মঞ্চ তাঁকে অন্য কিছু প্রশ্নের সামনে এনে দিল। প্রশ্ন, না বিস্ময়!
সৃষ্টির বিস্ময়! সেই বিস্ময়ে মগ্ন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। লিখছেন শোভন তরফদার |
এক দিন, একটা বাঁকের মুখে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পাহাড়ি পথে যেমন থাকে, রাস্তাটা এগোতে এগোতে হঠাৎ আবছায়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল, আসলে অবশ্য গেল না, কারণ বাঁক নিয়ে সেটা অন্য দিকে মোড় নিল। সেই দিক-বদলের মুহূর্তে পিছনে ধূসর, নীলচে শূন্যতা, যেন পটে আঁকা দিগন্ত, আর রাস্তা এগিয়েছে কোথায়, জানা নেই। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা।
তিনি খুব উদাস হয়ে সেই দিগন্তের দিকে চেয়ে গুনগুন করতেই পারতেন, এ পরবাসে রবে কে? করলেন না। তাঁর ঠোঁট নড়ছে যদিও, অস্ফুটে কিছু বলছেন তিনি।
কী বলছেন?
সংলাপ। নাটকের সংলাপ।
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
আজ, কলকাতায়, শুরু হচ্ছে তাঁর নতুন নাটক। ‘ছাড়ি গঙ্গা’। এক আত্মভোলা, কার্যত আত্মধ্বংসী এক বিজ্ঞানী, তাঁর কন্যা এবং এক বিশ্বস্ত পরিচারক এই তিনজনকে ঘিরেই কাহিনি। সেই বিজ্ঞানী আসলে ‘অ্যালকেমিস্ট’। দর্শন ও রসায়নের বিচিত্র গলিঘুঁজিতে তাঁর যাতায়াত। অ্যালকেমি কি শুধুই যে কোনও ধাতুকে সুবর্ণে পরিণত করার বিদ্যা? আদপেই নয়। তার মধ্যে আছে আরও অনেক প্রশ্ন। সেই
সব প্রশ্নই পীড়িত করে বিজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্র সিংহরায়কে। তিনি পৌঁছতে চান সৃষ্টির গভীরে। পৌঁছতে চান নিজস্ব অতীতে। কারণ, বর্তমান বলতে প্রায় কিছুই নেই।
‘আছে এক মজে-যাওয়া বিল। এক সময় নাকি গঙ্গার সঙ্গে যোগ ছিল, জোয়ারভাটা খেলত জলে। তার পর, সেই সুতোটা ছিঁড়ে গেল। বিল একা হয়ে পড়ল। নাম হল ‘ছাড়ি গঙ্গা’, বললেন সৌমিত্র।
তার পর?
‘তার পর সেই ছাড়িগঙ্গার ধারে নিজের পুরোনো ভিটেয় বসবাস শুরু করলেন সেই বিজ্ঞানী। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন এক সময়। সেই কাজ গেল। থেকে গেল গবেষণা। কী পেলেন জীবনভর সেই অনুসন্ধান থেকে? সম্পর্কের দাহ? সত্যের স্বরূপ?’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলতে বলতে আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকালেন, বললেন, জানো, আমার জন্মভিটে যেখানে, কৃষ্ণনগর, সেখানে সত্যিই এই নামে একটা বিল আছে। এখনও আছে। ছাড়ি গঙ্গা। এই বিজ্ঞানীর কথা মনে হতে সেই পুরোনো ছবিটাই ভেসে এল।’
মঞ্চের উপরে নিজের অতীতের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রবীণ অভিনেতা। কিংবদন্তি, অথচ গভীরে একটা অসহায়তা কাজ করে। স্মৃতি মাঝে মাঝে ছোবল দেয় ধূসর বিষের মতো। বিচ্ছিন্নতার কোনও বোধও কি খেলা করে রক্তে?
বললাম, এই নাটকও কি এক অর্থে ‘নাম জীবন’ নয়? এই নাটকের শিরোনাম যাই থাক, আসলে তা জীবন। ‘তৃতীয় অঙ্ক অতএব’-এ যেমন সরাসরি জীবনের দিকে তাকিয়েছিলেন, এখানে ততটা সরাসরি নয়, কিন্তু পিছনে কি ডালপালা মেলে নেই আপনারই কোনও ছায়া? তাই, এর নামও জীবন? আত্ম-জীবন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলতো হাসলেন। আর মাত্র কয়েকটি দিন পরেই আরও একটি জন্মদিন পেরোবেন তিনি। মাথার পিছনে চালচিত্রের মতো জেগে আছে দীর্ঘ কর্মজীবন। মঞ্চ, সিনেমা, বাচিক শিল্প...। তিনি বললেন, এই বিজ্ঞানী কীসের খোঁজ করে, জানো?
কীসের?
