। ছবি: বিক্রমজিৎ চক্রবর্তী
তিন বারই বিবেকানন্দ খেতড়ি গিয়েছেন জয়পুর হয়ে। ১৮৯৭ সালে, শেষ বার লেগেছে তিন দিন। দু’ দিকে বালিয়াড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ও উটের গাড়িতে সঙ্গীদের নিয়ে চলেছেন বিবেকানন্দ। জীবনীকার গম্ভীরানন্দের ভাষায়, ‘একঘেয়ে বালি ও পথের উত্থানপতন...পথশ্রম তো আছেই।’ এখন সেই ‘পথশ্রম’ নেই, জয়পুর বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে ঘণ্টা পাঁচেক। বালিয়াড়ি এবং ভাঙা রাস্তা আসবে প্রায় তিন ঘণ্টা পরে। তার আগে চার লেনের সওয়াই মান সিংহ হাইওয়ে। রাস্তার ধারে কখনও ‘রিকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট’, কখনও বা নতুন সব টাউনশিপ।
নিম-কা-থানা থেকে বওয়াই, পপুর্ণা পেরিয়ে অবশেষে কংক্রিটের বাঁকাচোরা তোরণ: ‘বিবেকানন্দ নগরীমে আপকো স্বাগত হ্যায়’। খেতড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান কালীচরণ গুপ্ত জানাচ্ছেন, দু’বছর আগেই বসানো হয়েছে এই তোরণ। খেতড়ির সরকারি কলেজ এবং আইটিআই-এর নামও বিবেকানন্দের নামে। ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল, বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি একটি নতুন সিবিএসই স্কুল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও সন্ন্যাসীর নামে। শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিং নিজামপুর চকে দেড় দশক আগে বিবেকানন্দের মূর্তি বসিয়েছিলেন রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভৈরো সিংহ শেখাওয়াত। সেই রাস্তার নাম এখন ‘বিবেকানন্দ চক’। সার্ধশতবর্ষে তো কথাই নেই! রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হচ্ছে খেতড়ির রাজবাড়ি। আগামী বছরেই খোলা হবে বিবেকানন্দ ও খেতড়ির সম্পর্ক নিয়ে নতুন একটি প্রদর্শশালা। সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় অনুদান তিন কোটি টাকা। ৫০ লক্ষ টাকা দিচ্ছে রাজস্থান সরকার। খেতড়ি যে জেলায়, সেই ঝুনঝুনুর জেলা শাসক যোগরাম জাহাগিড় হাসছেন, “বিবেকানন্দকে এখানে কেউ ভোলেনি। রামকৃষ্ণের কথা এখানে অনেকেই জানেন না, কিন্তু বিবেকানন্দ? ওঁর মতো দেশপ্রেমিক এবং তরুণদের উদ্বুদ্ধ-করা সন্ন্যাসী আর তো এলেন না।”
এবং সার্ধশতবর্ষে বিবেকানন্দকে আরও আঁকড়ে ধরতে চাইছে রাজস্থানের এই মফস্সল। কারণ, সন্ন্যাসীই হতে পারেন মৃতপ্রায় এই শহরের জীবন্ত ‘ব্র্যান্ড ইকুইটি’। দু’দশক আগেও খেতড়ি গমগম করত ‘হিন্দুস্থান কপার লিমিটেড’-এর (এইচসিএল) দৌলতে। এখন খনিগুলিতে তামা নিঃশেষিত। বেশির ভাগ আবাসন ভুতুড়ে বাড়ির মতো জনশূন্য, দরজা-জানলাও হাওয়া। খনিসংস্থার ডেপুটি ম্যানেজার অরীন্দ্রনারায়ণ মিত্র বলছিলেন, “আগে ৯ হাজার লোক থাকত, এখন মেরেকেটে হাজার দুয়েক।” বিবেকানন্দের আমলে খেতড়িতে রেল-যোগাযোগ ছিল না, এখনও নেই। তবে হরিয়ানার নারনল থেকে খেতড়ির ২০ কিমি দূরে মাউন্ডা অবধি ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন যাতায়াত করছে। এখানকার পুরপ্রধান সীতারাম বর্মার কাতর অনুরোধ, “মমতাজি বা দীনেশ ত্রিবেদীজিদের বলুন না, রেললাইনটা এখানে এনে দিতে। কলকাতা থেকে দিল্লি, নারনল হয়ে খেতড়ি অবধি বিবেক এক্সপ্রেস।”
