|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
নির্বাসন ও উগ্রপন্থার নিহিত ইতিবৃত্ত |
গৌতম রায় |
দ্য কনভার্ট/আ টেল অব এক্সাইল অ্যান্ড এক্সট্রিমিজম, ডেবোরা বেকার। পেঙ্গুইন ভাইকিং, ৪৫০.০০ |
নিউ ইয়র্কের মার্গারেট মার্কাস কেমন করে লাহোরের মরিয়ম জামিলা হয়ে উঠলেন? যখন নাতসি হলোকস্ট-এ নিঃশেষিত ইহুদিরা খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরছেন প্যালেস্টাইনে নবোদিত ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলকে, আরবদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে প্রসারিত হচ্ছে জায়নবাদের ভৌগোলিক সীমান্ত, তখন মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা এক ইহুদি কিশোরী কী প্রেরণায়, কোন প্রণোদনায় ইসলামকে তার মুক্তির সোপান রূপে বরণ করল? দ্য কনভার্ট গ্রন্থে ডেবোরা বেকার সেই রহস্যেরই সুলুক-সন্ধান করেছেন।
মার্গারেট যে নবীন কৈশোর থেকেই স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, সেটা জানতে তার জীবনীর অর্ধেকেরও বেশি পড়ে ফেলতে হয়। এ জন্য বাড়িতে, স্কুলে, সহপাঠীদের সঙ্গে কোথাও সে মানিয়ে নিতে পারে না। তাকে বার বার মনোবিদের কাছে যেতে হয়, মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তির প্রতীক্ষায় সেখানে সুবোধ বালিকার অভিনয় করে যেতে হয়। কিন্তু পরিপার্শ্বের সঙ্গে মানাতে না-পারার অসুখই কি তার ধর্মান্তরিত হওয়ার একমাত্র কারণ? লেখিকা তা মনে করেন না। মার্গারেট স্পষ্টতই সভ্যতার সংঘাতের শিকার। ভোগবাদী, পরিণামভয়হীন, বেপরোয়া মার্কিন সভ্যতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের বিপন্নতা, যৌন স্বেচ্ছাচার, মাদকাসক্তি (যা কিছু কাল পরে ষাটের দশকের ছাত্র-বিক্ষোভ, হিপি সংস্কৃতি ও পুষ্প প্রজন্মের জন্ম দেবে) মার্গারেটের মতো সংবেদনশীল কিশোরীকে পাশ্চাত্যের প্রতি বিবমিষায় বিমুখ করে তোলে। জায়নবাদকেও তার পশ্চিমের অবক্ষয়ী সংস্কৃতির সহযোগী ও দোসর বলে মনে হয়। তাই সে ক্রমশ আরবের সংস্কৃতি ও ইসলামের আধ্যাত্মিকতার প্রতি অমোঘ আকর্ষণে বাঁধা পড়তে থাকে। ইসলামের ইতিহাস ও বর্তমানের গভীর চর্চা তাকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নিঃসংশয় আশাবাদী করে তোলে। পাকিস্তানের জামাতে ইসলামির নেতা আবুল আলা মওদুদির প্রভাব বলয়ে পড়ে সে।
এই বলয়ে তার প্রবেশ স্বনির্বাচিত। মার্গারেট মার্কাস লাহোরে পাড়ি দেন মরিয়ম জামিলা হতে। মওদুদির পরিবারেই কন্যার মতো থাকতে শুরু করেন। ইসলামের পুনর্জাগরণের আশায় ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষু পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লেখনী ধরেন মরিয়ম, বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম পত্রপত্রিকায় খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম ও সভ্যতার তুলনায় ইসলামের উৎকর্ষ নিয়ে যুক্তিপূর্ণ সওয়াল করে অচিরেই খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বই হু-হু করে বিক্রি হতে থাকে। কিন্তু ইসলামেও কি কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পায় মার্গারেট? আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত হয়েও মুখে-মুখে তর্ক করার অমুসলিমসুলভ ঔদ্ধত্যের জন্য মওদুদির বিরাগভাজন হন মরিয়ম। নির্বাসিত হন তাঁর পরিবার থেকে। নূতন আশ্রয়দাতার সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারেন না। মওদুদি তাঁকে ভর্তি করে দেন লাহৌরের পাগলখানায়। শেষে মওদুদিরই এক বশংবদ জামাতকর্মীর দ্বিতীয়া স্ত্রী হয়ে মরিয়মকে পাগলখানা থেকে মুক্তি পেতে হয়। উপর্যুপরি মা হতে থাকেন, অথচ সন্তানদের প্রতিপালন করেন না। সে কাজ করে চলে তাঁর সতীন। ছেলেপুলেরা বড় হয়। কেউ কেউ আফগানিস্তানে মুজাহিদ হতে চলে যায়। ইসলামি জেহাদের নামে সোভিয়েত-বিরোধী এই মার্কিন প্রক্সি-যুদ্ধে শহিদ হয়ে তালিবানের উত্থানের ক্ষেত্রও প্রশস্ত করে। মরিয়ম তবু এ সবের মধ্যে দোষের কিছু দেখেন না। ৯/১১ বা তার পরবর্তী সন্ত্রাস, ফিদাইন হামলা, মানববোমার বিস্ফোরণে নিরীহ নারীশিশুবৃদ্ধের হত্যার মধ্য দিয়ে ইসলামের কোন মহিমা পুনরুদ্ধার হচ্ছে, মরিয়মের কাছে তার কোনও উত্তর নেই। কারণ ধর্মান্তরিত হলেও তিনি যে সাম্য, সামাজিক ন্যায় ও শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতায় অনপনেয় বিশ্বাসের ধর্ম থেকে চ্যুত হননি, ইসলামে সেই বিচ্যুতি দেখেও নিজে তাতে গা-ভাসাতে যাননি।
ডেবোরা বেকার তাই মরিয়মকে কোনও খলনায়িকা রূপে উপস্থাপিত করেননি। তাঁর সংবেদনা মার্গারেট তথা মরিয়মের মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইসলামি সভ্যতার স্কিৎজোফ্রেনিয়ার উপাদানগুলো খুঁজে পেয়েছে। পশ্চিমের পচনশীল ভোগবাদ, অবক্ষয় ও বিচ্ছিন্নতাবোধের পাশাপাশি মওদুদির বিশুদ্ধ ইসলামের স্বপ্নের ক্ষণভঙ্গুরতা ও প্রাচ্যবাদী বাচনে তার অবমূল্যায়ন নিপুণ ভাবে উন্মোচিত হয়েছে ডেবোরার এই জীবনীগ্রন্থে। আর সেই সূত্রেই উপন্যাসের চেয়েও আখ্যানময় তাঁর অনুপম গদ্য হয়ে উঠেছে নির্বাসন ও উগ্রপন্থার নিহিত ইতিবৃত্ত। |
|
|
|
|
|