অভিযোগ এ বার স্বাস্থ্যে
‘ফিরিয়ে দিল’ সরকারি হাসপাতাল, মৃত্যু প্রসূতির
শিক্ষার পর স্বাস্থ্য। আবার হইচই বাধল সরকারি স্তরে ‘ব্যর্থতা’র অভিযোগ নিয়ে।
মা ও শিশুর মৃত্যু হার কমানোই তাঁর সরকারের মূল লক্ষ্য বলে বারবার ঘোষণা করছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ তাঁর বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরে একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে এক সদ্য প্রসূতিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠল। পরে ওই প্রসূতি মারা যান। তাঁর সদ্যোজাত যমজ সন্তান আপাতত ওই চিত্তরঞ্জন সেবাসদন হাসপাতালের শিশু সদনেই চিকিৎসাধীন।
সরকারি হাসপাতালে প্রসূতির কার্ড থাকা সত্ত্বেও ওই মহিলাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় এই বিতর্কই ফের সামনে এসেছে যে, প্রচার চললেও আরও নানা দফতরের মতো স্বাস্থ্যেও পরিস্থিতির আদতে কোনও ‘উন্নতি’ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে হেতু সাতটি দফতরের মধ্যে স্বাস্থ্যও নিজের হাতেই রেখেছেন, তাই হইচই হচ্ছে বেশি। প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলেছেন, “ঠিক কী ঘটেছে, আমি জানি না। স্বাস্থ্যে এমন দুভার্গ্যজনক ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে। তবে যা-ই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য দফতর ছেড়ে দেওয়া উচিত।”
স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য প্রথামাফিক ঘটনাটির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তবে স্বাস্থ্যকর্তাদের প্রাথমিক ধারণা, হাসপাতাল প্রত্যাখ্যান করেনি। বাড়িতেই প্রসব ও সেই সংক্রান্ত জটিলতার জেরে ওই মহিলা মারা গিয়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার পর ময়নাতদন্ত ইত্যাদি ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় এড়াতে বাড়ির লোকজনই তাঁর দেহ ফিরিয়ে নিয়ে যান। স্বাস্থ্যকর্তাদের আরও বক্তব্য, ঊষাদেবীর আরও সাতটি সন্তান রয়েছে। তাঁর শরীরের অবস্থা এমনিতেই খারাপ ছিল। তার উপর বাড়িতে প্রসবের পরে তিনি নিজেই যমজ সন্তানের নাড়ি কাটেন। সেই সময়েও রক্তপাত শুরু হয়। তার থেকেই তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
স্ত্রী ঊষার প্রসূতি-কার্ড হাতে টিটু তাঁতি।
গোটা বিতর্ক সামনে এনেছে শহরের দুই সরকারি হাসপাতাল চিত্তরঞ্জন সেবাসদন ও শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালকে। শুক্রবার ভোর থেকে যে ঘটনার সূত্রপাত। মেয়ো রোডের কাছে এক ঝুপড়ির বাসিন্দা ঊষা তাঁতির যমজ সন্তান হয় বৃহস্পতিবার রাতে। তাঁর স্বামী টিটু তাঁতি জানান, চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে তাঁর স্ত্রীর প্রসব সংক্রান্ত কার্ড করানো ছিল। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে বাড়িতেই তাঁর প্রসব হয়ে যায়। নিজেই ব্লেড দিয়ে সন্তানদের নাড়ি কাটেন ঊষাদেবী। শুক্রবার ভোরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের শরণাপন্ন হন তাঁর স্বামী।
মৃতার স্বামীর অভিযোগ, চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা না-করেই ওই হাসপাতাল থেকে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, ওখানে প্রসব হয়নি। তাই তাদের কোনও দায়িত্ব নেই। এর পর মুমূর্ষু স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে টিটু শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে যান। অভিযোগ, সেখানে চিত্তরঞ্জনের কার্ড দেখে বলা হয়, অন্য হাসপাতালের ‘কেস’। তাদের কিছু করার নেই। দুই হাসপাতাল ঘুরে ফের ঝুপড়িতেই ফিরে আসেন তাঁরা। সেখানেই কিছু ক্ষণ পরে মৃত্যু হয় ঊষাদেবীর।
ঝুপড়ির সামনের রাস্তাতেই ওই মহিলার মৃতদেহ পড়ে ছিল বলে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন। প্রবল ঠান্ডায় রাস্তায় পড়ে ছিল দুই সদ্যোজাতও। বেবি বিবি নামে এক দিনমজুর ওই অবস্থা দেখে টিটু ও তাঁর দুই সদ্যোজাতকে নিয়ে ফের চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে আসেন। দ্বিতীয় দফায় শিশু দু’টিকে ভর্তি করা হয় ওই হাসপাতালেরই শিশু সদনে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। ওই সংগঠনের তরফে নিতাইদাস মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রবল ঠান্ডায় বাচ্চা দু’টি রাস্তায় পড়ে ছিল। বেবি নামে ওই দিনমজুর মহিলা ওদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে উদ্যোগী না-হলে ওরা হয়তো মারা যেত। ওই মহিলাই আমাদের বিবেক!”
