|
|
|
|
|
|
|
পরিব্রাজক |
সন্ন্যাসী মানে গেরুয়া পরা ভবঘুরে নয়। পায়ে পায়ে পথ চলে স্বামী বিবেকানন্দ খুঁজেছিলেন
তাঁর দেশের অন্তরাত্মাকে। দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
এ রকম ছন্নছাড়া ব্যাপার কখনও দেখেননি জগমোহনলাল। মাউন্ট আবুতে তাঁর বন্ধুর বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসেছেন।
সন্ন্যাসী পাহাড়ের গুহায় থাকতেন, তখন জগমোহনের বন্ধুর সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী ভাবে তাঁর সেবা করা যায়! সন্ন্যাসী বলেছিলেন, “বর্ষা তো এসে গেল। এ দিকে গুহায় কোনও দরজা নেই। ইচ্ছা হলে একজোড়া কপাট করে দিতে পারেন।” বন্ধু আর সন্ন্যাসীকে সেখানে থাকতে দেননি, বাড়িতে নিয়ে এসেছেন।
ইংরেজি-শিক্ষিত জগমোহন কোনও দিনই সন্ন্যাসীদের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাবান নন। তাঁর বন্ধুটি পেশায় আইনজীবী, ধর্মে মুসলমান। অতএব, মজা করেই এক দিন সেখানে গেলেন তিনি। দেখলেন, স্রেফ কৌপীন পরে বিছানায় শুয়ে আছেন সন্ন্যাসী।
জগমোহন নিজেকে সামলাতে পারলেন না, “আচ্ছা, আপনি হিন্দু সাধু হয়েও মুসলমানের বাড়িতে আছেন কী ভাবে? খাবারদাবারে তো ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যায়!” উত্তরে প্রায় জ্বলে উঠলেন গেরুয়াধারী, “শুনুন, আমি সন্ন্যাসী। আপনাদের সামাজিক বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে। আমি দেখি, সর্বত্র সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম।”
বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে জগমোহন প্রথমেই একটা কাজ করলেন। খেতড়ির রাজা অজিত সিংহকে জানালেন সন্ন্যাসীর কথা। জগমোহন রাজার ব্যক্তিগত সচিব। |
|
১৮৯১ সালের ৪ জুন মাউন্ট আবুর খেতড়ি প্রাসাদে অজিত সিংহের সঙ্গে সন্ন্যাসীর প্রথম দেখা। দু’জনের মধ্যে কথাবার্তাও হল। অজিত সিংহের প্রশ্ন ছিল, ‘জীবন মানে কী?’ সন্ন্যাসীর উত্তর, ‘প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও জীবের আত্মস্বরূপ প্রকাশের নামই জীবন।’ ভারতীয় ইতিহাসে সন্ন্যাসীর সঙ্গে নৃপতির এই রকম কথোপকথনের একটিই উদাহরণ আছে। গ্রিক রাজা মিনান্দারের সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের কথাবার্তা।
অজিত সিংহ এ বার সন্ন্যাসীকে তাঁর সঙ্গে খেতড়ি যেতে আমন্ত্রণ করলেন। সন্ন্যাসী রাজি। রাজপ্রাসাদে এই প্রথম বিবিদিষানন্দ! এর আগে, হিমালয় ছাড়া অন্যত্র তিনি বাঙালিদের কাছেই আশ্রয় নিয়েছেন। বারাণসীতে প্রমদাদাস মিত্র, গাজীপুরে রায়বাহাদুর গগনচন্দ্র মিত্র, নৈনিতালে বাবু রমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। রাজধানী কলকাতা থেকে দূরে এই ‘আপকান্ট্রি’ শহরগুলি ক্রমে প্রশাসন, ব্যবসাবাণিজ্যর কেন্দ্র হয়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে নতুন স্কুল, কলেজ, অফিস। ফলে, বাঙালির অভাব নেই। আর, রাজপুতানার রাজা? খেতড়ির রাজা অজিত সিংহই প্রথম নন। মাস কয়েক আগে আলোয়ারের রাজা মঙ্গল সিংহের সঙ্গেও সন্ন্যাসীর পরিচয় হয়েছিল। তবে রাজপ্রাসাদে নয়, সেখানে তিনি ছিলেন দেওয়ান মেজর রামচন্দ্রের বাড়িতে। |
কী কাজ? |
শেষ দিকে হৃষীকেশে মারাত্মক জ্বরে পড়েছিলেন বিবিদিষানন্দ। নাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, অজ্ঞান অবস্থা। সঙ্গী দুই গুরুভাইও কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। সে সময়েই এক সাধু হঠাৎ ঢুকে এলেন কুটিরে, মধু আর পিপুল গাছের ছাল গুঁড়ো করে খাওয়ালেন বিবিদিষানন্দকে। তার পরই উধাও তিনি!
