|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ৩... |
|
জীবনের... অন্তহীন অনুরণন |
সান ফ্রান্সিসকোয় পুরো শ্যুট। বাংলায় এই প্রথম। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর তৃতীয় ছবি।
চেনা নমনীয়তা, অচেনা জীবনবোধ। আবারও প্রথাভাঙা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। লিখছেন দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী |
ঠিক বা ভুল বলে কিছু হয় না...
না কি হয়?
এ রকম তো কত শুনি। রোজ। কিন্তু বুঝি কি?
জীবনের ছাল ওঠা যন্ত্রণায় তখন তো আমার ব্যথাই একমাত্র ব্যথা। আর তোমারটা আমাকে ব্যথা দেওয়ার বিলাসিতা। হরবখত।
এই কথাগুলো বলতেই পারত প্রদীপ কুহুকে। কুহু ঊষসীকে। ঊষসী রণজয়কে।
কিন্তু ‘বলা বারণ’।
শুধু গানের কথা নয়। সত্যিই অনেক কথা বলা যায় না। বলেওনি ‘অপরাজিতা তুমি’। তবু বুঝতে না চাওয়া, বুঝতে না পারা অনুভূতিগুলোকে দিয়ে সমানে মনের ভেতর ঝাপটা মেরেছে।
সেই ঝাপটার আঁচড়ে মনে ঘা হয় না কোথাও। মনটা উছলে ওঠে। ওলট-পালট খায়।
এ ঝাপটে ব্যথা নেই তা নয়। তবে তার সঙ্গে আছে পেলবতা।
এমনিতেই অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ছবিতে এক ধরনের নমনীয়তা থাকে। নম্রতা থাকে। এ ছবিতে সেই নমনীয়তা আরও বেশি কোমল মনে হবে। অথচ ছবির বিষয় অনিরুদ্ধর আগের দু’টো ছবির থেকে জটিল। ম্যাচিওর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দুই নারী হাতে তরবারি’ অনেকেরই পড়া। তাই থিয়েটারের অন্ধকারে আশ্চর্য চমক অনেকেই আশা করবেন না হয়তো। জানা গল্প তো! কিন্তু যা অজানা তা হল, এই ছবির পরত। আর সেই পরত খুলতে খুলতে এমন কিছু আত্মউন্মোচন যা থিয়েটারের বাইরেও সঙ্গী হয়ে থাকে।
প্রদীপ রায়চৌধুরী (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)। আমেরিকার সফল চাকুরে। স্ত্রী কুহু (পদ্মপ্রিয়া) আর দুই সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার। প্রদীপ ভাল ছেলে। লেখাপড়ায়। আচারে-ব্যবহারে। দায়িত্বে-কর্তব্যবোধে। এহেন প্রদীপ যখন কোনও সোজাসাপ্টা কারণ ছাড়া পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় তখন কুহুর মা (তনুশ্রী শংকর) সেই প্রশ্নটাই করেন যেটা গড়পরতা অনেকেই করবেন, “ওর মতো ভাল ছেলে...?” ভাল ছেলের বিবাহবহির্ভূত ভাললাগা থাকতে নেই। ভাল মেয়েদেরও
নেই। সমাজনির্ধারিত ঠিক-ভুলের বাইরে যাওয়া সেখানে বারণ।
|
|
পদ্মাপ্রিয়া |
কুহুও সেটা বিশ্বাস করে কোথাও। তাই তার পূর্ব প্রেমিক ইউসুফ (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে সে এড়িয়ে যায়। কিন্তু চরিত্রহীনতার দায়ে প্রদীপকে ছেড়ে একা থাকার সময় ইউসুফের সঙ্গে কুহুর আবার দেখা হয় যখন? নৈকট্য যখন তারও শরীরে-মনে আবেশ আনে? তখন? তখন কুহু ডুকরে কাঁদে। সেটা কতটা ইউসুফ পরদিন সকালে তাকে একা রেখে চলে যাওয়ায় আর কতটা কোনটা ঠিক কোনটা ভুলএই দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে তার উত্তর কে দেবে? কুহুর হতাশ দ্বিধাগ্রস্ততার শরিক যে আমরা কমবেশি সকলেই!
অদ্ভুত পারিপাট্যে আর পরিণত হাতে এই জটিল অনুভূতি আর সম্পর্কের সূক্ষ্ম গিঁটগুলো সামলেছেন অনিরুদ্ধ। গিঁট খোলেননি, কেন না এ ছবি গিঁট খোলার না। গিঁট থাকলে থাকুক। জীবন তাও চলে।
ক্ষত হয়। প্রলেপ পড়ুক না পড়ুক। জীবন চলে।
আঘাতের পর ক্ষমা আসুক বা ক্ষমাহীনতার দৈন্য, মানবিক অঙ্গীকারগুলো মুছে যায় না।
জীবন তাই চলে।
প্রদীপের চূড়ান্ত অসুস্থতার সময় তাই তার সুশ্রূষার সঙ্গী হয় কুহু। স্বামীর মনের মতো করে ম্যাকরনি রাঁধে। আর স্বামীর প্রেমিকা ঊষসী (কমলিনী মুখোপাধ্যায়) যখন দেখা করতে আসে তার সঙ্গে, তখন অদ্ভুত নির্বিকল্পে তাকে কাছে ডেকে নেয়।
ঊষসী। পরিচালক পারতেন এই মেয়েটিকে শরীরসর্বস্ব, ক্ষুদ্র মনের একটা চরিত্র করে দেখাতে। কিন্তু এ ছবিতে অনিরুদ্ধ অনেক ম্যাচিওর আগেই বলেছি। সাদা-কালোর চেনা নকশা তিনি তাই কাটেননি। ধূসর যে ফ্রেমে চলেছে তাঁর পরিচালনা তার মধ্যেই দিয়েছেন পরিপাটি আলপনা। ঊষসী তাই শুধু ধূসর হবে বলেই বন্ধুর স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হয় না। তার শূন্যতা এবং শূন্যতাপূরণের খেলায় কখন কী ভাবে আড় চোখে লো-কাটের জামা পরা বা শর্ট স্কার্ট পরা মহিলা দেখা ভাল-ছেলে প্রদীপ সঙ্গী হয়ে যায়, সেটা সে নিজেও টের পায় না যেন।
প্রদীপও পায় কি?
