অনেকেই সবে মনে করতে শুরু করেছিলেন, আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে ইউরোপ। কিন্তু সেই ধারণায় ধাক্কা দিল ইউরোপীয় দেশগুলির ঋণ ফেরত দেওয়ার ঝুঁকি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স (এসঅ্যান্ডপি)-এর মূল্যায়ন। শুক্রবার গভীর রাতে ফ্রান্স, ইতালি-সহ মোট ন’টি ইউরোপীয় দেশের ‘ক্রেডিট রেটিং’ এক থেকে দু’ধাপ কমিয়ে দিয়েছে এই মার্কিন মূল্যায়ন বহুজাতিক। যার জেরে সর্বোচ্চ ‘এএএ’ (ট্রিপল এ) রেটিং খুইয়েছে ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া। গত অগস্টেই এই তকমা হাতছাড়া হয়েছিল আমেরিকার। তবে আশার কথা, আপাতত এই রেটিং অক্ষত থাকল জার্মানির।
এসঅ্যান্ডপি-র যুক্তি, মন্দার খাদ থেকে তুলে এনে অর্থনীতিকে ফের চাঙ্গা করতে যে ভাবে দ্রুত সদর্থক পদক্ষেপ প্রয়োজন, তা করতে ব্যর্থ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সরকার। বিশেষত ওই ন’টি দেশ। ফলে আগামী দিনে আরও বড় আর্থিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা। সেই কথা মাথায় রেখেই রেটিং ছাঁটাইয়ের এই সিদ্ধান্ত।
প্রত্যাশিত ভাবেই এর তুমুল সমালোচনা করেছে ইউরোপ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউরোপের ১৭টি দেশের জোট)-এর অর্থনীতি বিষয়ক কমিশনার ওলি রেন-এর অভিযোগ, “সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ইউরোপ যখন নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন এই ঘোষণা দুর্ভাগ্যজনক।” অর্থনীতিকে ছন্দে ফেরাতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে বলে তাঁর দাবি। ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ফ্রাঁকোয়া ব্যারোঁর প্রতিক্রিয়া, “অবশ্যই দুঃসংবাদ। কিন্তু ধ্বংস করে দেওয়ার মতো নয়।” আর নিজেদের রেটিংয়ে হাত না-পড়লেও জার্মান অর্থমন্ত্রী উল্ফগ্যাং শেব্লের অভিমত, “গত কয়েক মাসে আমরা বুঝেছি যে, এ ধরনের রেটিংকে প্রয়োজনের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া অর্থহীন।”
অর্থনৈতিক ভাবে গত তিন বছর ধরেই গভীর সমস্যায় ইউরোপ। তার উপর গত মাসেই এই মূল্যায়ন কমানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিল এস অ্যান্ড পি। ফলে এই ঘোষণা প্রত্যাশিত। নতুন করে আতঙ্কিত হওয়ার মশলা এতে নেই। কিন্তু অনেকেরই আশঙ্কা, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি কিংবা বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজার যে রকম অনাস্থা এবং অনিশ্চয়তায় ভুগছে, এই ঘোষণায় তা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
|
ক্রেডিট রেটিং কী? |
কোনও দেশ (বা সংস্থা)-কে ঋণ দেওয়া কতটা ঝুঁকির, তারই মূল্যায়ন ক্রেডিট রেটিং। অর্থাৎ, রেটিং যত ভাল, ঋণ দেওয়া তত কম ঝুঁকির। আর তা কমার মানে ঋণের অর্থ ফেরত না-পাওয়ার ঝুঁকি বাড়া। তাই রেটিং কমলে সাধারণত বেশি সুদ গুনতে হওয়ার সম্ভাবনা। |
|
|
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও দেশের রেটিং ‘এএএ’ থেকে এক ধাপ কমে ‘এএ+’ হওয়ার মানে এই নয় যে, তার কাছ থেকে টাকা ফেরত না পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল। বরং সেই তারতম্য অতি সামান্য। কিন্তু এই ঝুঁকির দাম হিসেবেই সুদ নির্ধারণ করে বাজার। সুতরাং, কোনও দেশের রেটিং যত ভাল, তার পক্ষে কম সুদে ঋণপত্র (বন্ড) বেচে টাকা পাওয়া ততটাই সুবিধার। ঝুঁকি বাড়লে, তাল মিলিয়ে বাড়বে সুদের হারও।
