|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বুদ্ধি ও বোধের আশ্চর্য সমন্বয় |
মৃণাল সেন |
ডিপ ফোকাস/রিফ্লেকশনস অন সিনেমা, সত্যজিৎ রায়। সম্পা: সন্দীপ রায়। রে সোসাইটি ও হারপার কলিন্স, ৪৫০.০০ |
সিনেমা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের লেখা। ছবি করার আগে থেকেই লিখে চলেছেন, ছবি করতে করতেও বিস্তর। দেশে বিদেশে সর্বত্র। নির্বাচিত লেখার প্রথম সংকলন বেরিয়েছিল ১৯৭৬-এ, দ্বিতীয়টি ডিপ ফোকাস। বিষয় ওই একই, বৈচিত্রে ঠাসা। প্রথমটির নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ, নামকরণও তাঁরই আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস, আর দ্বিতীয়টির নির্বাচন সন্দীপ রায়ের। সত্যজিতের অবর্তমানে কাজটি দুরূহ। তবু বলব, সম্পাদনার মুন্সিয়ানা গোটা সংকলন জুড়ে। হতেই হবে, না হলে সুবিচার হত না।
শব্দ চয়নের কথা যদি বলা যায়, অথবা বাক্য গঠনের, এবং দু’য়ের মিশেলে ভাবনার বিচরণে, চিন্তার গভীরতায়, এবং চৈতন্যের দুরন্ত দর্শনে সত্যজিতের প্রায় সব লেখাই ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে। এবং আশ্চর্য, প্রায় সব লেখাগুলিই সংযমের সুশাসনে জড়ানো, কোনওটাই মাত্রা ছাড়িয়ে নয়। অলংকারহীন, খাদহীন, দ্ব্যর্থহীন। অসামান্য, ঈর্ষণীয়! এমনকী, এক-দেড়-দু’পাতার লেখাতেও। গোদার প্রসঙ্গে তো বটেই (পৃ ৯৯-১০১), আন্তোনিয়োনির ক্ষেত্রেও (পৃ ১০২-১০৬), কিছু বা এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। শুধুমাত্র চ্যাপলিন সম্পর্কে আধপাতা, মাত্র আধপাতা, লেখাটি আমার পছন্দের নয়, যেন দায়সারা কাজ (পৃ ১১৫)। যা কিনা বেরিয়েছিল চ্যাপলিনের শতবার্ষিকী উৎসবে নানা জনের লেখায় ঠাসা নন্দন-এর ছোট্ট এক পুস্তিকায়। অবশ্য কয়েক লাইনের সেই লেখাটার পাশেই গায়ে গায়ে লাগানো গোটা পাতা জুড়ে দেখা যায় সত্যজিতেরই এক অসাধারণ স্কেচ, আবহমান কালের ভবঘুরে, চার্লি, চার্লির মুখ (পৃ ১১৪)।
একটা কথা। ১৯৫৩-এ আমি চ্যাপলিনের ওপর একটা বই লিখি। সত্যজিৎ রায়কে বলতে এক কথায় তিনি প্রচ্ছদটি করে দিলেন। আমি তো মহাখুশি। সত্যজিৎও। পারিশ্রমিকের কথা বলতেই এক গাল হাসলেন, পিঠে একটা চাপড় দিলেন, চা খাওয়ালেন আর এক কাপ। সন্দীপ তখন জন্মেছে কি? বলার অপেক্ষা রাখে না যে ডিপ ফোকাস-এর গোটা পাতা জুড়ে যে স্কেচটি আজ দেখা যায় তা ওইটি। আমি ধন্য। ভাবি, বাহাদুর বটে সম্পাদক।
গোদারের ওপর লেখাটি ছোট, মাত্র তিন পাতার। তবে হ্যাঁ, বলব বক্তব্যের নির্যাস রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বিশিষ্ট’ হয়ে উঠেছে এবং অবশ্যই ব্যতিক্রমী। সারা দেশে, বিদেশেও গোদার নিষ্কৃতি পাননি, বহু মানুষই লিখেছেন, বলেছেন, তর্ক তুলেছেন সভাসমিতিতে। ভাল লেগেছে কম, অস্বস্তিই বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিরক্তিকর। যাঁদের কথায় বিরক্তির মাত্রা বেড়ে যায় তাঁদেরই কি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পণ্ডিত-পেয়াদা’ বলা যায় না? গোদারের কথায় এসে এঁদের কথাই কি সত্যজিৎ রায় বলেননি, যখন তিনি লিখলেন: ‘দ্য ট্রাবল, রিয়্যালি, ইজ নট উইথ গোদার, বাট উইথ হিজ ক্রিটিক্স-- অর, অ্যাট লিস্ট, আ গুড মেনি অব দেম-- হু আর কনস্ট্যান্টলি ট্রাইং টু ফিট আ স্কোয়্যার পেগ ইনটু আ রাউন্ড হোল।’
