মনোরঞ্জন ২...
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ট্রেডমার্ক বুদ্ধদেব
ইঁদুরের বাবা কই? ইঁদুরের বাবা? খোঁজ...খোঁজ। প্রায় জনা ৫০ লোকের মাঝখান থেকে কোত্থাও ইঁদুরের বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে দেখা দিল সে। ছোট্ট-খাট্টো মানুষ। গেঞ্জি আর গুটিয়ে-পরা লুঙ্গি। দু’হাতে পুরু দস্তানা। তার মধ্যে ধরা লোহার শিক-দেওয়া বড় কাঠের বাক্স। ভেতর থেকে উঁকি মারছে চিকচিকে চোখের এক ডজন ইঁদুর! এ হেন ‘ইঁদুরের বাবা’র রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হাঁ-হাঁ করে উঠে সবাই তাকে রাস্তা ছেড়ে দিল। বাবাটি মাঠের মধ্যে বাক্স নামিয়ে, সাবধানে এক খানা ইঁদুর বের করে তাকে একটা কাঠের পোলে বাঁধা লাল টুকটুকে ডাক-বাক্সের ভেতর রাখল। তার পর ডালা বন্ধ করে সরে দাঁড়াল। শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়।
রেডি? ক্যামেরা। রোলিং। অ্যাকশন!
অ্যাকশন? কীসের অ্যাকশন? ইঁদুর অ্যাকশন দেবে? আহা, তা কেন? গুটি গুটি পায়ে হাজির গ্রামের পোস্টমাস্টার। গম্ভীর। পুরুষ্ট ঝাঁটা-গোঁফ। খাটো করে পরা আধ-ময়লা ধুতি, ফতুয়া। খুলছেন ডাকবাক্সের চিলতে দরজা। ওরে বাপ রে! উঁকি দিয়েই তিন লাফে পেছনে!
কাট। কাট।
‘‘অভিব্যক্তিতে মজাটা আসছে না,’’ বললেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। মনিটরে চোখ রেখে। কাশির দমকে কথা বলতে প্রায় পারছেনই না। এক কুচি আদা মুখে পুরে উঠে এলেন চড়াই ধরে। পুরুলিয়ায় চাষমোড়ের ধু-ধু প্রান্তর। বিশাল ক্যানভাস জুড়ে চড়াই-উৎরাই। স্প্যানিশ চিত্রগ্রাহক দিয়েগো লিয়ানস ক্যামেরা ছাড়তে তাতে চোখ রাখলেন বুদ্ধদেব। কাঠের পোল-এর দূরত্ব পাল্টালেন।
আবার অ্যাকশন। আবার কাট। “উঁহু, ভাল লাগছে না।” প্রায় চার বারের বার পোস্টমাস্টারের অভিব্যক্তিতে হাসিতে ফেটে পড়ল গোটা ইউনিট। “ওকে,” বুদ্ধদেবের পাস মার্কস। শেষ হল ‘শেষ চিঠি’র আর একটা দৃশ্য।
চাষমোড়ের এই অংশটার নাম নাকি বুদ্ধ ডুংরি! বলছিলেন ইউনিটের কয়েক জন লোকাল লোক। কারণ এলাকাটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের অতি প্রিয় শু্যটিং স্পট। ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘উত্তরা’, ‘জানালা’র শু্যটিং করেছেন এই এলাকায়। শু্যটিং করে গেছেন রাজ চক্রবর্তীও। ‘দুই পৃথিবী’র।
গ্রাম চাকোলতোল। তার পর ডুঁড়কু। কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই সব জায়গা ছিল বুদ্ধদেব এবং রবীন্দ্রনাথের কব্জায়। সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের ১৩টি কবিতা নিয়ে ছবি করছেন বুদ্ধদেব। ‘কৃষ্ণকলি’ থেকে ‘শেষ চিঠি’, ‘মুক্তি’, ‘পুকুরধারে’, ‘ক্যামেলিয়া’, ‘ফাঁকি’, ‘বাঁশি’, ‘বাঁশিওয়ালা’, ‘ইস্টিশন’, হয়ে ‘হঠাৎ দেখা’, ‘পত্রলেখা’, ‘এক