|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প
পাঠক প্রতিযোগিতা:
‘পরিবর্তন’-এর গল্প,
আজ তৃতীয় সূত্রের গল্প |
আলোকবৃত্তের আড়ালে |
বিদ্যুৎ গঙ্গোপাধ্যায় |
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল ঋষি। মেয়েটা একেবারে সামনে। ক্রসিংয়ের লাল লাইটে গান বাজছে, ‘যদি তারে নাই চিনি গো...’। অন্যমনস্ক মেয়েটি চাকার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে রূঢ় দৃষ্টি হেনে রাস্তা ক্রস করে শরৎ বোস রোডের দিকে এগোল। ডেনিম-টপের ছিপছিপে তনুখানি পেন্সিল হিলের ছন্দে দোলায়িত তরঙ্গে এগিয়ে গেল। সে-দিকে নিষ্পলক চোখ দু’টি মুভি ক্যামেরার মতো ঘুরিয়ে এনে, ফিচেল হাস্যে পাশ থেকে সৌভিক বলল, ঋষিদা, কেমন তাকাল দেখলে! যতই রবীন্দ্রনাথ শোনো, এ মেয়ে লাবণ্য নয়। এ হল কিটি। এক বার লাগলে না...।
সৌভিক ঋষির পুরনো পাড়ার ছেলে। এখনও বাড়িতে যাতায়াত আছে। ঋষির চেয়ে ছোট হলেও সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। তবু এই মুহূর্তে ওর এই রসিকতায় উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ঠাট্টা করিস না তো। ওই গানটা কানে ঢুকেই তো এই বিপত্তি। রাবীন্দ্রনাথকে এ ভাবে ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কাদের জন্যে এই গান? গাড়িচালক, নাকি পথচারী! দুটো ক্ষেত্রেই কিন্তু ও দিকে মন দিলে অ্যাকসিডেন্ট অবধারিত। এটা স্রেফ রবীন্দ্রনাথকে অনুষঙ্গ করে নিজেদের রবীন্দ্রিকমনস্কতার বিজ্ঞাপন।
সৌভিক সিরিয়াস। বলল, তোমার বাকি কথাগুলো নিয়ে তর্ক চালাতে পারি। কিন্তু প্রথমটা মেনে নিতে পারছি না। এত দিন তো রবীন্দ্রনাথ প্রায় ব্রাত্যই হয়ে ছিলেন।
ব্রাত্য হয়ে ছিলেন কি না আজও সেটা তর্কসাপেক্ষ। তা বলে এমন বিজ্ঞাপিত আদেখলেপনাটাও বাড়াবাড়ি। সে-দিন অফিসে কে যেন বলেছিল, ‘আগের সরকারের আমলে বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ চুরি গিয়েছে। এ বার গোটা রবীন্দ্রনাথই না হারিয়ে যায়। গোটা ব্যাপারটা আমার পোটো পাড়ার শিল্পীদের মতো মনে হয়। পুজো ছাড়া ওখানে যদি অন্য সময় যাস, দেখবি, এক সাইজের অনেকগুলো মাথার ছাঁচ সার দিয়ে রাখা থাকে পথের ধারে। বাবরি চুলে সাজিয়ে সেগুলি কখনও ইন্দিরা গাঁধী, মাথা ন্যাড়া করিয়ে গোঁফ আর চশমা লাগিয়ে গাঁধীজি, গোঁফ বাদ দিয়ে সবুজ টুপি পরিয়ে নেতাজি সুভাষ নয়তো ইয়া লম্বা দাড়ি গোঁফ আর বাবরি লাগিয়ে কপালে কয়েকটা ভাঁজ এঁকে বছরে দু’বার রবীন্দ্রনাথ। ওদের কাছে ওই সব ক’টা আইকন এক। ঠিক তেমনি ওদেরকে অনুষঙ্গ করে নিজেদের কালচারালি প্রগতিশীল প্রমাণের বিজ্ঞাপন শুরু হয়েছে যেন।... |
|
সৌভিক ঋষির কথা শুনতে শুনতে যুক্তি সাজাল। বলল, যা-ই বলো ঋষিদা, গাড়ি চালিয়ে এসে এই যে সিগনালে আটকে গেলে। অযথা বোর না হয়ে দু’কলি রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে শুনলে। অথবা এই যে পথচলতি মানুষজন যারা এই সিগনালে আটকে পড়েছে, তারাও রবীন্দ্রনাথ শুনে পথের ক্লান্তি একটু ভুলতে পারে। এটার মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে। সেখানে তোমরা ওই, ‘...ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে দেওয়া...’ ঠিক মেনে নিতে পারলাম না।
