গঙ্গার ধারে রাধারাণি মন্দিরের চাতালে বসে স্মৃতিচারণ করছিলেন মধ্য ষাটের বাসন্তী চক্রবর্তী। কনকনে ঠান্ডার দুপুরে রোদ্দুরে পীঠ দিয়ে বসা আর পৌষ পার্বণ পিঠে পুলির গন্ধ এখনও মনে রয়ে গিয়েছে। ঘন ক্ষীরে ডোবানো গরম গরম পুলি। গোল করে সাজিয়ে রাখা পুলির মধ্যে একটা ছোট্ট বাটিতে রাখা মিহি করে বাটা চন্দন। সংক্রান্তির আগের রাতেই তৈরি করা হত সব। রাতভর গরম ভাপে পুলিতে মিশে যায় চন্দনের গন্ধ। পৌষ সংক্রান্তির সকালে ঢাকনা খুলতেই সারা বাড়ি ভরে উঠত চন্দন-পুলির গন্ধে।
বাংলাদেশের যশোরের চরমাগনা গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে পৌষ সংক্রান্তির বিশেষ আকর্ষণ ছিল চন্দন পুলি। সেই মিষ্টি খেতে চলে আসতেন পড়শিরাও। মন্দির চাতালে আশ্রিতা বাসন্তীদেবীর কথায়, ‘‘পুলির গায়ে সেই চন্দনের সুবাস নিয়ে গ্রামের বউ-ঝি’দের কৌতুহলের অন্ত ছিল না। কিন্তু শাশুড়ি মা কোনও দিন কারও কাছে সেই রহস্য ফাঁস করেননি।’’
ঢাকার মাধবডিহিতে বাপের বাড়ি পারুলবালা পোদ্দারের। বিয়ে হয়েছিল গ্রাম থেকে মাইল খানেক দূরে কামরাঙির চরে। সত্তর পেরিয়ে যাওয়া পারুলবালাদেবী অবশ্য দেশ ভাগের পর থেকেই নবদ্বীপের বাসিন্দা। তাঁর স্মৃতিতেও উজ্জ্বল ফেলে আসা গ্রামের পৌষ পার্বণের কথা। নবদ্বীপের বাড়িতে সংক্রান্তির দুপুরে নলেন গুড়ের পায়েসে জ্বাল দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘‘এখন তো শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষায় সামান্য একটু পিঠে বা পায়েস তৈরি করা হয়। মাধবডিহি বা কামরাঙিতে দেখেছি, প্রতি বছর মা ঠাকুমারা চেষ্টা করতেন একটা নতুন কিছু পদ তৈরি করতে। এক বার আমার মা আলুর পিঠে তৈরি করেছিলেন। সেদ্ধ আলু আর ক্ষীর-এলাচ-নারকেলের সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। মা পরিবেশনও করতেন যত্ন করে। ক্ষীরের উপরে আবার গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখতেন। এখন সে সব শুধুই স্মৃতি।’’ মাধবডিহি, কামরাঙির চর, বাবুরহাট, চরমাগনির মতো ওপার বাংলার ঢাকা, বরিশাল বা যশোরের বিভিন্ন গ্রামের পৌষ পার্বণের সকালটা অন্য রকম ছিল। সংক্রান্তির আগের দিন কেটে আনা ধান পুজোর প্রস্তুতি দিয়ে শুরু হত পার্বন। যশোরের বাবুরহাটের একদা বাসিন্দা কল্পনাদেবী বলেন, ‘‘আমরা ওই ধানের গোছাকে বলতাম আওনি-বাওনি। পুজো করে সারা রাত চলত পৌষ আগলানো। আল্পনা এঁকে বাড়ির উঠোন থেকে কিছুটা দূরে গোবর আর চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পুতুল পুজো হতো। রাত জাগতেন গ্রামের মেয়ে বউরা। আর গোটা রাত চলত পিঠে পুলি তৈরি। সব বাড়িতেই কিছু না কিছু হতো। হঠাৎ দেখলে মনে হতো গোটা গ্রামটাই যেন একটা পাকশালা। সংক্রান্তির সকালে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় গ্রামের পুকুর বা নদীতে পুজোর উপকরণ বিসর্জন দিয়ে স্নান সেরে তার পর পিঠে পুলি খাওয়া। উৎসবেপুরুষদের খাওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও ভূমিকা থাকত না।’’ তবে এ সবই পঞ্চাশ, ষাট বছর কিংবা তারও আগের কথা। নবদ্বীপের স্বপ্না লাহিড়ি বলেন, ‘‘পিঠে-পুলি কাদের জন্য করব? আজকাল ছেলেমেয়েরা এ সব খাবার পছন্দ করে না। তার উপরে জিনিসের যা দাম, তাতে সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না।” পৌষ পার্বণে নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরে ভিড় জমান ভক্তেরা। দেবতাকে দেওয়া ভোগে পিঠে পুলির বৈচিত্র নজর কাড়ার মতই। হরিসভা মন্দির, রাধারমণবাগ সমাজবাড়ি, গৌড়ীয় মঠ, মহাপ্রভু মন্দির, বলদেব মন্দির-সহ বেশির ভাগ মন্দিরেই এ দিন ষোড়শোপচারে পিঠে, পুলি, মালপোয়া, পরমান্ন দিয়ে সাজানো হয় ‘পৌষালী’। সমাজবাড়ি মন্দিরের প্রধান ভাণ্ডারী অবিরাম দাস বলেন, ‘‘উৎসবের দিন আমাদের মঠে বিশেষ ভোগ হয়। আজ পিঠে পুলির দিন। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। দু’দিন ধরে মঠের বাবাজিরাই চন্দ্রপুলি, মালপোয়া, পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি, মুগের পুলি, রসবড়া, পরমান্ন, তিল এবং নতুন গুড় দিয়ে তৈরি নানারকম মিষ্টি তৈরি করছেন।’’ রাধারমণবাগ সমাজবাড়িতে একটি বিশেষ ধরণের পুলির কথা জানালেন অবিরাম দাস। মুগের ডালের সঙ্গে আদা-লঙ্কার ঝালপুলি। অবিরাম দাসের কথায়, ‘‘পিঠে পুলিতে বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করি।” |