উত্তর কলকাতা: পাইকপাড়া, ব্যারাকপুর
অগ্নিবিধি শিকেয়
সিঁদুরে মেঘ
মরি-কাণ্ডের পরে রাজ্য সরকার সব হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে সতর্কতা ও কড়া নজরদারির কথা বললেও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের হাসপাতালগুলিতে সেই ব্যবস্থার বালাই নেই। কোথাও কোথাও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও তার মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছে, নয়তো তা খালি পড়ে। কোথাও আবার হাসপাতালের কেউ এই যন্ত্রের ব্যবহার জানেন না। কোথাও সেই যন্ত্র অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য স্টোর রুমে তালাবন্দি। অভিযোগ উঠেছে, শুধু অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহারই নয়, আগুন লাগলে বা জরুরি অবস্থায় হাসপাতালগুলির বর্তমান পরিকাঠামোয় রোগীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনও ধারণা নেই হাসপাতালের বহু কর্মীরই।
ব্যারাকপুর বি এন বসু মহকুমা হাসপাতালে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা বলতে কার্যত কিছুই নেই। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের গ্যাসের মেয়াদ পেরিয়েছে গত নভেম্বরে। দমকল আধিকারিকরাও জানান, অপরিসর জায়গা হওয়ায় ওই হাসপাতালের তিনতলা বা চারতলায় আগুন লাগলে তা নেভানো মুশকিল। শুধু তাই নয়, এই হাসপাতালে দু’টি সিঁড়ি থাকলেও একটি তালাবন্ধ থাকে। জরুরি প্রয়োজনে সেটি ব্যবহার করা অসম্ভব। একসঙ্গে বহু লোক সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে এমনিতেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। সিঁড়িগুলিতে আলোর ব্যবস্থাও ভাল নয়। হাসপাতালের সুপার মৃদুল ঘোষ বলেন, ‘‘মহকুমা হাসপাতাল হওয়ায় প্রতি দিন কয়েক হাজার রোগী এখানে আসেন। শয্যার তুলনায় ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। চার তলা পর্যন্ত রোগীর ভিড়ে হিমশিম খেতে হয়। ওঠানামার দু’টি সিঁড়ি থাকলেও একটি দিয়েই আপাতত চলাচল হয়। লিফট মাত্র একটি। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলে যা করতে পারেন আমরা তা পারি না, যতক্ষণ না সরকারি অনুমোদন মেলে।’’
খড়দহের বলরাম সেবাসদন স্টেট জেনারেল হাসপাতালের অবস্থাও তথৈবচ। এখানে রোগীর চাপ মহকুমা হাসপাতালের মতো না থাকলেও কয়েকশ রোগী প্রতিদিন আসেন। আগুন নেভানোর ব্যবস্থা এখানেও কিছুই নেই। হাসপাতালের তালা বন্ধ স্টোর রুমে পাঁচটি অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও সেগুলি অচল। বছর কয়েক আগে এই হাসপাতালে একবার আগুন লেগেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থাকার পরেও কেন অগ্নি নির্বাপণের বিষয়ে উদাসীন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? হাসপাতালের সুপার জয়া বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা উদাসীন নই। সরকারি নির্দেশও রয়েছে আগুন নেভানোর জরুরি ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে সচেষ্ট হতে। কিন্তু যে সরকারি দফতরগুলোর সঙ্গে সমণ্বয় রেখে এটা করতে হয় তাদের বারবার জানিয়েছি। আমরির ঘটনার আগে থেকেই অগ্নি নির্বাপণ নিয়ে আমরা একাধিক বৈঠক করেছি। কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সরকারি নিয়মে এই ব্যবস্থার আর্জি জানানোর পরে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হয় সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো থেকে যথাযথ সাড়া পাওয়ার জন্য।’’
সোদপুর থেকে মধ্যমগ্রাম যাওয়ার রাস্তায় পানিহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দু’টি আছে দর্শনধারী হিসাবে। কোনও দিন তার ব্যবহার হয়েছে কি না জানা নেই হাসপাতালের কর্মীদেরও। দমকল থেকেও কখনও তা খতিয়ে দেখা হয়নি বলে জানান চিকিৎসা কর্মীরা। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া এই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলি ছাড়া আর আগুন নেভানোর ব্যবস্থা বলতে একটি জায়গায় জমা করে রাখা কিছু বালি। হাসপাতালের সামনে একটি বড় পুকুর আছে। জরুরি অবস্থায় দমকলের জলের অভাব অন্তত হবে না। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কী করণীয় তা জানা নেই এই হাসপাতালের কর্মীদেরও। সুপার মলয় দাস বলেন, “হাসপাতালে আরও বেশি যন্ত্রের জন্য চিঠিচাপাটি যা করার করেছি। এখনও পর্যন্ত কোনও পরিদর্শন হয়নি।”
কামারহাটির সাগর দত্ত স্টেট জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজেও আগুন নেভানোর ভরসা বলতে সেই পুকুর। নেই কোনও সরঞ্জাম। এমনকী, সামান্য বালির ব্যবস্থাও নেই। এই হাসপাতালের যে নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে, সেখানে সব ব্যবস্থা থাকছে বলে জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পুরনো ভবনে কিছুই নেই কেন? ডেপুটি সুপার বিশ্বদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সবই আছে। প্রতিটি তলায় বালির বালতি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। জরুরি সময়ে দমকল আসা পর্যন্ত আমাদের সামলে নেওয়ার প্রাথমিক ব্যবস্থা আছে।’’ কিন্তু কোথায় সেই প্রাথমিক ব্যবস্থা? বিশ্বদেববাবু বলেন, ‘‘স্থানান্তরের জন্য এখন সব অগোছালো। পুরনো ভবনটিতে আগুন নেভানোর অতিরিক্ত কোনও ব্যবস্থা রাখতে হবে কি না খতিয়ে দেখার জন্য দমকলকে আমরা জানিয়েছি। এখনও দমকল থেকে কেউ আসেননি।’’
বরাহনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতাল চত্বরেও কচুরিপানায় ভরা একটি পুকুরই আগুন লাগলে টোটকা হিসাবে ব্যবহার করা যাবে বলে মনে করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুপার জয়ব্রতী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই পুকুরের জল ছাড়া আগুন নেভানোর কোনও সরঞ্জামই হাসপাতালে নেই। আমরি-র ঘটনার পরে আমি সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠিচাপাটি করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সঠিক কী হওয়া উচিত জানতে চেয়েছিলাম। এখনও কোনও উত্তর পাইনি।’’
ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক তথা রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি অজয় পালের কথায়: ‘‘হাসপাতালগুলিতে আগুন নেভানোর প্রাথমিক ব্যবস্থা থাকলেও তা নড়বড়ে। প্রত্যেকটি হাসপাতাল ধরে সেগুলি ঠিক করার চেষ্টা হচ্ছে। আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলিও রিফিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ বারাকপুরের হাসপাতালগুলির বেহাল অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে দমকল বিভাগের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল দেবপ্রিয় বিশ্বাস বলেন, “কলকাতা এবং বিধাননগরে আমরা ইতিমধ্যেই পরিদর্শন করেছি। শহরতলিতে সংশ্লিষ্ট জেলা দমকল আধিকারিকেরা অবিলম্বে এই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখবেন। পরিদর্শনও করবেন।”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.