আর ঠিক এই জায়গাতেই আশঙ্কার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁদের মতে, এর ফলে ওই ইউরোপীয় দেশগুলির ঋণ নেওয়ার খরচ আরও বাড়বে। যা দেনার দায়ে ডুবে থাকা ইউরো জোনের কাছে সুসংবাদ নয়। তা ছাড়া, মন্দার পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিকে কাবু করে রেখেছে আস্থার অভাব। ঋণ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়লে সেই অনাস্থা আরও প্রকট হবে বলেও তাঁদের অভিমত। একই সঙ্গে তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, এ ক্ষেত্রে আমেরিকার মতো অভিজ্ঞতা না-ও হতে পারে ইউরোপীয় দেশগুলির। রেটিং কমার পরেও কম সুদে বন্ড বেচেছে আমেরিকা। সম্প্রতি বন্ড নিলামে সাফল্য পেয়েছে রেটিংয়ে নীচে থাকা স্পেন এবং ইতালিও। কিন্তু এক লপ্তে এতগুলি দেশের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়লে, এর পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অবশ্য উল্টো মতও রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, অর্থনীতি ও শেয়ার বাজারের উপর এই ঘোষণার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তবে তা হবে সাময়িক। ইউরোপের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হলেই ফিরবে আস্থা। একই সঙ্গে, ইউরোপের অন্যতম প্রধান আর্থিক শক্তি জার্মানি সম্পর্কে এস অ্যান্ড পি-র তুলনায় ভাল মূল্যায়ন এবং ধীরে হলেও মার্কিন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর উপরেও আস্থা রাখছেন তাঁরা।
তবে অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপীয় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাকে এ দিন ফের প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গ্রিস নিয়ে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার হতাশা। গ্রিসের দেউলিয়া ঘোষণা রুখতে তার ঋণের ৫০ শতাংশ মকুব করার শর্ত নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। তা ছাড়া, ওই সব শর্তের উপর নির্ভর করছে তাদের ত্রাণ প্রকল্পের পরবর্তী কিস্তি পাওয়াও। কিন্তু বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে গ্রিস-সরকারের ওই আলোচনায় এখনও মতানৈক্য রয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, আগামী দিনে এই ক্ষেত্রে ঐকমত্যের সন্ধান না-মিললে, ২০০৮ সালের মন্দার দিন ফের ফিরে আসার সম্ভাবনা। কারণ, গ্রিস এক বার দেউলিয়া ঘোষণায় বাধ্য হলে, পথে বসবে বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষত সেই সব ব্যাঙ্ক, যারা তাকে ঋণ দিয়েছে। সেই সঙ্গে ডুববে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানও, যেখানে ওই ঋণ বিমা করে রেখেছে ব্যাঙ্কগুলি। অবশ্য সমস্যা শীঘ্রই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে বলে এ দিনও দাবি করেছে গ্রিস।
এস অ্যান্ড পি-র মতে, ইউরোপের অর্থনীতি যে গভীর সঙ্কটে রয়েছে, তাতে শুধু ব্যয় সঙ্কোচের দাওয়াইয়ে চিঁড়ে ভিজবে না। কারণ, দুনিয়া জুড়ে এই আর্থিক টালমাটালের জেরে চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। ফলে কমছে ব্যয়ের প্রবণতা। কমছে আয়ও। কর্পোরেট দুনিয়ার বেচা-কেনা ভাল না-হওয়ায়, কর আদায়ের লক্ষ্য ছুঁতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশের সরকার। অর্থনীতিকে ছন্দে ফেরাতে এই পুরো সমস্যাটিরই সমাধান জরুরি বলে মনে করে তারা।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মার্কিন মুলুক থেকে বহু দূরে কলকাতার এক আলোচনা সভায় এ দিন একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রসঙ্গে এই একই কথা বলে গেলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ। তাঁর মতে, “আর সব ছেড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার শুধু ব্যয় কমানোর নীতি আঁকড়ে পড়ে থাকলে, আরও গভীর সঙ্কটে তলিয়ে যাবে বিশ্ব অর্থনীতি। বরং তার থেকে সরকার যদি পরিকাঠামো, গবেষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, তা হলে গতি পাবে অর্থনীতির চাকা।” সমস্যার সমাধানে আর্থিক বৈষম্য ঘোচানোর বিষয়ে প্রতিটি দেশকে মনোযোগী হতে হবে বলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি। |