স্রেফ মানসিকতার তফাতে কী ভাবে ‘ব্যতিক্রমী’ হয়ে ওঠা যায়, তার দৃষ্টান্ত গড়ে দিয়েছে এ রাজ্যেরই সরকার নিয়ন্ত্রিত এক প্রতিষ্ঠান।
দক্ষতার অভাব ও লোকসানের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অধিকাংশ নিগম যেখানে ধুঁকছে, সেখানে বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে রীতিমতো টক্কর দিচ্ছেন হরিণঘাটার ওই সরকারি মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানার কর্মীরা। বাঙালির হেঁসেলে ধীর পায়ে ঢুকছে যে বেকন-সসেজ-সালামি, এখানে তা তৈরি হচ্ছে। পার্ক স্ট্রিটের বেশ কিছু রেঁস্তোরা, শহরের পাঁচতারা হোটেল, এমনকী মুম্বইয়ের তাজ হোটেলেও যাচ্ছে হরিণঘাটার বেকন।
সেই ১৯৬৫ সাল ইস্তক হরিণঘাটার এই সরকারি কারখানায় বেকন-সসেজ-সালামি তৈরি হচ্ছে। ২০০৬-এ রাজ্য সরকারের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থেকে বার করে ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের অধীনে আনা হয় কারখানাটিকে। অন্য অনেক সরকারি সংস্থার সঙ্গে এদের ফারাকটা কোথায়?
নমুনা মিলল কারখানায় পৌঁছে। জানা গেল, অন্য এক ইউনিটের এক কর্মী মারা গিয়েছেন। সরকারি নিয়মমতো সঙ্গে সঙ্গে অর্ধদিবস ছুটি ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এখানে কাজ করে যাচ্ছেন শঙ্কর ঘোষ, বাইজু মুর্মুরা। শঙ্করবাবুর মন্তব্য, “মৃতের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা তো কাজ করার ফাঁকেও জানানো যায়!” বিকেল তিনটে বেজে গেলেও টিফিন খাওয়ার সময় পাননি বাইজু। বললেন, “হাতের কাজটা শেষ করে খাব। এ ভাবেই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।”
|
হরিণঘাটায় মাংস প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র। ছবি: বিতান ভট্টাচার্য |
নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতা বছরের পর বছর ধরে হরিণঘাটার কারখানায় তৈরি শুয়োরের মাংসের সসেজ-সালামি কিনে আসছেন। মাংসও বিক্রি হয়। কিছু ব্যবসায়ী নিয়মিত সসেজ-সালামি কিনে সরবরাহ করেন হোটেল-রেস্তোরাঁয়। এখানে উৎপাদিত শুয়োর-মুরগির মাংসের ন’টি খাদ্যপণ্য বিক্রি হয় নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং, যোধপুর পার্ক, সল্টলেকের ১৬ নম্বর ট্যাঙ্কের অফিস-সহ কলকাতায় বেশ ক’টি কাউন্টার থেকে। মাংস, সসেজ, বেকন, সালামি ছাড়াও পাওয়া যায় নাগেট, লোফ, কিমা। তালিকায় আছে টার্কির মাংসও।
ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ডিরেক্টর জয়ন্ত চৌধুরী জানান, ১৯৬৫ সালে দেশের নানা প্রান্তে ১৩টি বেকন ফ্যক্টরি তৈরি হয়েছিল। প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু হরিণঘাটার কারখানা চলছে। কিন্তু শপিং-মল থেকে পাড়ার মুদিখানা অধিকাংশ জায়গায় যে সসেজ-সালামি বিক্রি হয় সেগুলো তো বহুজাতিক সংস্থার তৈরি! হরিণঘাটার উৎপাদন কেন সেখানে পাওয়া যায় না? জয়ন্তবাবুর ব্যাখ্যা, গত ক’বছরে বাজারে সসেজ-সালামি’র চাহিদা অনেকটা বাড়লেও সেই অনুপাতে এখানে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। কারখানাটি তাঁদের নিগমের অধীনে আসার পরে রাষ্ট্রীয় কৃষিবিকাশ যোজনা থেকে ৫০ লক্ষ টাকা মিলেছে। তার পরে শুরু হয়েছে মুরগির মাংসের বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন। জয়ন্তবাবুর কথায়, “আরও টাকা আসছে। আরও নতুন যন্ত্র বসানো হবে।” এবং তখন হরিণঘাটার সসেজ-সালামির বিক্রি ছড়িয়ে দেওয়া যাবে বলে কর্তৃপক্ষের আশা।
তবে সমস্যাও আছে। জয়ন্তবাবু জানান, এই কারখানায় শুধু ‘লার্জ হোয়াইট ইয়র্কশায়ার পিগ’ বা সাদা শুয়োর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তার জোগান যথেষ্ট নয়। তাই শুধু হরিণঘাটার খামারের ভরসায় না-থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দিয়েও শূকরচাষ করানোর পরিকল্পনা হচ্ছে। উপরন্তু অভাব রয়েছে কর্মীরও। লোক নেওয়ার জন্য সরকারকে আর্জি জানানো হয়েছে। জয়ন্তবাবুর বলেন, “এখন যা উৎপাদন, তাতে কারখানা না-লাভ, না-লোকসানে চলছে। নতুন কর্মীরা এলে আশা করি লাভের মুখ দেখা যাবে।”
|