|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
ভয় থাকা ভাল, তাতে পা মাটিতে থাকে |
সেই জন্যই ‘অন্তহীন’ বা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর পর দু’বছর স্রেফ বসে থাকেন। ‘অপরাজিতা তুমি’র মতো চ্যালেঞ্জের জন্য। শান্তনু মৈত্র। মুখোমুখি সংযুক্তা বসু |
পত্রিকা: ‘ঢিংকা চিকা’র মতো গানে সুর দিতে চান?
শান্তনু: না একেবারেই চাই না।
পত্রিকা: কেন? এগুলোই তো আমজনতার গান।
শান্তনু: অনেকেই এই ধরনের গানে সুর দিচ্ছেন। আমি যে ধরনের কাজ করছি সেরকম কাজ করার লোক কম।
পত্রিকা: ‘অন্তহীন’এর আকাশছোঁয়া সাফল্যের পর ‘অপরাজিতা তুমি’। চাপ ছিল?
শান্তনু: অনেকটাই। বেশ ভয় লেগেছিল। মা বাবাকে, বউকে বলেছিলাম সে কথা। ছেলে বলেছিল, “বাবা জাস্ট গো ফর ইট’।
কিন্তু ভয়টা থাকা ভাল, তাতে পা মাটিতে থাকে। যে কোনও সাফল্যের একটা ঘোর থাকে। সেই ঘোরটা যেন নতুন কাজকে প্রভাবিত না করে সে কথা ভেবেই ‘থ্রি ইডিয়টস’ আর ‘অন্তহীন’এর মতো দু’টো বড় বড় হিটের পর দু’বছরের গ্যাপ নিয়েছিলাম।
পত্রিকা: বাঙালি শ্রোতারা যে আপনার সুর দেওয়া গান শোনার জন্য ব্যাকুল, সেটা নিশ্চয়ই জানেন? ‘যাও পাখি’ এখনও কত জনের রিংটোন।
শান্তনু: জানি। কিন্তু গ্যাপ যদি না দিই ভাল কাজ হবে না। ‘জুবি ডুবি’ বা ‘পল পল’এর মতো গান রিংটোন হলে আশ্চর্য হই না। অবাক হই যখন দেখি ‘ফেরারি মন’ বা ‘রূপকথারা’ রিংটোন হচ্ছে। আসলে ‘অন্তহীন’ প্রমাণ করেছে ভাল গানের কোনও ফর্মুলা হয় না। ‘অপরাজিতা তুমি’র গানেও আরও বেশি এক্সপেরিমেন্ট, আরও বেশি ঝুঁকি নিয়েছি। ‘আগের মতো বাংলা গান হচ্ছে না’ এই আক্ষেপ আর চলবে না। এখনকার বাংলা গান আগের মতোই সুন্দর হচ্ছে। কখনও বা আগের বাংলা গানের কোয়ালিটিকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে।
পত্রিকা: অনুপম রায়ের গান শুনেছেন?
শান্তনু: হ্যাঁ। অবশ্যই। খুব গভীর। রোম্যান্টিক। তবে মনে হয় শুধুমাত্র সিনেমার গানের ওপর নির্ভর করে থাকা ওর ঠিক হবে না। শিল্পী ও গায়ক হিসেবে ওর যে দু’ তিন রকম শেড্স আছে সেগুলো বের করে আনতে হলে ননফিল্মি গানও দরকার। |
|
পত্রিকা: ‘অপরাজিতা তুমি’র সুরটা কেমন হবে সেটা কি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দুই নারী...’ গল্পটা শোনার পরই ঠিক করেছিলেন?
শান্তনু: সুনীলদা’ যে ধরনের মানুষদের নিয়ে লিখেছেন, বিদেশে গিয়ে তাদের আমি দেখেছি, চিনেছি। ফলে গল্পটা শুনে প্রথমেই ঠিক করেছিলাম, এই ছবির সঙ্গীতে কী কী করা যাবে না। যেমন ক্ল্যাসিক্যাল নিয়ে খেলা যাবে না। এমন সুর হবে যা সহজে গুনগুন করা যায়। সান ফ্রান্সিসকো শহরের চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে সুরের পরিকল্পনা করেছি। সেখানে প্রবাসী বাঙালির নিঃসঙ্গতা আছে, প্রেম আছে, আবার খুশির জীবনও আছে। এই সব নিয়েই আমার কম্পোজিশন।
পত্রিকা: এ ছবিতে সঙ্গীতের উৎসে অনেকটাই থাকছেন প্রসেনজিৎ। সে জন্য আলাদা কোনও পরিকল্পনা?