নানা ভাবে নানা জায়গায় বহু কথা গোদারকে শুনতে হয়েছে, কানে এসেছে এধার-ওধার থেকে। গোদার তখন তাঁর চরিত্র অনুযায়ী দু’হাত দিয়ে সে সব সরিয়ে দিয়েছেন, যেন ‘জঞ্জাল’ সরিয়ে দেওয়াটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। হয়তো বা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন, যেন এ সবে কিছু যায় আসে না। ভাল কথা শুনলেও হয়তো ওই রকমই করতেন, হয়তো না। আমার মনে হয় গোদারের মধ্যে এক ধরনের শোম্যানশিপ কাজ করে। তাই যদি না হবে তো এক বার প্যারিসের সরবন-এ ছাত্র আন্দোলনের সময়, ১৯৬৭-তে গুটিকয়েক সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে স্লোগান তুলে কান ফেস্টিভ্যাল-এর শুরুর দিনেই মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন কেন? কেনই বা ‘ভিভা মাও’ বলে আওয়াজ তুলেছিলেন? ফেস্টিভ্যালকে বিপদে ফেলতে?
শোম্যানশিপ নিয়ে সত্যজিৎ অবশ্য কিছুই বলেননি, একেবারেই না। বলেছেন, ছবি করার ক্ষেত্রে গোদার কোনও কনভেনশনকেই মেনে চলেন না, চলবেন না বলেই চলেন না। আবার আন্তোনিয়োনি প্রসঙ্গে তাঁর মত, ‘বিনিথ অ্যান এক্সটিরিয়র অব অ্যাপারেন্ট আরবিট্রারিনেস, আন্তোনিয়োনিজ ফিল্মস কনসিল অ্যান অলমোস্ট ক্ল্যাসিক্যাল ফরমাল প্যাটার্ন।’ তাঁর দৃঢ় ধারণা গোদারের মধ্যে এই সমস্ত লুকোচুরি নেই, সবই সাদাসাপটা। কিন্তু সব মিলিয়ে গোদারের ছবিগুলো কেমন লাগে সে কথা বলেননি। লেখাতে বুদ্ধি ও বোধের আশ্চর্য সমন্বয়, কিন্তু অনাবশ্যক আবেগ বা উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত। অথচ আন্তোনিয়োনি-র সম্পর্কে লিখতে গিয়ে দেখলেন যে ‘ব্লো-আপ’-এ নতুন আন্তোনিয়োনি। এমজিএম-এর বিপুল অর্থে তৈরি ‘ব্লো-আপ’-এ সত্যজিৎ দেখতে পেলেন এই আন্তোনিয়োনি’তে সেই আন্তোনিয়োনি তো নেই। কী হল এত দিনের পরিচিত মানুষটির! বললেন, ‘ওয়ান ইজ রিয়্যালি হার্ড পুট টু ফাইন্ড এনিথিং ইন ব্লো-আপ টু রেজ ইট টু দ্য লেভেল অব আ সিরিয়াস সোশ্যাল অ্যানালিসিস-- হুইচ মোস্ট অব আন্তোনিয়োনিজ পাস্ট ফিল্মস হ্যাভ বিন...’। এমনই আরও অনেক কিছু বললেন যা আন্তোনিয়োনি-র সঙ্গে একেবারেই যায় না। এ দিকে সত্যজিতের এ হেন অস্বস্তির মধ্যেও প্রচুর ডাকাবুকো সমালোচকরা নাকি অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছেন। সত্যজিৎ কিন্তু বললেন, ‘আই, ফর ওয়ান, অ্যাম স্টিল লুকিং’। কথাটা ছোট্ট, কিন্তু খোঁচাটা জ্বালা ধরায়।
|
|
সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন। নন্দন-এর সূচনা দিনে, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫। |
