দামি জুতো পরা লোকটিকে আজও মনে আছে তাঁর
দিনটা ‘বিলকুল’ মনে আছে, শুক্রবার।
দু-হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে গড় গড় করে সাড়ে-চোদ্দো বছর পিছনে ফিরে যান মধ্য-পঞ্চাশের লোকটি। মহেন্দ্র রাজপুতিয়ার (নাম পরিবর্তিত) কাছে ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাইটা কত বার যে ফিরে এসেছে!
পুলিশের জেরায়, আদালতের কাঠগড়ায় কিংবা জেলা কর্তাদের ভাঁজ পড়া কপালের সামনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কত বার না দিনটা আপাদমস্তক আওড়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। আর রাত-বিরেতে, ফিরে পেয়েছেন পাল্টা শাসানিও, “ওই দিনটা ভুলে যাও!”
চোদ্দো বছর আগে সেই দুপুরে, সমাজকর্মী সঞ্জয় ঘোষকে নিয়ে আলফার কর্মীরা মাজুলির রবিচাপুরি এলাকায় গিয়েছিল যে নৌকায়, তার হাল তো ছিল মহেন্দ্রর হাতেই। গত নভেম্বরে সঞ্জয়-খুনের অন্যতম অভিযুক্ত পথিক হাতিপোতা ওরফে পঙ্কজ শইকিয়া গ্রেফতারের পরে একটু যেন স্বস্তি পেয়েছেন মহেন্দ্র। বলছেন, “রাতে কেউ নাম ধরে ডাকলেই ভয় লাগত। পথিকের লোকজন নয় তো!”
রাজস্থান থেকে ছত্তিশগঢ়, দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে আদিবাসী-উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯৬ সালে অসমের মাজুলি দ্বীপে এসেছিলেন সঞ্জয়। প্রত্যন্ত সেই দ্বীপে স্থানীয় মিশিং আদিবাসীদের উন্নয়নকল্পে কাজ করতে এসে সংগঠনের পক্ষে ‘দীপ-আলোক’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে শুরু করেন। প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে ঠিকাদারদের আঁতাঁত, সরকারি টাকার নয়ছয়, আলফার সন্ত্রাসসবই প্রকাশ্যে আনতে থাকেন তাঁর পত্রিকায়। সেই ‘অপরাধেই’ আলফার স্থানীয় নেতারা অপহরণ করে সঞ্জয়কে।

সঞ্জয় ঘোষ
সুবনসিঁড়ি নদীটা যেখানে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে, তার পাশেই মোরানজিয়া। মাজুলির প্রান্তিক সেই গ্রামে বসে মহেন্দ্র এখনও সেই ‘শুক্রবার’টা দাঁড়ি-কমা-সহ মনে করতে পারেন। তাঁর কথায়, “বিলকুল মনে আছে দিনটা।” এবড়ো-খেবড়ো বাঁধের গা ঘেঁষা বাড়িতে বসে তিনি বলেন, “ওরা পাঁচ জন ছিল। বাড়িতে এসে আমায় ডাকাডাকি করতে বেরিয়ে দেখি, দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে টুপিটা একটু নামিয়ে দাঁড়িয়ে পথিক হাতিপোতা। বলল, রবিচাপুরিয়া যেতে হবে। আমার নৌকা ঘাটে নেই শুনে ওরাই নৌকা ঠিক করল। নির্দেশ হল, হাল ধরতে হবে। এর পর নৌকায় উঠে এল ওরা। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াও একটা হাঁসুয়া আর বড় একটা বস্তা। চার জনই মুখ চেনা, পথিকের শাগরেদ। তবে এক জনকে চিনতে পারিনি। চেহারা দেখে বুঝেছিলাম এ আমাদের মাজুলিতে নতুন। পায়ের জুতোটা এখনও মনে আছে। বেশ দামি।” মহেন্দ্র জানান, সে দিন পথিকের নির্দেশেই নৌকা চলেছিল রবিচাপুরির দিকে। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি মাথায় করেই তাঁরা পৌঁছেছিলেন। মহেন্দ্রের কথায়, “বৃষ্টি আসায় চারদিক ঝাপসা। ভরা ব্রহ্মপুত্রে টানও ছিল। নৌকা জোরে টানতে না-পারায় দু-এক বার পথিকের কাছে ধমক খেয়েছিলাম।”
অসমের যোরহাটে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী-দ্বীপ মাজুলির আয়তন প্রায় ৪৮০ বর্গ কিলোমিটার। সেখানেই ছোট্ট জনপদ রবিচাপুরি। মহেন্দ্র বলেন, “সে দিন নৌকায় ওই দামি জুতো পরা লোকটি মাথা নিচু করেই বসে ছিলেন। তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। পথিককে ইংরাজিতে কী একটা জিজ্ঞেসও করলেন। বুঝতে পারিনি।” ‘গণ্ডগোল’ অনুমান করেছিলেন মহেন্দ্র। কিন্তু চোদ্দো বছর আগে মাজুলির ‘ত্রাস’ পথিক হাতিমোতাকে তা জিজ্ঞেস করার ‘সাহস’ হয়নি তাঁর।
কে এই পথিক? যোরহাট জেলা কংগ্রেসের এক তাবড় নেতা বলেন, “মাজুলিতে বাস করতে হলে স্থানীয় কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের পথিক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করেই চলতে হত সেই সময়ে।” পুলিশের খাতায় সঞ্জয় খুনের পর থেকেই নিখোঁজ ছিল পথিক। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকেই দ্বীপের আনাচেকানাচে ফের ভেসে ওঠে সে। চাষবাসও শুরু করেছিল। গত ২৫ নভেম্বর মাজুলির বনগাঁও এলাকা থেকে অবশেষে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
আপাতত পথিক গুয়াহাটি সেন্ট্রাল জেলে। সিবিআইয়ের ক্রাইম ব্রাঞ্চের এক কর্তা বলেন, “জেরায় পথিক জানিয়েছে, ১৯৯৭-এর ৪ জুলাই কমলাবাড়ি থেকে সংগঠনের কর্মী চরিদান দৌলইয়ের সঙ্গে সাইকেলে সেলিনিগাঁও এলাকায় একটি ছাগল প্রতিপালন কেন্দ্রে গিয়েছিলেন সঞ্জয়। সেখানেই তাঁকে অপহরণ করে পথিক। তার পর দ্বীপে ঘুরিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মোরানজিয়ায়।’’ যোরহাট জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “সঞ্জয় ঘোষ খুনে মূল অভিযুক্ত অরবিন্দ রাজখোয়া। তবে কাজটা কিন্তু সেরেছিল পথিকই।”
আর পড়ন্ত বিকেলে মহেন্দ্রও বলছেন, “সে রাতে রবিচাপুরির দিকে থেকে গুলির আওয়াজ পেলাম। পর দিন, ওদের আনতে গিয়ে দেখি, দামি জুতো পরা লোকটা নেই। জিজ্ঞেস করায় ওরা বলেছিল, সে শিবসাগর চলে গিয়েছে।”
মহেন্দ্র কি জানতেন, সঞ্জয় ঘোষের দেহ তখন ঘুরপাক খাচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.