শান্তনু: স্টার প্রসেনজিৎ নন। অবশ্যই ভেবেছি তাঁর অভিনীত চরিত্রের মেজাজটা যাতে বেরিয়ে আসে সে কথা। ওঁকে খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে ওঁর চেহারা। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করি, দাদা কী করে এত সুন্দর চেহারা ধরে রেখেছেন? প্রথম আলাপ ‘থ্রি ইডিয়টস’এর সময়ে। আমিরের বন্ধু। ছবিটি দেখতে এসেছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়ার স্টুডিয়োতে।
পত্রিকা: ‘অন্তহীন’এর পরে ‘অপরাজিতা তুমি’তেও চন্দ্রিল-অনিন্দ্য। আপনাদের সুর দেওয়া-গান লেখার প্রসেসটা নাকি খুব মজার...
শান্তনু: হ্যাঁ। যেমন আমি ওদের বলেছিলাম ‘কেন এমন করে হঠাৎ’ গানটায় মাঝামাঝি “কী যে দারুণ” এমন দু’টো ছোট শব্দ থাকবে। ওরা সুর আর ছন্দটা শুনে নিয়ে লিখল ‘বলা বারণ....’। এই ‘বলা বারণ’ কথাটাই আমার গানের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে ‘ধুঁয়া’র মতো। এক্সপ্রেশনটা শুনছি অনেকের খুব পছন্দ হয়েছে। সত্যিই তো পৃথিবীতে কত অনুভূতি থাকে যা কিছুতেই অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। এই ভাবেই সুরের ধাঁচ শুনে চন্দ্রিল-অনিন্দ্যরা ‘বলা বারণ’এর মতো মোক্ষম কথা বসিয়ে নেয়...
পত্রিকা: ‘অন্তহীন’ করার সময় অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী, শান্তনু মৈত্র, চন্দ্রিল-অনিন্দ্য নিয়ে একটা টিম তৈরি হয়েছিল। আবার সেই টিম...
শান্তনু: ‘অন্তহীন’এর সময় একে অপরকে চিনতে সময় লেগেছিল। এবার কিন্তু আমরা একে অপরকে এতটাই চিনি যে তাকালেই বুঝে যাই কে কী চাইছে। বাকিটা বলা বারণ। (হাসি) সেটা দ্রুত কাজ তুলতে সুবিধে করেছে। ‘অপরাজিতা তুমি’র সঙ্গীত এতটাই জোরালো করে ভাবা হয়েছিল যে বাই-চান্স প্রথম ছবিটা ‘অপরাজিতা তুমি’ হলে সেটা কেমন হত বলতে পারি না। কিন্তু ‘অন্তহীন’এর দিনগুলো আমার খুব প্রিয় স্মৃতি হয়ে থাকবে। সেটা ছিল আমাদের মতো কয়েকজনের প্রথম প্রেমে পড়ার উন্মাদনার দিন।
পত্রিকা: এই ছবিতে বেশ কয়েকজন নতুন শিল্পীকে দিয়ে গান গাইয়েছেন। বড় বাজেটের ছবিতে এমন ঝুঁকি...
শান্তনু: যে মুডের জন্য যেমন গলা দরকার তেমন শিল্পী বের করেছি। ভাল কাজ করতে গেলে এই ঝুঁকিটা নিতেই হয়। রূপঙ্করকে আমার সুর দেওয়া বাংলা গানে প্রথম কাজে লাগালাম। ওর মতো রোম্যান্টিক গলা কম হয়।
পত্রিকা: ‘বলা বারণ’-য়ে গলা মিলিয়েছেন। গায়ক হতে চাইছেন?
শান্তনু: না। এই গানটায় একটা আর্ত চিৎকার দরকার ছিল। ‘কে জাগে রাত’এর জায়গায় আমার গলাটা লাগিয়েছি ‘অ্যাজ এ কমন ম্যান’। এই এক্সপেরিমেন্টটা ‘থ্রি ইডিয়টস’এও করেছিলাম। ‘বহেতি হাওয়া সা থা ওহ’ গাওয়াও একই কারণে।
পত্রিকা: বাংলা গানের সঙ্গে এত জড়িয়ে পড়া, কিন্তু বলেন ‘বাংলাটা আমি ঠিকঠাক জানি না...’
শান্তনু: এই যে চন্দ্রিল-অনিন্দ্যরা গান লেখে তার এক বর্ণ না বুঝেও আমি কিছু অর্থ অনুভব করতে পারি নিজের মতো করে। অনুভূতিটাই আসল।
পত্রিকা: সেটা কেমন?