ঋষি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, শোন, খেপিস না। একটু তলিয়ে বোঝ, গোটাটাই কেমন ‘প্রসাধনী পরিবর্তন’ বলে মনে হবে। কারণ, রবীন্দ্রনাথের গানের সিংহভাগ জুড়ে আছে পূজা, প্রেম, প্রকৃতি ইত্যাদি। বর্তমান বাজার-অর্থনীতির যুগে লাগামছাড়া জীবনে ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রত্যাশার পারদকে তুঙ্গে চড়িয়ে প্রতিটি মানুষ শুধু খাওয়া-পরা-থাকার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে ইঁদুর দৌড় দৌড়াচ্ছে, তার মধ্যে ব্যস্ত যানবাহনের রাস্তা পারাপারের সময় রবীন্দ্র গান শোনার অবকাশ থাকে কারও? তাই ভরা ভাদরে বসন্তের গান। লোক চলন্ত গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে দৌড়চ্ছে গন্তব্যে পৌঁছতে।
আড্ডার মুড নিয়েই ঋষি সৌভিককে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। থিতু হবে পার্ক স্ট্রিটের কোনও রেস্তোরাঁয়। তাই সেটাকে জমাতেই তর্ক জুড়ল সৌভিক। ‘ভালমন্দ যাহাই আসুক/সত্যরে লও সহজে...।’ সমাজজীবনে প্রতিটি মুহূর্তে কিছু না কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। ধরো এও এক পরিবর্তন। মেনে নিতে দোষ কী!
ঋষি যুক্তি দিল। ঠিক, কিন্তু যে কোনও পরিবর্তনই সমাজজীবনে আড়াই বা চার অক্ষরে নির্ধারিত হয়। ‘মনে’ নেওয়া আর ‘মেনে’ নেওয়া। আবার ওই পরিবর্তনকে বাস্তবে আমরা ‘মেনে’ নিই দু’ভাবে। হয় সহজ ভাবে নয়তো বাধ্য হয়ে। সহজ ভাবে মানার সংখ্যা অতি নগণ্য। বেশির ভাগকেই বাধ্য হয়ে মানতে হয়। যেমন আমরা মানছি। ইন্দ্রিয় সজাগ রবীন্দ্র গানের জন্যে নয়, কখন সিগনাল সবুজ হবে আর আমি সুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাব। আর পথচারী! লক্ষ করো দড়ি টপকে মাঝ রাস্তায় চলে গিয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। চান্স পেলেই দৌড় দেবে ওপারে। সুতরাং ওদের কাছেও এ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের গানের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে মনে হয়? একটু থেমে আবার শুরু করল। ধর, এখন যদি ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা...’ বাজত, তুই মুখ তুলে আকাশের বদলে পাবি ফ্লাইওভারের তলা। বাতাসের বদলে গাড়ির কালো ধোঁয়া। আর সবুজ প্রকৃতি! হাইরাইজ কংক্রিটের জঙ্গল। এখানে এর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে বল?
সৌভিক তখনও প্রতিবাদী। বলল, যা-ই বলো ঋষিদা, এই যে এ বছর বাইশে শ্রাবণ সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সারা দিন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজল, কত অনুষ্ঠান হল, এটা তো গত তিন সাড়ে তিন দশকে ভাবা যায়নি। এটাকে তোমরা...
ঋষি বাধা দিয়ে বলল, তুই থাম। মুশকিলটা তো ওইখানেই। আসলে আমরা পৌত্তলিকতা আর আনুষ্ঠানিকতায় বড্ড বিশ্বাস করি। রবীন্দ্র ভাবধারাকে কতটা গ্রহণ করেছি এবং তাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি, সে নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। স্রেফ ফুল-মালা-ধূপে রবীন্দ্র পুজো আর তার গান, কবিতা নিয়ে নিপাট একটা জলসা। যারা ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ আর ‘শিলা কি জওয়ানি’ নিয়ে বছরভর মেতে থাকে, তাকে জোর করে রাবীন্দ্রিক করা এবং রবীন্দ্রনাথ শুনতে ও শোনাতে বাধ্য করার কোনও মানে হয় না। থেমে, উত্তেজনায় একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘনঘন ক’টা টান মারল। তার পর মুচকি হেসে বলল, এই বাইশে শ্রাবণ আমাদের কায়স্থ পাড়ার ঘটনা বলি শোন সিগন্যাল সবুজ হওয়ায় পেছনের গাড়ি হর্ন বাজাতে শুরু করেছে। ঋষি দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করল। এইচ এইচ আই পার হয়ে এসে এক্সাইডে আবার আটকে পড়ল। এখানে আবার গান ‘...এত দিন যা সঙ্গোপনে ছিল তোমার মনে মনে...’।
সৌভিক গানের রেশ কানে নিয়েই জিজ্ঞাসা করল, তোমার পাড়ার বাইশে শ্রাবণের কী ঘটনা বলছিলে?
