নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর এক ‘অভিনব’ পন্থা বার করেছিলেন মালদহ জেলা হাসপাতালের সিক নিওনেটাল কেয়ার সেন্টার (এসএনসিইউ)-এর চিকিৎসকেরা। গুরুতর অসুস্থ সদ্যোজাতকে এসএনসিইউয়ে রাখা বাধ্যতামূলক হলেও তাদের ঠাঁই হয়েছিল সাধারণ শিশু ওয়ার্ডে। সেখানে সদ্যোজাতদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিই নেই। সেই যন্ত্র রয়েছে এসএনসিইউয়ে। অথচ অভিযোগ, সেখানে ভর্তি করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত সুস্থ শিশুদের!
আচমকা পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা সম্প্রতি এই বেআইনি কাজ হাতেনাতে ধরতে পেরেছেন। সদ্যোজাত-মৃত্যু আটকাতে স্বাস্থ্য দফতর মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে একের পর এক এসএনসিইউ খুলে চলেছে। এখনও পর্যন্ত ১৩টি খোলা হয়েছে। মার্চের মধ্যে ৩০টি খোলার কথা। সেখানে সেই এসএনসিইউয়েই কর্মসংস্কৃতি ও চিকিৎসকদের মানসিকতার এই নমুনায় টাস্ক ফোর্সের সদস্যেরা বিস্মিত, ক্ষুব্ধ।
সদস্যেরা লিখিত রিপোর্টে জানিয়েছেন, শুধু মালদহ নয়, আচমকা পরিদর্শনে একাধিক এসএনসিইউতে বিভিন্ন গলদ পাওয়া গিয়েছে। যেমন সিউড়িতে মালদহের মতোই বেশি অসুস্থ সদ্যোজাতকে এসএনসিইউয়ের বাইরে রাখা হচ্ছে অথচ কম অসুস্থদের ভর্তি করা হচ্ছে! বর্ধমানে পেডিয়াট্রিক নিউবর্ন ওয়ার্ডে রোগীর বাড়ির লোক স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করছেন, এম আর বাঙুরের এসএনসিইউয়ে রাতে কদাচিৎ নার্সের দেখা মিলছে, বিসি রায় শিশু হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ সদ্যোজাতকে এসএনসিইউয়ের বদলে পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে অন্য শিশুর সঙ্গে একই শয্যায় রাখা হয়েছে।
টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এই রকম যে হতে পারে, কল্পনাও করিনি। একাধিক এসএনসিইউয়ে চিকিৎসকেরা ভেবে নিচ্ছেন, বেশি অসুস্থ সদ্যোজাতকে সাধারণ শিশু বিভাগে ফেলে রাখলে আর সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে না। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দিতে হবে না। তাঁরা ঝাড়া হাত পা থাকতে পারবেন। এসএনসিইউয়ে কোনও শিশু মারা গেলে হইচই বেশি হবে, তাই গুরুতর অসুস্থদের তাঁরা ভর্তিই করেননি!” তিনি জানান, টাস্ক ফোর্সের তরফ থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসা হয়েছে, এ বার থেকে এসএনসিইউয়ে কোন শিশু ভর্তি হবে সেটা হাসপাতালে আলাদা কমিটি ঠিক করবে। ব্যক্তিগত ভাবে ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেবেন না।
রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কমিশনার দিলীপ ঘোষ গোটা বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জানান, এসএনসিইউয়ের কাজ মানে ২৪ ঘণ্টা অসুস্থ শিশুদের অবস্থার প্রতি নজর রাখা। সদ্যোজাতদের অবস্থা এক বার খারাপ হতে শুরু করলে তারা খুব কম সময় দেয়। দ্রুত যন্ত্র চালু করতে হয়, ব্যবস্থা নিতে হয়। একটু দেরি হলে বা গা এলিয়ে ফেললেই বিপদ। অনেক চিকিৎসক এই দায়িত্বটাই নিতে পারছেন না বলে বেশি অসুস্থ শিশুদের নানা অছিলায় এসএনসিইউয়ে ভর্তি করতে চাইছেন না। তাঁরা ভাবছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে হেতু নিজে এসএনসিইউ নিয়ে আগ্রহী, তাই সেখানে কাজে কোনও গোলমাল হলে জল অনেক দূর গড়াবে।
টাস্ক ফোর্সের পরিদর্শনে এই চিত্র উঠে আসার পর এসএনসিইউগুলির অবস্থা কি বদলেছে? কী বলছেন সেখানকার কর্তারা?
মালদহ এসএনসিইউ ঘুরে দেখা গিয়েছে, সেখানে ১৫টি শয্যার জন্য পর্যাপ্ত পাল্স অক্সিমিটার ও রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার এখনও নেই। গত ১৫ ডিসেম্বর সেখানকার অটোক্লেভ মেশিনটি ফেটে যায়। এখনও ঠিক হয়নি। অন্য ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে আনা হচ্ছে। দরকার ৩০ জন নার্স। সেখানে রয়েছে ৮ জন। সুপার হিমাদ্রী আড়ির কথায়, “পরিকাঠামোর এতটা ঘাটতি আছে বলেই হয়তো ডাক্তারেরা গুরুতর অসুস্থ সদ্যোজাতদের এসএনসিইউয়ে চিকিৎসা করতে ভয় পেয়েছেন। তবে টাস্ক ফোর্সের অভিযোগ পেয়ে আমরা শিশুদের ভর্তির ব্যাপারে সতর্ক হয়েছি।”
অন্য দিকে, সিউড়ি এসএনসিইউয়ে শিশু ভর্তির ব্যাপারে অনিয়মের বিষয় কার্যত মেনে নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। জানিয়েছেন, সব সময় চিকিৎসকেরা ইচ্ছে করে এটা করছেন তা নয়, স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের চাপেও অনেক সময় গুরুতর অসুস্থের বদলে কম অসুস্থ শিশুকে এসএনসিইউয়ে ভর্তি করতে হচ্ছে। সুপার মানবেন্দ্র ঘোষ জানান, টাস্ক ফোর্স অভিযানের পরেই তিনি ও পেডিয়াট্রিক বিভাগের প্রধান ও এসএনসিইউয়ের প্রধানকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালে একসঙ্গে যদি ৫টি অসুস্থ সদ্যোজাত আসে, তবে শারীরিক অবস্থার নিরিখে কাকে এসএনসিইউয়ে ভর্তি করা হবে সেটা ওই কমিটিই ঠিক করবে। আবার এমআর বাঙুর হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেল নার্সের সংখ্যা এতটাই কম যে ৩৮টি শয্যায় গুরুতর অসুস্থদের সামলাতে হিমশিম অবস্থা হচ্ছে। অন্তত ৩০ জন নার্স দরকার, সেখানে রয়েছেন মাত্র ১৮ জন। প্রতি মুহূর্তে বিশেষ করে রাতে প্রতিটি শিশুর অবস্থার দিকে টানা নজর দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, নার্স না বাড়ালে অবস্থার উন্নতি হবে না।
|