শীতের অতিথি
শীত দেরি করলেও নভেম্বরই এসে গেছে পরিযায়ী পাখির দল। তোমরা অনেকেই হয়তো বাড়ির আশেপাশের গাছে নতুন কিছু পাখি দেখছ। এদের মধ্যে পরিযায়ীও আছে। আগের বছরের নভেম্বরেই সাঁতরাগাছি ঝিলে এসেছে ৫,৬০০টি পাখি। তার আগের বার এখানেই দেখা মিলেছিল ১০,০০০ পাখির।
কবে আসবে, এই নিয়ে শীতের খামখেয়ালিপনা থাকতে পারে। কিন্তু শীতের বিদেশি অতিথি পরিযায়ী পাখির দল এই ব্যাপারে খুব নিয়মনিষ্ঠ। নভেম্বরের শুরু থেকেই ওরা হাজির। কেউ বা তারও আগে চলে আসে। কারণ, ওদের কারও কারও দেশে অগস্ট-সেপ্টেম্বরই বেজায় শীত পড়তে শুরু করে। যে যত উত্তরে থাকে, তার জায়গায় তত তাড়াতাড়ি শীত নামে। তাই সে তত আগে রওনা দেয়। যেমন, ব্রাউন শাইক বা কাজল পাখিকে অগস্ট মাসেই গাছের ডালে বা জলার ধারে দেখা যায়। এরা আসে মঙ্গোলিয়ার আশপাশ থেকে। সেখানে অগস্টেই শীত হাজির হয়।
ঠিক কবে পাখিরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দূর দূর দেশে পাড়ি দেওয়া শুরু করল, তা জানা যায় না। তবে ৩,০০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল আর হোমার পরিযায়ী পাখি দেখেছিলেন। প্রতি বছরই এরা আসে। এদের দেশে গরমকালে প্রচুর খাবার মেলে। ওরা তখন বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে। কিন্তু শীতটা ভয়ঙ্কর। খাবার মেলাই মুশকিল। শীতের আভাস মিললেই এরা রওনা দেয়। ভারতে পরিযায়ী পাখিরা আসে হিমালয়ের ওপারে চিন, মঙ্গোলিয়া বা রাশিয়া থেকে। আবার কিছু পাখি হিমালয়ের ওপর থেকেই নীচে সমতলে নেমে আসে। এদের অলটিটিউড-ল্যান্ড মাইগ্রেন্ট বলে। কিছু পাখি আছে লোকাল মাইগ্রেন্ট। যারা অন্যান্য সময় শ্রীলঙ্কা, ভুটান সহ বিভিন্ন ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরে বেড়ায়। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া শুধুই খাবার আর আশ্রয়ের জন্য।
পরিযায়ীদের এই যাতায়াত বড় আশ্চর্যের। এদের কেউ কেউ হাজার হাজার কিলোমিটার পথ একটানা পাড়ি দেয়। আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডের যায় বার টেইলড গডউইটস নামের একটি পাখি। এটি একটানা ১১,০০০ কিলোমিটারের বেশি পথ ওড়ে। আবার বার হেডেড গুস (এক রকমের রাজহাঁস) হিমালয়ের ২৯,০০০ ফুট উপর দিয়ে উড়ে আসে।
সামুদ্রিক পাখি জলের ওপর খুব নীচ দিয়ে ওড়ে। ডাঙায় এলেই উঁচুতে উঠে যায়। দিনের বেলা পরিযায়ীদের পথ দেখায় সূর্য, নদী, পাহাড়। আবার কোনও পাখি দিনে নেমে আসে খাবারের সন্ধানে। রাতে চলা শুরু করে। মনে করা হয় রাতের আকাশের তারারা এদের পথ দেখায়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গেও নাকি পাখিদের যোগ রয়েছে, যা এদের দিক নির্ণয়ে সাহায্য করে। পরিযায়ীদের কোনও কোনও প্রজাতি দল বেঁধে চলে। আবার কেউ একা একা পথ চলাই পছন্দ করে। এমনকী বাবা-মা’কে ছাড়াই কোনও কোনও পরিযায়ীর বাচ্চা দীর্ঘ অচেনা পথ পাড়ি দেয়।