‘সৃষ্টির। সৃষ্টি রহস্যের। সে ঈশ্বরের মন বুঝতে চায়। সেটাই তার সিদ্ধির লক্ষ্য। আবার সেটাই তার সংকটও বটে। সে তলিয়ে যেতে চায় মহাশূন্যে। দেখতে চায়, ঈশ্বর ঠিক কতটা নির্জন! কতটা একাকী!’
এই সেই বাঁক, যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আশি বছরের দোরগোড়ায় এসে তবে বুঝি সৃষ্টিরহস্যের দিকে ফিরে তাকানোর সময় হল?
‘জানো, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবিনি কখনও, আজও ভাবি না, কিন্তু দার্শনিক দিক থেকে বিষয়টা আমাকে টানে। ‘ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়’, বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কী সেই বিস্ময়?’
এ রকম কথা কি এক দিন মনমোহন মিত্রও বলেননি? গৃহস্থ ঘরে সেই বিচিত্র ‘আগন্তুক’ মনমোহন, যিনি ‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ’ এই দু’টি চরণ গেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, নিজেকেই যেন বা, ‘কে দেবে আলো? কে দেবে প্রাণ?’ মনে রাখা ভাল, মনমোহন-এর ভূমিকায় উৎপল দত্তের ‘লিপ’-এ ছিল আগন্তুক-এরই স্রষ্টার কণ্ঠ। সত্যজিৎ রায়।
দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নিসর্গটি আবছায়া। সৌমিত্র বললেন, ঈশ্বরকণা নিয়ে খুব কথাবার্তা হচ্ছে। কে জানে, হয়তো এই ব্রহ্মাণ্ডটার আদিকাণ্ডও জানা যাবে এক দিন! কিন্তু, তারও আগে? আরও কত ব্রহ্মাণ্ড আছে! কী ছিল সেখানে? ‘কসমিক এগ’!’
বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ মৃদু হয়ে এল,
‘যেন মনে পড়ে
যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবনভ্রূণ মাঝে, লক্ষকোটি বর্ষ ধ’রে...’
বললাম, এর সঙ্গে অন্য একটা ভাবনাও কি আপনাকে স্পর্শ করছে না? ঈশ্বরের মন বুঝতে গিয়ে যদি শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিই নিজস্ব আত্মা? এই নাটকে বিজ্ঞানী জ্ঞানেন্দ্র সিংহরায় তো সেই নৈতিক সংকটের কথা বলেই ফেলে।
ঠিক, বললেন সৌমিত্র, জ্ঞানেন্দ্র সেই সংকটের মধ্যে দিয়ে যায়। রসায়নাগারে বিচিত্র পরীক্ষা চলছিল। পরিণামে তার জীবনে ঘনিয়ে আসে সর্বনাশ। সে একা হয়ে পড়ে। একেবারে একা। তখনই তার মনে এই প্রশ্নটা আসে। ঈশ্বরের নিঃসঙ্গতা ধরতে গিয়ে যদি মানবিক বোধগুলো হারিয়ে যায়! যদি খুলে যায় জীবনের, সম্পর্কের, সংরাগের নানা রকম টান! ঠিক যেন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা। ঝাঁপ দিলেই মহাশূন্য। না হলে একটার পর একটা পাকদণ্ডী...
জ্ঞানেন্দ্র সিংহরায় জানেন, সেই সব পাকদণ্ডীর বাঁকে বাঁকে ফিরে আসে স্মৃতি। কখনও বাঞ্ছিত স্মৃতি। কখনও অবাঞ্ছিত। পরিত্রাণ নেই। সৌমিত্রও জানেন নিশ্চয়ই।
কবে এক কবিতায় লিখেছিলেন,
‘শহর ঘুমাতে গেলে
মৃত মানুষেরা নাকি জেগে ওঠে
আমাকে জাগিয়ে রাখে
অথবা কি মৃত নয়
বিচ্ছিন্ন বিরহী তারা স্মৃতি হয়ে
তমসায় ডুবে আছে’!
সেই কথাই সত্য হয়ে উঠল এ বার, মঞ্চে।
আলো নয়। অন্ধকারের মুখোমুখি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই আঁধার যা মানুষকে মগ্ন ও চিন্তাশীল করে। আবার ঠেলেও দেয় বিপুল নিঃসঙ্গতার দিকে। কোন দিকে যাবেন বিজ্ঞানী? কোন দিকে এগোবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়? মঞ্চমায়া তাঁকে অন্য কিছু প্রশ্নের সামনে এনে দিল। জীবনের প্রশ্ন। তার এক দিকে মহাবিশ্ব। অন্য দিকে মনোগহন।
কোন দিকে এগোনো যায়, ভাবতে ভাবতে, আনমনে একটি বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ঠোঁট নড়ছে তাঁর। অস্ফুটে বলছেন কিছু।
সংলাপ। জীবনের সংলাপ। |