হ্যাঁ, বাইশে শ্রাবণ পালনের জন্য ‘বদল’পন্থী নেত্রীর কড়া নির্দেশ ছিল। কারণ, সার্ধশতবর্ষের জন্মদিনটা নির্বাচনী ব্যস্ততায় গেছে। অতএব মৃত্যুদিনকে ছাড়া নেই। আর শুধু তো অনুষ্ঠান করা নয়। তাকে জনমুখী ও অঞ্চলমুখী করতে অঞ্চলের লোকজনদের অংশগ্রহণ করাতে হবে। সুতরাং অঞ্চলের নেতা কয়েক জন ছেলেছোকরা নিয়ে বাড়ি বাড়ি নবীন শিল্পী সন্ধানে বেরিয়েছেন। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকেই করজোড়ে আহ্বান, আসুন নাম নথিভুক্ত করুন। তোর বউদিকে তো জানিস, চিত্রাকে এসে অনুরোধ করেছে ছেলেকে কিছু একটা করতে হবে। নেতার কথায় বিগলিত করুণা চিত্রা, রাজি হয়ে গেছে।
কিন্তু ছেলে করবেটা কী! এমনিতেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে বাংলা কবিতা গান কিছুই জানে না। ক্লাস সেভেনেই পড়ার বিশাল চাপ। তায় ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ চিত্রা ওকে সিন্থেসাইজার শেখাচ্ছে। যদিও সেটা অ আ ক খ লেভেলও নয়। অগত্যা আমার ওপর নির্দেশ জারি হল। বলল, আলমারিতে রবীন্দ্ররচনাবলি জমা করে রেখেছ, ওগুলো কবে কাজে আসবে শুনি? ছেলেকে একটা ভাল কবিতা সিলেক্ট করে, একটু গাইড করে দাও যাতে আবৃত্তি করতে পারে।
স্ত্রীর মান বাঁচাতে আমিও লেগে পড়লাম বারো বছরের ছেলেকে আবৃত্তিকার বানাতে।
প্রথমটা ভেবেছিলাম নিছক পাড়ার অনুষ্ঠান। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনের বড় রাস্তাটায় তো সারা বছরই কোনও না কোনও অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। উপুড় হয়ে বসে আঁকো, চিৎ হয়ে রক্ত দান। বার্ষিক পুজো, এ ছাড়া নানা মিটিং তো আছেই। কিন্তু এই বাইশে শ্রাবণ দেখলাম অন্য রকম ব্যাপার। একে তো সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। তার মধ্যেই বাহারি স্টেজ, আলো ও ফুলের মেলা। ব্যানার, ফ্লেক্সে ছয়লাপ। বৃষ্টি ও রৌদ্রকে আড়াল করতে বিশাল চাঁদোয়া। আর মাইক যেন অমায়িক। উদ্বোধক, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিদের মধ্যে নব বিধায়ক, বরো চেয়ারম্যান, পুর মাতাপিতাদের নাম ফ্লেক্সে জ্বলজ্বল করছে। আর অগণিত শিল্পীর তালিকা। ব্যানারে লিফলেটে। গান, নাচ, ভাষণ সবই আছে। আমি ধন্দে পড়লাম। ভাবলাম এ কী ‘অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নাকি রবীন্দ্রনাথের অনুষঙ্গে অনুষ্ঠান’! তবে মোদ্দা ব্যাপার বাইশে শ্রাবণ সেলিব্রেশন।যা-ই হোক, বেলা এগারোটা নাগাদ পুত্র রাজর্ষিকে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিয়ে তোর বউদি ছেলের নাম আবৃত্তিকার হিসেবে নথিভুক্ত করিয়ে দর্শকাসনে এসে বসল। সঙ্গে আমিও। অপেক্ষা শত শিল্পীর মাঝে কখন ছেলের ডাক আসবে।
মঞ্চে মালা-ফুল-চন্দনে লেপ্টে ধূপের সুগন্ধী ধোঁয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক কোণে। প্রথমেই বিধায়কের উদ্বোধনী ভাষণ। এর পর বিশেষ, মুখ্য ও প্রধান অতিথির সংক্ষিপ্ত রবীন্দ্র আলোচনা। তার পর শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। বড়, মেজ, ছোট সঙ্গীত শিল্পীদের কয়েক জনের সুকণ্ঠে, সুরে, বেসুরে এবং তালে ও বেতালে সঙ্গীত পরিবেশনের পর ডাক এল আমার ছেলের।