কোথাও যাওয়ার আগে আমরা যেমন বেশ গোছগাছ করি, পাখিদেরও থাকে বেশ কিছু দিনের প্রস্তুতি। কেননা দীর্ঘ পথ পেরোতে প্রচুর পরিশ্রম হয়। তাই অনেক খেয়েদেয়ে এরা শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়ায়, যা পরবর্তীতে তাদের ওড়ার শক্তি জোগায়।
পরিযায়ী পাখিরা বছরের পর বছর কিন্তু একই জায়গায় ফিরে আসে। তবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে জায়গা পরিবর্তন করে ফেলে। এক বার কোনও জায়গা ছেড়ে দিলে তারা আর সেখানে ফিরে যায় না। আলিপুর চিড়িয়াখানার ঝিলে কয়েক বছর আগেও অনেক পরিযায়ী পাখির দেখা মিলত। এখন তাদের দেখা মেলে না বললেই চলে। এ দেশে ফি-বছর প্রায় ১০০টি’র বেশি প্রজাতির পাখি আসে। ওড়িশা, গুজরাত, অসম, উত্তরপ্রদেশ এমনকী কাশ্মীরের বেশ কয়েকটি জলাভূমিতে এরা ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণের দিকে তুলনামূলক ভাবে কম পাখি যায়। পশ্চিমবঙ্গেও অনেক জলাভূমিতেই পরিযায়ী পাখিদের দেখা যায়। যেমন শান্তিনিকেতনের বল্লভপুর অভয়ারণ্য, বক্রেশ্বর ব্যারেজ, বহরমপুরের আহিরন, সিউড়ির কাছে তিলপাড়া ব্যারেজ, সুন্দরবন। উত্তরবঙ্গের গজলডোবাতেও অনেক পাখি আসে (তিস্তা ব্যারেজ)। তবে সব থেকে বেশি পরিযায়ীর দেখা মেলে ফরাক্কা ব্যারেজে।
এখানে এসে তারা খেয়েদেয়ে, ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটায়। ফ্রেব্রুয়ারির শেষে শীত কমলে আবার গুটি গুটি রওনা হয়। এই সব পাখিদের স্বভাবও ভারী আশ্চর্যের। ফ্লেমিংগো নামের এক ধরনের পাখি ফিল্টার করে খুব ছোট পোকামাকড় খায়। অ্যালকালাইন জলে থাকে। শুধু শীতেই নয়, বেশ কিছু পাখি অন্যান্য ঋতুতেও আসে। যেমন, চাতক। আফ্রিকা ও ভারতের দক্ষিণ দিক এরা আসে বর্ষাকালে। ছাতারে পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। আবার গরম কালে কলকাতার আশেপাশে দেখা যায় প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার। সাদা-কালো মাথার লম্বা লেজের এই পাখিটিকে অনেকেই হয়তো চেনো। একে আমরা বলি দুধরাজ বা সা-বুলবুল। গরম কালে এরা গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। তবে অনেক পরিযায়ীই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন আবাবিল বা সোয়ালো পাখি। এরা জলাভূমির ওপর ঘুরে ঘুরে মাছ ধরত আর জলার ধারের ঘাস বা হোগলার ঝোপে রাত কাটাত। জলাভূমির ধারে ঘাস কমে এসেছে। তাই এদেরও কম দেখা যায়। ছোঁয়া চিলও তেমন আসে না। পরিযায়ীদের মধ্যে পালা’স ফিশ ঈগল বা কোরাল পাখি কয়েক মাসের জন্য এসেও এখানে বাসা বাঁধত। ডিম পেড়ে বাচ্চা তুলত। তার পর শীত শেষে সপরিবারে রওনা হত। এদেরও এখন আর দেখা মেলে না।

কৃতজ্ঞতা: পক্ষিবিশারদ কুণাল মুখোপাধ্যায়


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.