কুহুও তো পায় না!
ইফসুফের সঙ্গে তার কাটানো অন্তরঙ্গতার আভাস তার মনের কোন গহনে ইচ্ছে হয়ে লুকিয়ে ছিল তার হদিশ পেতে! সে শুধু বোঝে ইউসুফের অনুভূতি থেকে যাবে তার সঙ্গে। ইউসুফের দেওয়া সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইটার মতো। প্রদীপের শুশ্রূষারত নার্সের কাছে তাকে রেখে সমুদ্রের ধারে সেই বই হাতে কুহুর একা বসে থাকা ইউসুফের কাছে ফেলে আসা সেই মুহূর্তেরই সন্ধানে তো...
নাকি নয়?
কে জানে! |
|
জানাতেও চাইবে না এ ছবি। একবারও বলবে না এই যে প্রদীপ, বা ঊষসী, কিংবা কুহু অথবা ঊষসীর বর রণজয় (চন্দন রায় স্যান্যাল) যে কিনা আত্নকেন্দ্রিকতার আবডালে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যকে খুঁজে নেয় স্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের বিনিময়ে -এরা কে ঠিক। কে ভুল। শুধু ছাপ ছেড়ে যাবে এমন এক অনুভূতির যা বলবে জীবনের বাঁকে এরা সবাই কষ্ট পেয়েছিল। ভালবেসেছিল। নিজের নিজের মতো করে।
‘অনুরণন’ বা ‘অন্তহীন’-এ সম্পর্ক ও তার মানবিক দিকগুলোর কথা অনিরুদ্ধ বলেননি তা নয়। কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের নাটকীয়তা ছিল। নাটকীয় মোচড় ছিল। যা পর্দাতেই ভাল ফোটে। ‘অপরাজিতা তুমি’ পর্দা থেকে নেমে জীবনে এসে থিতু হয়। জীবনের চলন যে পর্দার সব থেকে হাততালি পড়া দৃশ্য বা নাটকের সবথেকে গরম সংলাপের থেকে একেবারে অন্য কিছু, তা বোঝায়। বোঝা যায় পরিচালক পরিণত হয়েছেন। পরিমিত হয়েছেন।
পরিণত আর পরিমিত-র অর্থ পাল্টেছেন আর একজনও। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ‘২২শে শ্রাবণ’-এর প্রবীর রায়চৌধুরীর পর ‘অপরাজিতা তুমি’র প্রদীপ রায়চৌধুরী। ‘বীর’ আর ‘দীপ’-এর মধ্যে তফাত ততটাই যতটা কলকাতা আর সান ফ্রান্সিসকোয়। প্রায় সংলাপহীন, নীরব অভিনয়। শরীরী ভাষা আর চোখের শব্দে প্রদীপের ভাল মন আর অ-ভাল শরীরের দ্বন্দ্ব, পাপবোধ, অসহায়তা বাঙ্ময়। ‘২২শে...’র চার অক্ষুরে পুলিশ অফিসারের পর এই প্রসেনজিৎকে দেখা
একটা অভিজ্ঞতা।
অভিজ্ঞতা বাংলা ছবিতে আনকোরা, দক্ষিণের দুই অভিনেত্রীকে দেখাটাও। পদ্মপ্রিয়া আর কমলিনী। অভিনয় ব্যপারটা যে সূক্ষ্ম, জীবনের কিছু অনুভূতিরই মতো তা এঁদের দু’জনকে দেখে আবারও বিশ্বাস হয়। দাগ কেটে যান চন্দন রায় সান্যাল-ও।
সান ফ্রান্সিসকোয় তোলা একটা গোটা বাংলা ছবি। রঞ্জন পালিতের ম্যাজিক সিনেমাটোগ্রাফি। অবাক লাগে। গর্বও হয়। গর্ব হয় শান্তনু মৈত্রর সুর নিয়ে। তৃপ্তি জাগে চন্দ্রিল-অনিন্দ্যর কলমে। বাংলা ছবিতে অর্থবহ ভাল গান ফিরিয়ে আনার যে ধারা এঁরা সকলে তৈরি করেছিলেন তা এ ছবিতেও অটুট রাখতে পেরেছেন বলে।
আর গর্ব হয় এটা দেখে যে আধুনিকতার অর্থ, নারী স্বাধীনতার নির্যাস শুধু উচ্চকিত চিৎকার, বিকট শরীরী অঙ্গভঙ্গি, মানবিকবোধের ‘ফ’কারান্ত জলাঞ্জলি নয়, সেটা বোঝার মতো পরিণতমনস্ক হচ্ছে বাংলা সিনেমা। |
|
|
|
|
|