শাড়ির আঁচলে আপ্রাণ চেপে রয়েছেন ছেলের থুতনি। স্কুলের সাদা জামা রক্তে ভিজে গিয়েছে। প্রায় সংজ্ঞাহীন ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে হাসপাতালময় ছুটে বেড়াচ্ছেন মা, ‘একটু সেলাই করে দেবেন, থুতনিটা ফাঁক হয়ে গিয়েছে!’
জরুরি বিভাগে কেউ নেই। নদিয়ার করিমপুর হাসপাতালে শুক্রবার দুপুরে প্রায় আধ ঘণ্টা ছুটোছুটির পরে চিকিৎসক মিললেও রক্তাক্ত ছেলে আঁকড়ে মিঠু মণ্ডলকে শুনতে হয়েছিল, “সেলাই? তা কি চিকিৎসকের কাজ নাকি, হাসপাতালের কোনও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে বলুন।” প্রত্যন্ত সেনপাড়া গ্রাম থেকে ছুটে আসা মিঠুদেবী হতভম্ব হয়ে ছেলেকে নিয়ে ছোটেন ‘চতুর্থ শ্রেণির’ কর্মীর খোঁজে। মিনিট পনেরো খোঁজাখুঁজির পরে তাঁদের কয়েক জনকে পেয়েও যান তিনি। এ বার শুনতে হয়, “সেলাই তো চিকিৎসকদের কাজ। আমরা কেন করব?” পড়ি কি মরি করে ফের সেই কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এ বার মিঠুদেবী ফিরে পান আরও ঝাঁঝালো শ্লেষ, “ওরা না পারলে সুপারকে বলুন, উনি ভাল সেলাই করেন!” ঘণ্টা দেড়েক ধরে এমনই টানা হেঁচড়ায় সপ্তম শ্রেণির শৌভিক ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে। |
সংজ্ঞাহীন ছেলেকে আঁকড়ে মায়ের কান্না দেখে বহির্বিভাগে আসা রোগীর বাড়ির লোকজন এ বার এগিয়ে আসেন। তাঁদের হইচই শুনেই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। ছুটে আসেন হাসপাতালের সুপার বিধুভূষণ মাহাতো। খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন স্থানীয় করিমপুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কংগ্রেসের তারক সরখেল। চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত শৌভিকের ফাটা থুতনিতে চারটি সেলাই করেন ওই চিকিৎসক, সুদীপা মণ্ডল।
তবে এ দিনের ঘটনায় সরকারি হাসপাতালের ‘অমানবিক’ ছবিটা যে ফের এক বার সামনে এসে পড়েছে তা কবুল করেন তৃণমূলের স্থানীয় ব্লক সভাপতি চিররঞ্জন মণ্ডল। তিনি স্পষ্টই বলেন, “সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসকেরা আর যাই করুন চিকিৎসা করার ব্যাপারে যে তাঁদের মন নেই তা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল।” ওই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা স্থানীয় বিধায়ক সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার গাফিলতি যে চরম সীমায় পৌঁছেছে শুক্রবারের ঘটনা তা আরও এক বার প্রমাণ করল।”
ঘটনায় ক্ষুব্ধ নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অমিত হালদার বলেন, ‘‘এমন ঘটনা মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। ওই চিকিসককে শো-কজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে।”
তবে, চিকিৎসক সুদীপা মণ্ডলের কোনও অনুতাপ নেই এ দিনের ঘটনায়। তিনি বলেন, ‘‘সেলাই, ব্যান্ডেজ করার কাজগুলো তো হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীরাই করেন। এতে ভুল তো কিছু দেখছি না। ওরা সে কাজ করতে অস্বীকার করায় আমি ওই মহিলাকে ভাল একটা সুচ নিয়ে আসতে বলেছিলাম। কারণ হাসপাতালে সেলাই করার সুচগুলোর তেমন ব্যবহার যোগ্য নয়। এই সামান্য ঘটনায় এমন হইচই হবে ভাবিইনি।”
সেনপাড়া গ্রামের শৌভিক সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এ দিন সকালে সাইকেলে স্কুলে যাওয়ার সময়ে বড় রাস্তার উপরেই পড়ে গিয়ে তার থুতনি ফেটে যায়। ছেলে পড়ে গিয়েছে জানতে পেরেই ছুটে এসেছিলেন মিঠুদেবী। ছেলেকে নিয়ে তিনি একাই ছোটেন হাসপাতালে। তিনি বলেন, “খুব কষ্ট করে ছেলেকে হাসপাতালে এনেছিলাম। ভেবেছিলাম এক বার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই। এখন দেখছি ওখানে নিয়ে গিয়েই সমস্যা বাড়ল।” |