শিশু সদনের অধ্যক্ষা মালা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, শিশু-সহ কোনও প্রসূতি তাঁদের কাছে আদৌ আসেননি। ফুটপাথে পড়ে-থাকা দুই সদ্যোজাতকে নিয়ে এক মহিলা এসেছিলেন। মালাদেবী বলেন, “শিশু দু’টির ওজন অত্যন্ত কম। ঠান্ডায় প্রায় নীল হয়ে এসেছিল। অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভর্তি করে নেওয়া হয়েছে। আপাতত শিশু দু’টি ওয়ার্মারে রয়েছে।”
মা ও শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে নিরাপদ প্রসবের জন্য সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে প্রচার-অভিযান চালাচ্ছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার। বিশেষত, সেই কারণেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোরও।
প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যবাবুর যেমন যুক্তি, “স্বাস্থ্য একটি জটিল দফতর। সাতটা দফতরের সঙ্গে এটা চালানো যায় না।
ঊষাকে হাসপাতালে নিয়ে যান বেবি বিবি।
চিকিৎসক নিয়োগ থেকে নার্সের পদপূরণ, কোনওটাই ঠিক ভাবে হচ্ছে না। শিশু মৃত্যুর সময় যা বলেছিলাম, এখনও তা-ই বলছি। ওঁর (মুখ্যমন্ত্রী) স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত।” বাম জমানায় সূর্যবাবুর হাতে এক সময় স্বাস্থ্যের সঙ্গেই পঞ্চায়েত দফতরও ছিল। দুই দফতর একসঙ্গে সামলাতে তিনি ‘ব্যর্থ’ বলে অভিযোগ উঠত। সেই যুক্তিতেই এখন বিরোধী শিবিরে গিয়ে সূর্যবাবুরা প্রশ্ন তুলছেন, স্বরাষ্ট্র, ভূমি, স্বাস্থ্য, সংখ্যালঘু উন্নয়নের মতো এতগুলি দফতর একসঙ্গে হাতে রাখলে কোনওটির প্রতিই ‘সুবিচার’ করা যায় কি না। বিরোধী শিবিরের এক নেতার কথায়, “স্বাস্থ্য ভবনে মন্ত্রীর জন্য একটি ঘর রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সর্বশেষ সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যানও পাওয়ার আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে।
অথচ গত সাত মাসে মুখ্যমন্ত্রী একবারও স্বাস্থ্য ভবনে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি। এক বার যেতে গিয়েও সংবাদমাধ্যমের বাড়াবাড়িতে মাঝপথ থেকেই ফিরে এসেছিলেন।”
সূর্যবাবুর বক্তব্য, চিকিৎসক নিয়োগের জন্য বাম জমানার শেষ দিকে যে প্যানেল করা হয়েছিল, বিধানসভা ভোট এসে যাওয়ায় তখন নিয়োগ হয়নি। নতুন সরকার সাত পেরিয়ে আট মাসে পড়লেও চিকিৎসক নিয়োগের কাজ এগোয়নি। রোগী প্রতি নার্সের অনুপাতও তথৈবচ। অথচ স্বাস্থ্য এমন একটি দফতর, যেখানে সরকারি কর্মীর সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। প্রতি মাসেই বেশ কিছু কর্মী অবসর নিচ্ছেন অথচ তাঁদের শূন্যস্থান ভরাট হচ্ছে না। পরিকাঠামো ছাড়াই নতুন নতুন মাল্টি-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা হয়ে চলেছে! সূর্যবাবুর কথায়, “চিকিৎসকদের প্রতি প্রশাসনের তরফে যে আচরণ করা হচ্ছে, কলেজ অধ্যক্ষদের মতোই সরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা কাজ করতে চাইবেন না!”
বিরোধী দলনেতার সমালোচনা ফিরিয়ে দিয়ে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান মহাকরণে বলেছেন, “সূর্যবাবু দায়িত্বে থাকার সময়েই স্বাস্থ্য দফতরের সর্বনাশ করে দিয়েছিলেন। এখন তিনিই আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করছেন! মানুষ এটা ক্ষমা করবে না।” দমকলমন্ত্রী এ-ও বলেন, “সূর্যবাবু চোখ বুজে স্বাস্থ্য দফতর সামলাতেন। এখন চোখ বুজেই সমালোচনা করছেন! তা না-হলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নানা উন্নতি ওঁর নজরে পড়ত।”

নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.