‘সভ্য’ মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী। সে অনায়াসে আপন ‘অ-সভ্য’ পূর্বপুরুষদের জন্তুজানোয়ারের সমগোত্রীয় বলিয়া গণ্য করিতে পারে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী আদিম জারোয়া জনজাতির মানুষরা তাই তাহার কাছে আপন জ্ঞাতিভ্রাতা নয়, পালকবিহীন কিছু দ্বিপদ মাত্র, চিড়িয়াখানার কিংবা সংরক্ষিত অরণ্যের মনুষ্যেতর চতুষ্পদদের মতোই দ্রষ্টব্য এক প্রজাতি বিশেষ। তাই তাহাদের কাছ হইতে ‘দেখিতে’, ছবি তুলিতে, খাবার বা নেশার সামগ্রীর লোভ দেখাইয়া নাচগান করাইতে এবং সেই দৃশ্য ভিডিয়ো ক্যামেরায় বন্দি করিতে পর্যটকদের এত ব্যগ্রতা। আন্দামানের জারোয়ারা এ ভাবেই উৎসুক পর্যটকদের দ্রষ্টব্য, যাহাদের অবাক চোখে দেখিবার সুযোগ দিতে ‘হিউম্যান সাফারি’র আয়োজন। জারোয়াদের পক্ষে, সংবেদনশীল মানবতার পক্ষেও চরম অবমাননাকর এই ঘটনা সম্প্রতি বিশ্বের গোচরে আসিয়াছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও পর্যটন সংস্থার যোগসাজশে কত কাল ধরিয়া এই ন্যক্কারজনক কাণ্ডটি চলিতেছে, বলা কঠিন।
জারোয়ারা সারা বিশ্বেই আদিমতম জনগোষ্ঠীগুলির অন্যতম। তথাকথিত সভ্যতার আলো ওই প্রত্যন্ত ও সমুদ্রঘেরা বিচ্ছিন্ন প্রদেশে না-পৌঁছনোর কারণে জারোয়ারা বহুলাংশে সেই আদিম জীবনেই থাকিয়া যায়। মানুষের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ও গবেষণায় তাই এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের তন্নিষ্ঠ অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ থাকিয়াছে। সভ্যতারই উপদংশ ক্ষতে জারোয়াদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাইতে থাকে। সরকার তাহাদের বসবাসের এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে, বহির্বিশ্বের সহিত সংস্রব কমাইতে ওই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সরকারি আধিকারিক ও পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু সভ্যতা এই ‘অসভ্য’দের স্বস্তিতে থাকিতে দিবে কেন? ঔপনিবেশিক যুগে কৃষ্ণ মহাদেশ আফ্রিকার অ-সভ্য, আদিম, বর্বর জনগোষ্ঠীগুলিকে সভ্য করিয়া তুলিতে শ্বেতাঙ্গরা ঈশ্বরনির্দিষ্ট যে দায় নিজেদের কাঁধে তুলিয়া লইয়াছিল, তাহারই অনুরূপে আন্দামানের নগ্ন এই জনগোষ্ঠীকে আধুনিক করিয়া তুলিতে কিছু নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী সভ্য লোকের প্রাণপণ প্রয়াস ক্রমে জারোয়া জনসংখ্যাই হ্রাস করিতে থাকে। এক্ষণে মাত্র শ’চারেক জারোয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ আন্দামানে অবশিষ্ট।
কিন্তু অ-সভ্য থাকারও বিপদ আছে। জারোয়ারা মানুষের মতোই দেখিতে, অথচ যেন পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয় এই সভ্যতাভিমান তাহাদের পর্যটকের দ্রষ্টব্য করিয়া তোলে। চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জিদের মতো তাহাদের দিকে সভ্যরা মিষ্টান্ন বা বিস্কুট ছুড়িয়া দেয়, বনজ ফলমূল, শিকড়বাকড় কিংবা পাখির মাংস হইতে যাহা ভিন্ন স্বাদের। শিম্পাঞ্জির মতোই তাহাদের হাত-পা ঘুরাইয়া নাচিতে হয়, যাহাতে পর্যটকরা ‘স্যুভেনির’ হিসাবে তাহাদের ছবি সভ্য পৃথিবীতে লইয়া প্রদর্শন করিতে পারে। ইহাতে যে মনুষ্যত্বেরই অপমান করা হইতেছে, ইহা উপলব্ধি করার মতো পরিশীলন পর্যটকদের অনেক সময়েই থাকে না। আন্দামানের ভিডিয়ো-চিত্রটি কতটা সাম্প্রতিক, তাহা লইয়া প্রশ্ন আছে। কিন্তু সভ্যতার অভিমান যে আজ অবধি কালজয়ী, তাহা লইয়া প্রশ্ন নাই। |