আস্তে আস্তে চোখ খুলল, অস্ফুটে কিছু বলার চেষ্টা করলেন বিবিদিষানন্দ। কিছু দিন পরে সঙ্গীরা হৃষীকেশ থেকে নেমে হরিদ্বার, সাহারানপুর হয়ে মেরঠে নিয়ে এলেন তাঁকে।
দেড় মাস পর, মেরঠেই সঙ্গীদের ছেড়ে দিলেন তিনি। গুরুভাইদের বললেন, “আমার জীবনব্রত স্থির হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে একাই চলব। নইলে কাজে বিঘ্ন ঘটবে।”
কাজ! পাঁচ বছর আগের ঘটনা, অসুস্থ রামকৃষ্ণ তখন কাশীপুরের বাগানে। শিষ্য নরেন্দ্র চান নির্বিকল্প সমাধির অনুভূতি। রামকৃষ্ণ তাঁকে নিরস্ত করতে চাইলেন, “বেশ। আমি ভাল হই, তার পর তুই যা চাইবি, দেব।” নরেন্দ্র নাছোড়, “কিন্তু আপনি যদি আর ভাল না হন!” রামকৃষ্ণের স্বগতোক্তি, “শালা বলে কী!”
তার কয়েক দিন পরেই কাশীপুরের বাগানে ধ্যানশেষে নরেন্দ্র হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “গোপালদা, আমার শরীর কোথায়?” গোপালচন্দ্র ব্যস্ত হয়ে তাঁর কাঁধ, হাত টিপে দিচ্ছেন, “এই যে নরেন, এখানে।” তবু নরেন্দ্রর মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু নেই। তাঁর মাথার পিছনে এক জ্যোতি ক্রমশ আকাশ জুড়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দোতলার ঘরে রামকৃষ্ণের কাছে খবর গেল। তিনি মৃদু হাসলেন, “বেশ হয়েছে। থাকুক ওই ভাবে।
ওর জন্য আমাকে যা জ্বালাতন করে তুলছিল!”
রাত দেড়টার পরে নরেন্দ্র পা টিপে টিপে দোতলায় উঠলেন। তখনও শরীরে ঠিকঠাক সাড় নেই, পা টলছে। রামকৃষ্ণ বললেন, “কেমন, মা তো আজ তোকে সব দেখিয়ে দিলেন। চাবি কিন্তু আমার হাতে রইল। এখন তোকে কাজ করতে হবে। যখন কাজ শেষ হবে, আবার চাবি খুলব।” কাজটা ঠিক কী, রামকৃষ্ণ সে দিন বলেননি। এমনকী, বিবিদিষানন্দ যে দিন ‘কাজে বিঘ্ন ঘটবে’ বলে মেরঠে সঙ্গীদের ছেড়ে চলে এলেন, সে দিনও তিনিও জানেন না তাঁকে ঠিক কী করতে হবে! তার পরই ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে দিল্লি হয়ে আলোয়ার স্টেশনে নামলেন তিনি।
|
রাজার ছবি |
আলোয়ার স্টেশন থেকে একটু এগোলেই সরকারি ডিসপেন্সারি। সেই ভোরবেলায় সেখানে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সন্ন্যাসী বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে সাধুসন্ন্যাসীর থাকার জায়গা আছে?” ভদ্রলোক এখানকার ডাক্তার, নাম গুরুচরণ লস্কর। বাঙালি ডাক্তারের কানে এত দিন পরে বাংলা শব্দ!
