বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটা। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি আউটডোরে স্ট্রেচারে শুয়ে মাজদিয়ার বাসিন্দা, বছর চুয়াল্লিশের মাধব কাঞ্জিলাল। ভিড়ে ঠাসা আউটডোরে চারপাশের আওয়াজে তখন এমনিতেই কান পাতা দায়। তার মধ্যেই রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত মাধববাবুর মাথার কাছে সাউন্ডবক্সে তারস্বরে বাজছে ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা...।’ কয়েকটা পরীক্ষা করিয়ে আনার কথা বলছিলেন আউটডোরের চিকিৎসক। তুমুল কোলাহল আর গানের ‘গুঁতো’য় প্রায় চার বারের চেষ্টায় তা পুরোপুরি বুঝতে পারলেন মাধববাবুর সঙ্গে আসা আত্মীয়।
শহরের একাধিক সরকারি হাসপাতালের ছবিটা এখন এ রকমই। কারণ কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, এটা রোগীদের পক্ষে ‘ভাল’। অথচ, হাসপাতাল-নার্সিংহোম ‘সাইলেন্ট জোন’। তার ভিতরে বা আশপাশে হর্ন বা মাইক বাজানো বারণ। নিষেধ জোরে শব্দ করে মিটিং-মিছিলও। তা হলে কেন এ ভাবে গান চলছে হাসপাতালে? কর্তৃপক্ষের দাবি, এটা ‘মিউজিক থেরাপি’ এবং এতে বরং রোগীর শারীরিক-মানসিক উন্নতিই হবে। মন ভাল থাকবে তাঁর সঙ্গে আসা আত্মীয়-বন্ধুদেরও। সাইলেন্ট জোন হলেও তাই সাউন্ডবক্সে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো যেতেই পারে। অতএব কলকাতার বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে নিয়ম করেই গান বাজানো চলছে।
গানে রোগ সারানোর এ নিয়ম কি স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে?
নীলরতন সরকারের প্রাক্তন সুপার লক্ষ্মীকান্ত ঘোষ ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সুপার সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর জবাব, “স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ ছিল না। এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কারণ তাঁরা দেখেছেন, আউটডোরে অপেক্ষা করতে করতে রোগী ও তাঁর আত্মীয়েরা ক্লান্ত হয়ে যান। গানে একঘেয়েমি কাটে।” কিন্তু ডাক্তার দেখাতে এসে গান অসুস্থদের সত্যিই ভাল লাগছে কি না, তা কখনও খোঁজ নেওয়া হয়েছে কি? সুপারেরা বলেন, “গান খারাপ লাগার কথা নয়। মিউজিক থেরাপি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়।”
কিন্তু সরকারি হাসপাতালে অসংখ্য লোকের ভিড়ে আউটডোর যেখানে এমনিতেই নরক গুলজার অবস্থা, সেখানে গান বাজানোটা রোগী বা তাঁদের পরিজনদের পক্ষে কি আদৌ স্বস্তিদায়ক?
স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন, আউটডোরে গান বাজানোটা ততটা স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। তবে বিভিন্ন ওয়ার্ডে গান চালানোর ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁরা। আরও জানিয়েছেন, বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতালে অনেক দিন আগে থেকেই অপারেশন থিয়েটারে হাল্কা মিউজিক বাজানো হয়। তাতে রোগী ও চিকিৎসক দু’জনেরই মানসিক চাপ কমে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালকে ‘সাইলেন্ট জোন’ হিসেবে দেখলে চলবে না, বরং ‘মিউজিক থেরাপি’-র উপকারিতা ভাবতে হবে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “আউটডোরে গান চালানোটা যুক্তিযুক্ত নয়। সেখানে এমনিতেই আওয়াজ বেশি। তবে কিছু ওয়ার্ডে গান বাজতে পারে। যেমন লেবার ওয়ার্ড, শিশু বিভাগ, ক্যানসার ওয়ার্ড। এটা থেরাপির মধ্যেই পড়ে।” তিনি জানান, কাটোয়া হাসপাতালে লেবার রুমে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। বিভিন্ন জেলার ১২টি হাসপাতাল সম্প্রতি উন্নত পরিষেবার স্বীকৃতি হিসেবে আইএসও সার্টিফিকেশনের আবেদন করছে। এর জন্য ওই হাসপাতালগুলিতে নতুন যে সব ব্যবস্থা চালু হচ্ছে, তার অন্যতম হল ওয়ার্ডে রোগীদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনানো। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা হাসপাতাল এমআর বাঙুরেও ২৬ জানুয়ারি ও ১৪ ফেব্রুয়ারির মতো দু’টি দিনকে ‘টার্গেট’ করেছেন। এর মধ্যে যে কোনও এক দিন থেকে তাঁদের কিছু আউটডোরে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও লঘুসঙ্গীত বাজানো শুরু হবে।
স্বাস্থ্য দফতরের ভাবনা যা-ই হোক, ‘সঙ্গীতময়’ আউটডোরে রীতিমতো তিতিবিরক্ত হয়ে পড়ছেন অপেক্ষমাণ রোগী ও পরিজনেরা।
নীলরতনের আউটডোরের সাউন্ডবক্সে রোগীদের জন্য তথ্য এত আস্তে প্রচারিত হচ্ছে যে কারও কানে ঢুকছে না। অথচ গান শুরু হলেই আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে। নিউরোলজির আউটডোরে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে হয়রান নৈহাটির মুন্নি ঝা। গানের ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “চারদিকে ভিড়, আওয়াজ, বাচ্চার ঘ্যানঘ্যান, তার উপরে এই গান! বিনা পয়সায় ওষুধ দিতে পারে না, অথচ গান শোনাবে!” আউটডোর ভবনের প্রতিটি তলায় ওঠার মুখেই হেল্প ডেস্ক। মাথার উপরে সাউন্ডবক্সে “ক্ষণে ক্ষণে, মনে মনে শুনি...!” নানা তথ্য জানতে ডেস্কের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে অনেককেই। এ দিকে, চেঁচামেচি আর গান মিলিয়ে এমন জটিল অবস্থা যে, কাউকে তিনতলায় যেতে বললে ভাল শুনতে না পেয়ে তিনি দোতলায় হাঁটা লাগাচ্ছেন। হতাশ সহায়িকা বলেই ফেললেন, “কী করব, নিয়ম যখন, গান শুনতেই হবে।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নতুন আউটডোর ভবনেও ছবিটা একই রকম। একসঙ্গে এতগুলি বিভাগের আউটডোরের অসংখ্য রোগী, তাঁদের বাড়ির লোক, চিকিৎসক-চিকিৎসা কর্মীর গলার আওয়াজ, মাঝেমধ্যে রোগীদের জন্য নানা সতর্কীকরণ, আর সঙ্গে বক্সে চলা রবীন্দ্রসঙ্গীত! কোন ঘর থেকে কে কার নাম আর নম্বর ধরে ডাকছেন, অর্ধেকে তা বুঝেই উঠতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার দুুপুরেও আউটডোর জুড়ে বেজেছে “আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া...।” হরিনাভি থেকে আসা দীপক ভট্টাচার্য বলেই ফেলেন, “এ কী জুলুম রে বাবা! অসুস্থ শরীরে কিছু ভাল লাগছে না। কোথায় নাম লেখাব, কোথায় টেস্ট করাব সে সব খুঁজে পেতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে জোর করে গান শোনাচ্ছে!” |