খেতড়ি রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী আত্মনিষ্ঠানন্দের মতে, সঠিক পরিকল্পনায় গোটা শহরটাই হয়ে উঠতে পারে ‘হেরিটেজ টাউন’। এখানে বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য রাজবাড়ি, দুর্গ এবং সরোবর রয়েছে। খেতড়িরাজের বাসভবন ‘ফতেহ বিলাস’ প্রাসাদে বিবেকানন্দ উঠতেন। পরবর্তীকালে এই প্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়। খেতড়ির ইতিহাসকার ঝাবরমল শর্মার চেষ্টায় ১৯৫৯ সালে শেষ রাজা সর্দার সিংহ পরিত্যক্ত প্রাসাদটি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেন। প্রাসাদে ঢোকার মুখে সাইনবোর্ডে লেখা ‘রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ স্মৃতিমন্দির’। প্রথম পাঁচ বছর লোকাভাবে বেলুুড় মঠ কোনও সন্ন্যাসীকে পাঠাতে পারেনি। ঝাবরমল শর্মার দায়িত্বেই ছিল স্মৃতিমন্দির। আসলে খেতড়ি এমন একটা জায়গা, যেখানে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনকে সন্ন্যাসী পাঠিয়ে আলাদা করে উদ্যোগী হতে হয় না। ইতিহাস এবং স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় তৈরি হয়ে যায় বিবেকানন্দ স্মৃতিমন্দির।
কারণটা সহজ। রামকৃষ্ণ মিশন, বেলুড় মঠ, সেবাধর্ম এবং শিক্ষাপ্রচার অনেক পরে। শুরুর শুরু রাজস্থানের এই প্রত্যন্ত মফস্সলেই। ১৮৯৪ সালে বিদেশ থেকে সতীর্থ অখণ্ডানন্দকে বিবেকানন্দ লিখছেন, ‘খেতড়ি শহরের গরিব নীচজাতির ঘরে ঘরে গিয়া ধর্ম উপদেশ করিবে আর তাদের অন্যান্য বিষয়, ভূগোল ইত্যাদি মৌখিক উপদেশ দিবে। বসে বসে রাজভোগ খাওয়ায় আর ‘হে প্রভু রামকৃষ্ণ’ বলায় কোনও ফল নাই, যদি কিছু গরিবদের উপকার না করিতে পার।’
তিন তলা প্রাসাদের এক তলায় রাজার দরবার হল, দোতলায় দেওয়ানখানা। দোতলাতেই রাজা থাকতেন, তিন তলায় তাঁর গুরুর ঘর। এখন সেটি ঠাকুরঘর। ঘরের পাশের ছাদে আজও একটি পাথরের বেঞ্চ। রাজগুরু এখানে মাঝে মাঝে বসতেন। তিন তলায় তাঁর ঘরের বারান্দা থেকে চোখে পড়ে, দোতলার প্রশস্ত বারান্দা। ওই বারান্দাতেই গান গেয়েছিলেন ময়নাবাই। ১৮৯১ সালে বিবেকানন্দ রাজার সঙ্গে প্রথম খেতড়ি এসেছেন। রবিবার, ৯ অগস্ট বিকেলে টেনিস খেলার শেষে রাজা এসেছেন দোতলার দেওয়ানখানায়। গুরুর সঙ্গে আলোচনা চলছে। ময়নাবাই গান শোনাতে এসেছেন। বিবেকানন্দ জানালেন, সন্ন্যাসীর পক্ষে বাইজির গান শোনা উচিত নয়। ছাদের ঘরে উঠে এলেন তিনি। সেখান থেকেই কানে এল দোতলার বারান্দায় বাইজির গান, ‘প্রভু, মেরে অবগুণ চিত না ধরো।’
সেই গানের টানে ছাদের ঘর থেকে নেমে বারান্দার জলসায় চলে এলেন সন্ন্যাসী। বহু পরেও ঘটনাটি ভুলবেন না তিনি। শিষ্যদের বলবেন, “গানটি শুনে মনে হল, এই কি আমার সন্ন্যাস? আমি সন্ন্যাসী, অথচ এখনও ভেদজ্ঞান রয়ে গিয়েছে। আমার চোখ খুলে গেল। বুঝলাম, সর্ববস্তু সেই পরম সত্তার অভিব্যক্তি, কাউকে নিন্দার জো নেই।”
সেই ঘর আর বারান্দাকে ফের আগের চেহারায় ফেরানোর জন্য জোর কদমে চলছে সংস্কার।

(চলবে)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.