শান্তনু: যেমন ‘অপরাজিতা তুমি’র একটা গানের কথা এরকম, “মন পাহারা, বন্ধুরা/ আজ খোলা আলটুসি ক্যান্টিন”। এই ‘আলটুসি ক্যান্টিন’--- মাত্র দু’টো শব্দ। কিন্তু কী নস্টালজিক। আমাদের জীবনের ক্যান্টিনের দিনগুলোর স্মৃতি কী পেলব, কী সুন্দর! এমন সারল্য বাঙালিকে এই কনজিউমারিজমের যুগেও নাড়া দেয়। এটা বলিউডে নেই। বাঙালির এই ইনোসেন্সকে কাজে লাগাচ্ছি। খুব সহজ ভাবেই সুর দেওয়ার চেষ্টা করি।
পত্রিকা: যে গান তৈরি করলেন, তা মানুষের মন ছোঁবে বোঝেন কী করে?
শান্তনু: সেটাও বুঝি অনুভূতি দিয়ে। ‘অপরাজিতা তুমি’র একটা গান সুর দেওয়ার পর অনিরুদ্ধকে শুনিয়েছিলাম মুম্বইতে আমার স্টুডিওতে বসে। জিজ্ঞেস করলাম, কী মনে হয়, চলবে? অনিরুদ্ধর চোখে তখন জল। বলল, “চলবে কিনা জানি না রে, কিন্তু গানটা শুনে বড্ড মায়ের কথা মনে পড়ছিল।” এটাই বাঙালিয়ানা। অনুভূতিপ্রবণতা।
পত্রিকা: কাজ শুরু করার আগে নাকি প্রচুর পার্টি করেছিলেন?
শান্তনু: পার্টি মানে আড্ডা, গল্প, গান। তাও আবার নিজেদের গান নয়, লতা, আশা, রফি, কিশোর। অনিরুদ্ধ খেতে ভালবাসে, খাওয়াতেও। দেদার ফুর্তি। ওটা ‘অন্তহীন’-এর সেলিব্রেশনও ছিল।
পত্রিকা: প্রদীপ সরকার, রাজু হিরানি, শ্যাম বেনেগাল.... এঁদের সঙ্গে অনিরুদ্ধর তফাত কী?
শান্তনু: সাধারণত মুম্বইতে গল্পটা আগে তৈরি হয়ে যায়। তার পর গান। কিন্তু অনিরুদ্ধ গল্প বাঁধে, গানের কাজ চলার পাশাপাশি। কোথায় কোন মুড সং থাকবে, সেটাকে মাথায় রেখে। এমন ইউনিক স্টাইল আগে দেখিনি।
পত্রিকা: এত কম কাজ করে মুম্বইয়া সেলিব্রিটি লাইফস্টাইলে চলেন কী করে?
শান্তনু: এটাও বাঙালিয়ানা। অল্পতে খুশি থাকা। অন্য সঙ্গীত পরিচালকেরা যেটা পারেন আমি পারি না। মূলত বিজ্ঞাপনের কাজ করেই আসল রোজগারটা হয়। কম কাজ করেও যে খোশমেজাজে থাকার ঝুঁকি নিতে পারছি তার কারণ আমার ইএমআই-য়ের চাপটা খুব কম। আমার স্ত্রী সারদাও অল্পতে খুশি বলেই আমি যেমন খুশি বাঁচতে পারি।
পত্রিকা: কিন্তু শিল্পীদের তো একটু প্রেমেট্রেমে পড়তে হয়...
শান্তনু: অবশ্যই। এই তো সিকিমে গিয়ে একটা মেয়েকে এত ভাল লেগেছিল দু’ঘণ্টা একটা চায়ের দোকানে বসে গল্প করেছিলাম। নাম কটরিনা। যেমন সুন্দরী, তেমনি মিষ্টি কথা। একবার স্পেনেও এ রকম হয়েছিল। বাড়িতে এসে এদের গল্প করি। ম্যাজিকাল মোমেন্টস। কিন্তু ধরে রাখতে চাইলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়। ওই যে ‘বলা বারণ’।
পত্রিকা: ‘অন্তহীন’এর সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকলেই জাতীয় পুরস্কার পেলেন, আপনি ছাড়া...
শান্তনু: তাতে কী? কাজটা মানুষের ভাল লাগুক, এটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আর সঙ্গীত পরিচালনার বাইরেও ছবি তোলা, রান্নাবান্না, অ্যাস্ট্রোনমি, বেড়ানো তো আছেই। পাহাড়, নদী সমুদ্রের কাছে যখন দাঁড়াই মনে হয়... আমার ক’টা গান হিট করল, পুরস্কার পেলাম কি পেলাম না... সব খুব তুচ্ছ।
পত্রিকা: নিজের সাফল্যটা তেমন কোনও বড় ব্যাপার নয় বলছেন?
শান্তনু: বড় নয় কী করে বলি? রক্তমাংসের মানুষ তো। কিন্তু এটাও বিশ্বাস করি কোনওটাই নিজের
কীর্তি নয়। ঈশ্বর করিয়ে নিয়েছেন।
তাই হয়েছে। |
|
|
|
|
|