গুরুচরণ থেকে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার শম্ভুনাথজির বাড়ি। ইংরেজি-শিক্ষিত সাধুর কথা তখন শহরের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনিতে আলোয়ার কিংবা খেতড়ি এমন কোনও বড় জায়গা নয়। যোধপুর বা জয়পুরের সঙ্গে তুলনা করলে এখানকার রাজারা নগণ্য জমিদারমাত্র! আলোয়ারের
রাজাকে তাঁর দেওয়ান খবর দিলেন, “এক সাধু এসেছেন। ইংরেজিতে খুব পণ্ডিত।”
দেওয়ানের বাড়িতে সাধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন রাজা মঙ্গল সিংহ। তার পরই সেই ঘটনা! ইংরেজি-শিক্ষিত রাজা জানালেন, মূর্তিপুজোয় তাঁর বিশ্বাস নেই। |
|
বিবিদিষানন্দ দেওয়াল থেকে রাজার ছবি নামিয়ে দেওয়ান ও অন্যদের তার ওপর থুতু ফেলতে বললেন। কেউ রাজি নয়। রাজাকে সন্ন্যাসী বুঝিয়ে দিলেন, মূর্তিপুজোর ব্যাপারটা এ রকমই। ভক্তেরা স্রেফ পাথর পুজো করেন না, তার মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে পান।
রাজকাহিনিই সব নয়। এই সময় অজস্র লোক ইংরেজি-শিক্ষিত সাধুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বিবিদিষানন্দ তাদের উর্দু শায়েরি, হিন্দি ভজন গেয়ে শোনান। উপনিষদ, কোরান, বাইবেলের কথা বলেন। তাঁর আগ্রহে কয়েক জন তরুণ সংস্কৃতও শিখতে শুরু করলেন। আলোয়ার ছাড়ার আগের দিন সেই রকম এক শিষ্যকে বলেছিলেন, “গ্রামের ছেলেরা দু’পাতা ইংরেজি পড়েই শহরে চাকরি করতে পালিয়ে আসে। তোদের মতো লেখাপড়া জানা লোক যদি গ্রামে গিয়ে বৈজ্ঞানিক ভাবে চাষবাস করে, ছোট জাতের সঙ্গে মেলামেশা করে, ভাল হয়। তখন দশ বছরে যা ফলবে, হাজার বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনেও হবে না।”
হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান এবং সমাজসংস্কার! বিবিদিষানন্দ এই প্রথম আভাস দিলেন, তাঁর ‘কাজ’টা ঠিক কী রকম হতে পারে!
|
খেতড়ির দিকে |
আলোয়ার থেকে বান্দিকুই স্টেশন হয়ে ট্রেনে জয়পুর। সেখানে সংসারচন্দ্র সেন নামে এক বাঙালির বাড়িতে ছিলেন বিবিদিষানন্দ। সেই বাড়ির ছোট মেয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবীকে দিয়েছিলেন তাঁর গানের খাতা। খাতাটা এত দিন তাঁর ঝোলাতেই ছিল। ভক্তদের দাবিতে ছবিও তোলাতে হল। পরিব্রাজকবেশে এটাই তাঁর প্রথম ছবি!
জয়পুর থেকে আজমেঢ়, সেলিম চিস্তির দরগা দেখে মাউন্ট আবু। সেখান থেকে রাজা অজিত সিংহের সঙ্গে খেতড়ি। ১৮৯১ সালের অগস্ট থেকে অক্টোবর অবধি খেতড়ির রাজবাড়িতে ছিলেন বিবিদিষানন্দ।
আর, খেতড়ি পৌঁছনোর ঢের আগে, ৩০ এপ্রিল মাউন্ট আবু থেকে একটি চিঠি লেখেন তিনি। নীচে সই: বিবেকানন্দ। খেতড়ির রাজাই তাঁকে বিবেকানন্দ নাম দিয়েছিলেন, ভুল ধারণা। গুরুভাইদের থেকে আত্মগোপনের জন্য বিবিদিষানন্দ এ বার বিবেকানন্দ, সচ্চিদানন্দ ইত্যাদি হরেক নাম নেবেন। নামে কী আসে যায়!