আবৃত্তি শেষ করে করতালি ধ্বনি শুনতে শুনতে সে যথারীতি ফিরে এসে আবার আমাদের পাশে বসল। সামনে পেছনের কয়েক জনের প্রশংসা শুনতে হল। ভাল, বেশ ভাল সুন্দর বলেছে ইত্যাদি। আমার পাশেই এক জন ভদ্রমহিলা বসেছেন। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে তদারকি করছেন। মহিলা নেত্রীটেত্রী হবেন হয়তো, ছেলে এসে পাশে বসতেই জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা দাদা, ও কি আবৃত্তি
শেখে কোথাও?
আমি বললাম, না, না শেখে না।
মহিলা চোখে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে বলল,
তা হলে?
আমি অবাক। বললাম, শিখতেই হবে? বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলি আছে। সেখান থেকে শিশু ভোলানাথের ‘ইচ্ছামতী নদী’ কবিতাটি সিলেক্ট করেছিলাম। ছোটদের ছন্দোবদ্ধ কবিতা মুখস্ত হতে সময় লাগে না। আমি অভিভাবক হিসেবে ভাবটা আর থ্রোয়িংটা একটু বুঝিয়ে দিয়েছি। এতে...
না, দাদা, আপনার কিন্তু ওকে একটু কোচিং দেওয়া উচিত। এত সুন্দর আবৃত্তি করে!
আমি হেসে বললাম, সুন্দরই যদি বলেন তা হলে আর নতুন করে শেখার কী আছে?
মহিলা নাছোড়। বলল, ঠাট্টা নয় দাদা। সিরিয়াসলি বলছি। আজকাল একটা কিছু এক্সট্রা থাকা খুব জরুরি। সেদিকটা একটু...
কী মুশকিল! আছেই তো। সিন্থেসাইজার শিখছে। কবিতা পড়ছে। এই তো আবৃত্তি করে ফেলল। সবই তো এক্সট্রা। আসলটা তো শরীরের চেয়ে বেশি ওজনের ব্যাগ পিঠে নিয়ে একগুচ্ছ সিলেবাস চিবিয়ে গিলে নম্বর বাড়ানোর প্রতিযোগিতা।
না, না, আমি বলতে চাইছি যে কারও কাছে না শিখলে হয় না। গলার মডিউলেশন, ঠিকঠাক টেকনিক, থ্রোয়িং না শিখলে উন্নতি হবে কী করে? একটা সার্টিফিকেটের দাম আজকাল অনেক।
আমি পাকা চোখে তোর বউদিকে দেখলাম। শুনল কি না। নয়তো আবার একটা কোচিংয়ের বোঝা ছেলেটার ঘাড়ে না চাপে। মনে মনে বললাম, হায় গো রবি ঠাকুর! এখানে তুমি ‘এক্সট্রা’র সার্টিফিকেট মাত্র। মুখে বললাম, ঠিকই বলেছেন। এক্সট্রার যোগ্যতা বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে।
ইতিমধ্যে ছোট ছোট মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন শুরু করেছে। ‘আমরা নতুন যৌবনের দূত...’ গানের সঙ্গে বেশ নাচল। ভাল লাগল কারণ ওদের প্রয়াসে ত্রুটি ছিল না। এর পর একটি মোটা মতো মেয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করতে বসল। এমন বেসুরো তার গলা যে, মনে মনে গুপী বাঘার সেই ‘এ বার ভেগে পড়ি কেটে পড়ি...’ বলতে বলতে চেয়ার ছাড়লাম। বেরোতে যাব, এক ভলেন্টিয়ার এসে বলল, দাদা, আপনাকে আর আপনার ছেলেকে বরো চেয়ারম্যান ডাকছেন। আমি ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক পাশে বসা এক মহিলার সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। ভলেন্টিয়ার ছেলেটি আমাদের হাজির করিয়ে বলল, দাদা, এই যে নিয়ে এসেছি।
চেয়ারম্যান ভদ্রলোক আমাদের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে সহাস্যে বললেন, আপনার ছেলে রাজর্ষি খুব সুন্দর আবৃত্তি করেছে। তার পর পাশে বসা মহিলার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওঁকে চেনেন তো, আমাদের পাশের কেন্দ্রের বিধায়ক বর্ণালী আঢ্য। ওঁর ওখানে কাল সকালে দশটায় অনুষ্ঠান। ওটা অবশ্য ওপেন নয়। জগবন্ধু হলে। তো আমার বরোর তরফ থেকে রাজর্ষির নামটি আবৃত্তিকার হিসেবে সিলেক্ট করে দিয়েছি। কাল সকালে ওকে নিয়ে চলে যাবেন কেমন!