আমার দুর্ভাগ্য যে আন্তোনিয়োনি-র উৎকট ভক্ত হয়েও ‘ব্লো-আপ’ আমার দেখা হয়নি। কিন্তু পড়েছি ভাল ভাল কথা, অনেক কথা। এক দিন তাই সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে গিয়ে ছবিটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, ছবিটা সম্পর্কে ওঁর প্রশ্ন অনেক। সব শেষে হেসে হেসেই বললেন, ছবির নাম ‘ব্লো-আপ’, কিন্তু সবাই জানে ছবির নেগেটিভ যদি মাত্রা ছাড়িয়ে এনলার্জ করা যায় তার তো ডিটেল হারিয়ে যাবেই। ছবিতে দেখেছি যত বার মূল ইমেজটা বাড়ছে, তত বারই নতুন নতুন ইমেজ ধরা পড়ছে ফোটোগ্রাফার-নায়কের চোখে। সম্ভব? সম্ভব কি? আমি বলি, এ ছবি তো ফোটোগ্রাফির কেমিস্ট্রি নিয়ে নয়। অবশ্যই না। সদুত্তর পাইনি।
সতর্ক দর্শকের সংখ্যা বাড়ছে, পাঠকের সংখ্যাও, তাঁরা তো প্রশ্ন তুলবেনই, যুক্তি-তর্কের ফোয়ারা ছোটাবেন। কেউই ছাড়া পাবেন না। সত্যজিৎও কি বিতর্কিত থাকেননি, অধরাই থেকে গিয়েছেন? হার-জিতের কথা নেই এখানে। পদার্থবিদ নিলস্ বোর স্পষ্ট করে এক দিন বলেই ফেললেন: ‘ট্রুথ অ্যাটেনস আ কোয়ালিটি অনলি হোয়েন ইট বিকামস কন্ট্রোভার্সিয়াল’। কথাটায় জাদু আছে, সাহস জুগিয়েছে অনেককেই। ঝগড়া বাড়িয়ে দিতে নয়, মীমাংসার পথে এগিয়ে যেতে।
আমার মতো অভাজনকেও হাঁটতে হয়েছে এ পথে। সিনেমার নবতরঙ্গ নিয়ে সত্যজিতের একটি লেখার কথা বলি, আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস-এ। শেষ প্যারাগ্রাফে আচমকা সত্যজিৎ টেনে আনলেন আমার এক ছবিকে, ‘ভুবন সোম’। যে ছবিটি যথার্থ কারণেই হোক অথবা অকারণে দেশ জুড়ে খানিকটা শিহরন জাগিয়েছিল নবতরঙ্গের আগমনী বার্তা নিয়ে। সত্যজিৎ কিন্তু খুশি হলেন না। বললেন, ‘ভুবন সোম ইজ সাইটেড ওয়াইডলি অ্যাজ অ্যান অফ-বিট ফিল্ম, হুইচ হ্যাজ সাকসিডেড উইথ আ মাইনরিটি অডিয়েন্স...’। বললেন: মিষ্টি-মধুর এক নায়িকা, জমজমাট আবহসঙ্গীত, কিছু বা রমণীয় দৃশ্য, দৃষ্টিনন্দন। সব কিছু ছাপিয়ে ইচ্ছাপূরণের খেলা: ‘আ সিম্পল, হোলসাম, উইশ-ফুলফিলিং স্ক্রিন স্টোরি।’
হলফ করে বলতে পারি, আমি কিন্তু এই ডাকসাইটে আমলাকে (ভুবন সোম) সংশোধন করিনি, প্রয়োজনও দেখিনি, কারণ এই মহাশয় ব্যক্তিটির মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এক বিশিষ্টকে। তিনি রাগী, একবগ্গা ও কটুভাষী অথচ আড়ালে আবডালে নিঃসঙ্গ ও দুঃখী, ‘অ্যান আনহ্যাপি ফিগার অব রিডিকিউল, নট আ ফিগার অব ফান’। লিখলাম আমি সত্যজিতের বইটির সমালোচনায় ‘সানডে’-তে। দর্শক, যাঁরা অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে আমার কথা: “রেসপন্ডিং টু স্টক রেসপন্সেস! ‘আ সিম্পল, হোলসাম, উইশ-ফুলফিলিং স্ক্রিন স্টোরি’!!!”
সত্যজিৎ রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করলেন, বললেন: ‘সানডে-টা পেয়েছি, লেখাটাও পড়ে ফেলেছি, বড় লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন আমাকে।’ কিন্তু ছোট্ট খোঁচা ছিল যে একটা, বলি আমি। সত্যজিৎ রায় হাসলেন, তারপর বললেন ‘সেই জন্যেই তো...।’ এই হলেন সত্যজিৎ। নিজেকে শুধরে নিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হতে অসুবিধে হয় না। আশ্চর্য! |
|
|
|
|
|