শিষ্য অজিত সিংহকে অবশ্য তাঁর গুরু শুধু আধ্যাত্মিকতা শিখিয়েই তৃপ্ত হতে পারেননি। রাজপ্রাসাদে একটি ল্যাবরেটরিও তৈরি করেছিলেন। টিকি দিয়ে বিদ্যুৎসংযোগ বা ‘সবই বেদে আছে’ গোছের বিজ্ঞান নয়। হাক্সলে, হেগেল-পড়া বিবেকানন্দ বরং উৎসাহী ছিলেন বিজ্ঞানের দর্শনে। এই ভারত সফরেই পরে বেলগাঁওয়ে অদ্বৈতবাদ বোঝাতে গিয়ে বলবেন, ‘চেতন-অচেতন, স্থূল-সূক্ষ্ম সবই এক। আগে আলো, তাপ, তড়িৎ সবাই আলাদা জিনিস বলে ভাবত।
এখন দেখা যাচ্ছে, সব একই শক্তির রূপান্তর।’
এই বিজ্ঞানদর্শনটাই ১৮৯৩ সালে চিকাগো ধর্মমহাসভায় জানাবেন তিনি, “বিজ্ঞান আর কিছুই নয়, একত্বের আবিষ্কার। ধরুন, রসায়নশাস্ত্র এমন একটি মূল পদার্থ আবিষ্কার করল, যা থেকে সব পদার্থ তৈরি করা যায়। তা হলে ওই শাস্ত্রের চরম উন্নতি হল। পদার্থবিজ্ঞান যদি এমন এক শক্তি আবিষ্কার করে, অন্যান্য শক্তি যার রূপান্তরমাত্র, তার কাজও শেষ। সে রকম বহুত্ববাদ, দ্বৈতবাদ প্রভৃতি পেরিয়ে শেষে অদ্বৈতবাদে পৌঁছে গেলেই ধর্মবিজ্ঞানের চরম বিকাশ।”
১৮৯১ সালের ২৭ অক্টোবর খেতড়ি ছাড়লেন বিবিদিষানন্দ। তাঁর কাছে তখন রাজার প্রার্থনা একটিই! গুরুর আশীর্বাদে তাঁর যেন একটি পুত্রসন্তান হয়! |
ভাঙো ব্রহ্মচর্য |
খেতড়ি থেকে আমদাবাদ। সেখান থেকে কয়েক দিন বাদে লিমড়ি। এখন স্রেফ কয়েক ঘণ্টার বাস জার্নি। প্রচুর মন্দির আর আশ্রম, লিমড়িকে আজও ‘গুজরাতের কাশী’ বলা হয়। এখানকার জগদীশ আশ্রমেই দেবানন্দের ‘গাইড’ ছবির শুটিং।
আর, বিবিদিষানন্দের আমলে? লিমড়িতে এক আশ্রমে উঠেছেন তিনি। দিন দুয়েক পরে পাশের ঘরে সাধুদের প্রার্থনার সঙ্গে নারীকণ্ঠ। এবং রহস্যজনক ফিসফিসানি। বিবিদিষানন্দ কিছু একটা আঁচ করে পালানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু হা হতোস্মি! দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।
কিছুক্ষণ বাদে এক সাধু এসে ঘরে ঢুকলেন, “তোমাকে দেখে তো উঁচু দরের সাধু মনে হচ্ছে। আমরা একটা ব্রত পালন করছি। সেখানে সাফল্য পেতে তোমার মতো বড় সাধুর মনে ব্রহ্মচর্য ভাঙা জরুরি। প্রস্তুত হও।”
বিদেশ বিভুঁইয়ে কী করবেন এখন বাঙালি সন্ন্যাসী? লিমড়ির এই বাড়িতে একটি বালক তাঁর কাছে মাঝে মাঝেই আসে। ভণ্ড সাধুরা তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। এ দিন সকালে সেই বালককে দেখেই বুদ্ধি খেলে গেল। তার হাতে একটি খোলামকুচি ধরিয়ে দিলেন সন্ন্যাসী। তাতে কাঠকয়লায় তাঁর বিপদের কথা লেখা। “কেউ যেন জানতে না পারে। আর এটা রাজাকে ছাড়া আর কাউকে দেবে না,” বালককে শিখিয়ে দিলেন তিনি।
বুদ্ধি কাজে এল। কিছুক্ষণ বাদেই রাজা যশোবন্ত সিংহের সেনারা উদ্ধার করল তাঁকে। রাজার দেওয়া পরিচয়পত্র নিয়ে দিন কয়েক বাদে জুনাগড়। সেখানে গিরনার পাহাড় দেখে সোমনাথ মন্দির, দ্বারকা, প্রভাস, পোরবন্দর, পালিটানা। শুধু তীর্থযাত্রা? বডোদরায় গায়কোয়াড়দের প্রাসাদে দেখলেন রবি বর্মার ছবি। ছাড়েননি রান্নার অভ্যাসও। জুনাগড়ের দেওয়ানের বাড়িতে এক দিন রসগোল্লা তৈরি করে সবাইকে খাওয়ালেন তিনি।
সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী কেন রাজপ্রাসাদে থাকেন? কেনই বা রাজারাজড়ার দেওয়া পরিচয়পত্র পকেটে রাখতে হয় তাঁকে? বহু পরে বিবেকানন্দ বলবেন, “যাঁদের হাতে ক্ষমতা এবং শাসনদণ্ড, তাঁদের ভাবাতে পারলে আমার জীবনব্রত আরও সফল হবে। এক জন রাজাকে স্বমতে আনতে পারলে আমি হাজার ব্যক্তির উপকার করতে পারব।” বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ‘ক্ষমতা’কে ব্যবহার করছিলেন তিনি।
কী ছিল তাঁর রাজনীতি? ক্ষমতার বিশ্বস্ত সহযোগী? তা হলে আসল রাজনৈতিক ক্ষমতা যেখানে, সেই ব্রিটিশ সভ্যতাকে কেন পরে বক্তৃতায় উড়িয়ে দেবেন তিনি, ‘ইংরেজের সভ্যতা তিনটে ‘ব’-এর ওপর দাঁড়িয়ে। বাইবেল, বেয়নেট আর ব্র্যান্ডি।’
আসলে, রাজনীতি দিয়ে বিবেকানন্দকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি বারে বারেই জানাবেন, কয়েক জন ত্যাগী ছেলে চাই, যারা পরের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে। যথার্থ শিক্ষা দিয়ে তারা দীনহীন অন্ত্যজদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, কুসংস্কার ঘুচিয়ে দেবে। ক্রমে এই গরিবগুর্বোরা নিজেদের ব্যবস্থা তৈরি করে নেবে। তাদের মধ্য থেকেও তখন ত্যাগী শিক্ষক বেরিয়ে আসবেন। মানুষকে জাগানোর এই শিক্ষা থেকে রাজনীতিকরা বরাবরই দূরের বাসিন্দা।
|
সন্ন্যাসীর পানদোক্তা |
এপ্রিল, ১৮৯২। বিবিদিষানন্দ এখন মহীশূর রাজ্যের বেলগাঁও শহরে। সেখানকার সাবডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্রের বাড়িতে। হরিপদবাবুই বিবেকানন্দকে জানাবেন, ‘পরের বছর শিকাগোয় বিশ্বধর্ম সম্মেলন। আপনি সেখানে যান।’ কিন্তু বিবেকানন্দ তখনই রাজি হবেন না। তাঁকে যে রামেশ্বরম্ অবধি যেতে হবে। গুজরাত ছেড়ে মহাবালেশ্বর, খান্ডোয়া, মুম্বই, পুণে হয়ে বিবিদিষানন্দ এখানে এসেছেন। তাঁর ঝোলায় ফরাসি সঙ্গীত নিয়ে একটি বই। খাওয়ার শেষে পানসুপারি চান, কখনও বা দোক্তা। ছোটখাটো অভ্যাস ছাড়লেই সন্ন্যাসী মহান, বিবিদিষানন্দ এমনটা কোনও দিন ভাবেননি।
যেমন, এই সফরের শেষ দিকে তিরুঅনন্তপুরম শহরে তিনি সুন্দররাম আয়ার নামে এক অধ্যাপকের বাড়িতে। সুন্দররামই তাঁর অনুরোধে মাদ্রাজের সহকারী অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের ঠিকানা খুঁজে বার করেন। তার পর থেকে বিবিদিষানন্দ বেশির ভাগ সময়েই মন্মথবাবুর বাড়িতে, দুপুরের খাওয়াও সেখানে। সুন্দররাম এ নিয়ে অনুযোগ করলে সন্ন্যাসীর সাফ জবাব, দক্ষিণী রান্না খেতে খেতে তাঁর পেটে চড়া পড়ে গিয়েছে। মন্মথবাবুর বাড়িতে মাছমাংস খাওয়ার সুযোগ তাই হারাতে চান না।
|
পাথুরে দ্বীপে |
