ঘড়িতে তখন রাত একটা। প্রায় কুড়ি মাস পর ফের ঝাড়গ্রাম স্টেশনে পৌঁছল রাতের ট্রেন। শীতের রাতে প্ল্যাটফর্ম অবশ্য শুনশান। ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন সশস্ত্র রক্ষীরা। এ দিক-সে দিক নজরদারি চলল কয়েক মিনিট। ফের তাঁরা ট্রেনে উঠতেই রাঁচির উদ্দেশে রওনা দিল হাওড়া-রাঁচি হাতিয়া এক্সপ্রেস। ভয় কাটিয়ে জঙ্গলপথে খড়্গপুর-টাটানগর লাইনে ফের ট্রেন ছুটল শুক্রবার থেকে।
তবে রাতের এই ট্রেনে যাত্রী ছিলেন হাতে গোনা। যেহেতু দীর্ঘ ব্যবধানে জঙ্গলপথে রাতে ট্রেন চলল, তাই যাত্রী বাড়তে আর একটু সময় লাগবে বলেই মনে করছে রেল। রাতের ট্রেনের সময়সূচির সঙ্গে ফের যাত্রীদের সড়গড় করতে শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকেই অবশ্য খড়্গপুর স্টেশনে নিয়মিত ঘোষণা হয়েছে, ‘১৮৬১৫ আপ হাওড়া-রাঁচি হাতিয়া এক্সপ্রেস নির্দিষ্ট সময় ধরেই চলছে। ঠিক সময়ে হাওড়া থেকে ছেড়ে আসছে’। ১২টা ৫-এ খড়্গপুরে পৌঁছনোর কথা ছিল ট্রেনটির। পৌঁছল মিনিট পাঁচেক ‘লেটে’। খড়্গপুর থেকেও যাত্রী উঠলেন মাত্র কয়েক জন। তার চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যায় উঠলেন সশস্ত্র রক্ষীরা। বিভিন্ন কামরায় ছড়িয়ে পড়লেন তাঁরা। খড়্গপুরের পর থেকেই যে জঙ্গলপথ। |
উদ্বেগ নেই। জঙ্গলপথে রাতের ট্রেনে যাত্রীরা। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি। |
যাত্রীরা অবশ্য নিরুদ্বিগ্ন। অনেকেই কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। কয়েক জন জেগে, তাস খেলছেন। কেউ আবার মোবাইলে গানও শুনছিলেন। বছর চব্বিশের সুনীল ওঁরাও তখনও জেগে। হাওড়া থেকে ট্রেন ধরেছেন। থাকেন উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটিতে। দেশের বাড়ি রাঁচি যাচ্ছেন। জঙ্গলপথে রাতের ট্রেনযাত্রায় কোনও অস্বস্তি হচ্ছে কি? সুনীলের পাল্টা প্রশ্ন, “আতঙ্কের কী আছে! পরিস্থিতি তো এখন স্বাভাবিক। জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনা মর্মান্তিক। তবে ট্রেনে উঠলে এমন ঘটনার কথা মনেই আনি না।” সুনীল বরং খুশি, ঘুরপথে বেশি সময়ে রাঁচি পৌঁছনোর কষ্ট লাঘব হওয়ায়। বলেন, “টাটা লাইনে ট্রেন বন্ধ থাকায় সমস্যা হচ্ছিল। দেড় মাস অন্তর দেশের বাড়ি যাই। এত দিন ঘুরপথে ট্রেন চলেছে। এখন সকাল সাড়ে ছ’টায় রাঁচি পৌঁছে যাব। ঘুরপথে পৌঁছতাম বেলা সাড়ে ১২ টায়।”
যাতায়াতের এই সুবিধার কাছে তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে ভয়। সুনীলদের সদর্থক মনোভাবের কাছে নতজানু হচ্ছে তাবৎ আশঙ্কা। রাতে ফের ট্রেন চালু হওয়ায় খুশি টাটানগরের বাসিন্দারাও। মনীশ সিংহ, অর্জুন ঠাকুর, কুলদীপ সিংহ বলেন, “টাটা থেকে আমরা অনেকেই নানা কাজে হামেশাই খড়্গপুর বা হাওড়ায় যাই। রাতে ট্রেন চালু থাকলে দিনে কাজ সেরে রাতেই ফিরে আসতে পারি।”
যাত্রীদের এই মনোভাবকে কুর্নিশ করছেন রেলকর্তারা। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের খড়্গপুরের ডিআরএম রাজীব কুমার কুলশ্রেষ্ঠ’র কথায়, “যাত্রী সংখ্যা পরে আরও বাড়বে।” খড়্গপুরের রেল-পুলিশ সুপার শঙ্কর চক্রবর্তী, আরপিএফের ওসি (খড়্গপুর) উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বস্ত করছেন, “যাত্রী সুরক্ষার দিকে সব সময়েই নজর থাকে। জঙ্গলমহলে রাতের ট্রেনগুলোয় পর্যাপ্ত রক্ষী থাকবেন। যাত্রীদের সমস্যা হবে না।”
ভয় জয় করা যাত্রায় ঝাড়গ্রামের আগে বাঁশতলা, সর্ডিহার কাছে ট্রেন পৌঁছতে রক্ষীদের মধ্যে অবশ্য দেখা গেল বাড়তি সতর্কতা। সেই বাঁশতলা, ২০০৯-এর ২৭ অক্টোবর জনগণের কমিটি রাজধানী এক্সপ্রেস আটকে রেখেছিল ৫ ঘণ্টা। আর সর্ডিহা-খেমাশুলির মাঝে রাজাবাঁধে ২০১০-এর ২৭ মে রাতে ঘটে গিয়েছিল জ্ঞানেশ্বরী-নাশকতা। তার পর থেকেই রাতের জঙ্গলপথে বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচল। কিছু দিন আগে আদ্রা শাখায় ফের রাতের ট্রেন চালু হয়েছে। আর শুক্রবার চলল টাটানগর শাখায়। রাতে মাঝেমধ্যে ট্রেন থেকে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে নিতে দেখা গেল রক্ষীদের। ঝাড়গ্রাম পৌঁছতে প্ল্যাটফর্মে নেমে চারপাশে নজরদারিও চালালেন। এ সবই অবশ্য ‘রুটিন’ বলেই দাবি রেলকর্তাদের। ট্রেনেই যা নিরাপত্তা রক্ষীর বন্দোবস্ত। পাইলট ইঞ্জিন চালানোর দরকার হয়নি। ঝাড়গ্রাম ছেড়ে ট্রেন দিব্যি এগিয়ে চলল গিধনি, ঘাটশিলা, চাকুলিয়া পেরিয়ে। টাটানগর পৌঁছল তিনটের সামান্য আগে।
হাওড়া-রাঁচি হাতিয়া এক্সপ্রেসের আগে রাত পৌনে ন’টায় খড়্গপুর থেকে ছেড়ে গিয়েছিল টাটানগর লোকালও। যাত্রী কম। তবে ফের যাত্রা শুরুর সাফল্যটাকেই বড় করে দেখছেন রেলকর্তা থেকে শুরু করে আমজনতা। |