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বিনীত ভাবে বললাম, কাল সকালে ওর স্কুল আছে। অনুষ্ঠানে যোগদান করা সম্ভব হবে না, বলে ফিরে আসতে উদ্যত হলাম।
আমার এমন নিরুৎসাহিত হওয়ার কারণে কি না জানি না, পাশ থেকে এক জন আফসোসের সুরে বলে উঠল, এমন সুযোগ হাতছাড়া করলেন! এমনি করেই কত সোর্স কত কানেকশনস তৈরি হয় আর আপনি...। না হয় এক দিন স্কুলে অ্যাবসেন্টই করত!
এ কথার ঠিক উত্তর দেওয়া মানে বিতর্ক। তাই কিছু না বলে বাড়ির দিকে এগোলাম। এ বার আর এক জন এসে পথ আগলালেন। ইনি কিছুক্ষণ আগে কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। একগাল হেসে বলল, খুব সুন্দর আবৃত্তি করেছে, দাদা। তার পর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই এ রকম দু’চারটে কবিতা মুখস্থ করে রাখবি। আমার তো অনেক কানেকশনস, দেখবি তোকে কত প্রোগ্রাম পাইয়ে দেব। আমার ছেলে জানি না বুঝে না না-বুঝে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। |
|
তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন, দাদা, কয়েকটা প্রোগ্রাম করলেই ও স্টেজ-ফ্রি হয়ে যাবে। তা ছাড়া আজকাল কত চ্যানেল, কত প্রোগ্রাম বাচ্চাদের নিয়ে। ও এক দিন দেখবেন...
আমি বাধা দিয়ে বলি হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু এটা কি খুব দরকার?
ভদ্রলোক অবাক। দরকার নয়!
আরে এ সব না করলে লাইম লাইটে আসবে কী করে?
দেখ সৌভিক, এখানেও রবীন্দ্রনাথ মুখ্য নয়। মুখ্য হল অনুষ্ঠান, লাইম লাইটে আসা। ভদ্রলোকের কথাটা শুনে আমি এক বার আমার ছেলের দিকে তাকালাম। মুহূর্তে আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ল। ছেলেবেলার সেই রবীন্দ্রজয়ন্তী। কবিতা গান ‘অমল ও দইওলা’ নাটক। ছোট ছোট মেয়েদের নৃত্য ‘আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়া...’। অনেক ভাল লাগা অনেক আনন্দের স্মৃতি। লাইম লাইটে আসার সুযোগ হয়নি ঠিক, কিন্তু সূচনা করে দিয়েছিল এক অসীম কৌতূহলের। যা পরবর্তী জীবনে বার বার প্ররোচিত করেছে জীবনের আনন্দ দুঃখে। বিরহে প্রেমে বিচ্ছেদে ও মিলনে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিতে। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প উপন্যাসে একান্তে অবগাহন করতে। এইটুকু যদি সঞ্চালিত করতে পারি আমার সন্তানের মধ্যে তা হলেই হবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সার্থক সার্ধশতবর্ষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। নাই বা এল আমার ছেলে লাইমলাইটে।
সিগনাল আবার সবুজ। ঋষি গাড়ি স্টার্ট করে থিয়েটার রোড ধরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে এগোল। স্টিয়ারিং হাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, সৌভিক, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আছেন থাকবেন। ভাবনায় অনুভবে, আমাদের নিত্য দুঃখজয়ের সংগ্রামে। একান্তে, আলোকবৃত্তের আড়ালে।...
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|