বেলগাঁও থেকে আজকের গোয়া। মারমাগাঁও, পাঞ্জিম হয়ে মহীশূর। সেখান থেকে কোচি, এর্নাকুলাম হয়ে তিরুঅনন্তপুরম্। তিরুঅনন্তপুরম তখন ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের রাজধানী, সেখানে রেললাইন নেই। ফলে ঘোড়ার গাড়িতেই যাতায়াত করতে হয়েছিল বিবিদিষানন্দকে।
ঘোড়ার গাড়িতেই তিরুঅনন্তপুরম থেকে কন্যাকুমারী গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই এক দিন ভারত মহাসাগরে সাঁতার কেটে এক পাথুরে দ্বীপে গিয়ে ধ্যানে বসা।
ধ্যানে কী দেখেছিলেন সন্ন্যাসী? ভারতের লুপ্ত গরিমার পুনরুদ্ধার? পরে আমেরিকা থেকে চিঠিতে অন্য কথা লিখছেন, ‘একটা বুদ্ধি ঠাওরালুম ভারতবর্ষের শেষ পাথরের টুকরোর ওপর বসে এই যে আমরা এত জন সন্ন্যাসী আছি, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, লোককে দর্শনশিক্ষা দিচ্ছি এ সব পাগলামি। ...আমাদের জাতটা নিজের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে, তাই এত দুঃখকষ্ট। সেই জাতীয় বিশেষত্বের বিকাশ যাতে হয়, তাই করতে হবে। নীচ জাতিকে উপরে তুলতে হবে।’
১৮৯২ সালে ডিসেম্বর মাসের সেই দিনটায় বিবিদিষানন্দ পেয়ে গিয়েছেন তাঁর নিজস্ব দর্শন। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব একটি ‘জাতীয় ভাব’ আছে। বহু পরেও তিনি লিখবেন, ‘পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ভাষাঅর্থকরী বিদ্যা, উপায় রাষ্ট্রনীতি। আর ভারতের উদ্দেশ্যমুক্তি, ভাষাবেদ, উপায়ত্যাগ।’ পরের বছরের শুরুতেই রামেশ্বরে এলেন বিবিদিষানন্দ। আর মাত্র পাঁচ মাস পরে শিকাগোর উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি।
মাঝের সময়টা? রামেশ্বর থেকে মাদুরাই, পুদুচেরি হয়ে মাদ্রাজ বা আজকের চেন্নাই। সেখানে মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের বাড়িতে থাকতেন তিনি। এক দিন স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর মা মারা গিয়েছেন। কয়েক জন ভক্তকে নিয়ে শ্মশানে এক পিশাচসিদ্ধের বাড়ি যাওয়া হল। সে পেন্সিল দিয়ে কাগজে আঁকিবুকি কাটল। তার পর সন্ন্যাসীর নাম, গোত্র ও যাবতীয় কিছু বলে জানাল, মা ভালই আছেন। শীঘ্রই সন্ন্যাসীকে ধর্মপ্রচারে দূর দেশে যেতে হবে। এই মাদ্রাজেই তরুণ ভক্তেরা তাঁর আমেরিকাযাত্রার জন্য চাঁদা তুলছেন। কিন্তু বিবিদিষানন্দ দোটানায়। এ ভাবে যাওয়া উচিত? এক দিন আধো-তন্দ্রায় দেখলেন, রামকৃষ্ণ সমুদ্রে নেমে অন্য পারে এগিয়ে চলেছেন। তাঁকেও হাতছানি দিয়ে ডাকছেন।
তার কয়েক দিন পরেই খেতড়ির জগমোহন মাদ্রাজে হাজির। রাজা অজিত সিংহের ছেলে হয়েছে! গুরুকে এক দিনের জন্য হলেও খেতড়ি যেতে হবে।
|
দুই সন্ন্যাসী |
একটা কথাই ভাবার। এ ভাবে ঘুরপথে হিমালয়, রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ হয়ে রামেশ্বর গেলেন কেন তিনি?
আসলে, এটাই সন্ন্যাসীর পথ। অষ্টম শতাব্দীতে কেরলের ছেলে, আদি শঙ্করাচার্য বিহারে এসে মণ্ডনমিশ্রকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন। সেটাই সব নয়, বারাণসী থেকে গুজরাতের গিরনার পাহাড়, সোমনাথ, প্রভাস হয়ে দ্বারকা, কাশ্মীর, কেদার, বদ্রী কোথায় না গিয়েছেন? হাজার বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে তাঁকে নিয়ে উপকথা আর ইতিহাস আজ একাকার। তবু বিবিদিষানন্দের সফরের বেশির ভাগ জায়গাই যে অষ্টম শতাব্দীর সেই সন্ন্যাসীর ঐতিহ্যঋদ্ধ, সন্দেহ নেই। শঙ্করাচার্য-প্রভাবিত বলে বিবিদিষানন্দ আলোয়ারে বৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষির কথা বলার পাশাপাশি একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ বালকের পৈতের খরচ দেওয়ার জন্য জনে জনে অনুরোধ করবেন। জাতিধর্মের সংস্কারকে মুছে দিতে তিনি চান না।
আর সেই শাঙ্কর-ঐতিহ্য বলে, সন্ন্যাসী মানে গেরুয়া-পরা ভবঘুরে নয়। তিনি দার্শনিক এবং মন্ত্রদ্রষ্টা। অকুতোভয় এবং স্পষ্টবাক। মহীশূরের রাজা এক দিন বিবিদিষানন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেমন দেখছেন আমার দেওয়ানকে?’ সন্ন্যাসীর উত্তর, ‘সব দেওয়ান যেমন হয়। রাজকোষ থেকে টাকা সরায়।’ পরে রাজা তাঁকে সতর্ক করলেন, “আপনার জন্য ভয় লাগছে। অনেক শত্রু বাড়িয়ে ফেললেন, সতর্ক থাকবেন।’ কিন্তু বিবিদিষানন্দ জ্বলে উঠলেন, “কী বলছেন? সন্ন্যাসী সত্য বলতে ভয় পায়?” সন্ন্যাস নিয়ে তাঁর এই গর্ব কোনও দিন ম্লান হবে না। পরে ভগিনী নিবেদিতাকে বলবেন, “একটি সর্ষের কণার সঙ্গে সূর্যের যা তফাত, গোষ্পদ আর সমুদ্রে যে ফারাক, সংসারীর সঙ্গে সন্ন্যাসীর পার্থক্য ততটাই।”
|
শেষ কথা |
বোম্বাই বন্দর, ৩১ মে, ১৮৯৩। আর একটু পরেই জাপানের কোবে বন্দরের দিকে রওনা হবে ‘পেনিনসুলার’ জাহাজ। ডেক-এ গেরুয়া রঙের রেশমি আলখাল্লা ও পাগড়ি মাথায় এক সন্ন্যাসী। রাজার মতো দেখাচ্ছে তাঁকে।
সন্ন্যাসীর শিষ্য, খেতড়ির রাজা তাঁকে এই পোশাক করিয়ে দিয়েছেন। মাদ্রাজের ভক্তেরা চেষ্টাচরিত্র করে জাহাজে বার্থের টিকিট কেটেছিলেন। রাজা আরও বেশি টাকা দিয়ে, সেটি পাল্টে প্রথম শ্রেণির টিকিট কেটে দিয়েছেন। রাজার নির্দেশে সন্ন্যাসীর সঙ্গে বোম্বাই অবধি এসে তাঁকে জাহাজে তুলে দিয়েছেন জগমোহন। সন্ন্যাসী এখন অনেক নিশ্চিন্ত। কলকাতায় তাঁর মা ও ভাইবোনদের জন্য প্রতি মাসে ১০০ টাকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন খেতড়িরাজ। তাঁর আরও একটি অনুরোধ ছিল। গুরু এত দিন বিবিদিষানন্দ, সচ্চিদানন্দ ইত্যাদি হরেক নাম ব্যবহার করেছেন। ‘বিবেকানন্দ’ নামটিই থাকুক। বিবিদিষানন্দের অধ্যায় শেষ। বাঁশি বেজে উঠছে, রওনা হবে জাহাজ। ওই তো, ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ!
|
(শেষ) |
|
|
|
|
|