গাঁয়ে’ এবং ‘বাসাবাড়ি’। হিন্দিতে। সে জন্যই তিনি গিয়েছিলেন সদলবলে পুরুলিয়া। তা জনপ্রিয় উপন্যাস বা নাটক ছেড়ে কবিতা কেন? “এই সব কবিতা যে সব ইমেজের জন্ম দিয়েছে, তা আমার ভাবনার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সেই জন্যেই এগুলো বেছেছি। আমি সাংঘাতিক আনুগত্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ করতে চাই না। তিনি তো তাঁর মতো করে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনই। কিন্তু ছবিতে ডুব দিতে হলে আমাকে আমার ভাবনা নিয়ে ডুব দিতে হবে,” ব্রেকফাস্টের ফাঁকে বললেন বুদ্ধদেব। গঙ্গাফড়িং, প্রজাপতিদের সঙ্গে খোলা আকাশের নীচে ঘাসের ওপর লুচি-আলুর তরকারি-মিষ্টির ব্রেকফাস্ট।
রিমঝিম গুপ্ত
জয়া শীল ঘোষ
ব্রেকফাস্ট-শেষে আবার শট। সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটে।
তা, এই ধরনের কাজে ডুব দিয়ে কী মনে হল? “রবীন্দ্রনাথের সময়কার বোধ বা ভাবনা যদি এই সময়কার ভাবনার সঙ্গে ছবিতে না মেশে তাহলে সেই কাজটা একটা নির্দিষ্ট সময়-সীমার মধ্যে আটকে যাবে। সেটা চাই না। মানে ‘চার অধ্যায়’ করলে এখনকার মতো করেই করতে হবে। বা ‘নষ্টনীড়’। যদিও সত্যজিতের ‘চারুলতা’ই আধুনিকতম বলে মনে হয়। কিন্তু চেষ্টা অবশ্যই করা উচিত। আমিও তাই করছি। কবিতাগুলোর নির্যাস এক রেখে বিশ্লেষণটা বদলে দিয়েছি,” বলছেন তিনি।
কিন্তু পুরুলিয়ায় কী এমন আছে যা বার বার টেনে আনে পরিচালক বুদ্ধদেবকে? “কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে এক বার গেলে মনে হয়, আর ফিরে যাবার কী দরকার? উত্তরবঙ্গে প্রচুর শু্যটিং হয়, কিন্তু আমার অত সুন্দর জায়গা ভাল লাগে না। বরং পুরুলিয়ার রুক্ষতার মধ্যে এক অদম্য টান খুঁজে পাই।” পুরুলিয়া ছাড়া শু্যটিং হয়েছে চন্দননগর আর কলকাতায়।
সেই পুরুলিয়াতেই গরুর গুঁতো খেয়ে টিটেনাস নিতে হয়েছিল রিমঝিম গুপ্তকে। ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার নায়িকা। “হয়েছে কি, গরুটা কিছুতেই যেতে চাইছিল না। জোর করে দড়ি ধরে টান মেরেছি, তেড়ে এসে মারল এক ঢুঁ! ব্যস, সোজা টিটেনাস,” বলছেন রিমঝিম। ২০ মিনিটের ‘কৃষ্ণকলি’-তে রিমঝিম তিনটে চরিত্রে অভিনয় করছেন। তিনটে আলাদা চরিত্র। যাদের মধ্যে কবি খুঁজে ফেরেন তাঁর চিরচেনা ‘কালো হরিণ চোখ’। রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে অভিনয় করছেন সুমন্ত। আর সারা অ্যাখ্যান জুড়ে সুচিত্রা মিত্র-র ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,’ স্বমহিমায় ছেয়ে রয়েছে।
তা এই চরিত্রের জন্যে কী কী করেছেন রিমঝিম? “অনেকটা সময় নির্বাক অভিনয় করতে হয়েছে। বেশ কঠিন। রোদে নিজেকে পুড়িয়েছি। বুদ্ধদা মেক-আপের ঘোর বিরোধী। সে রকম ভাবেই সাজতে হয়েছে। ধ্যাবড়া করে কাজল, আলুথালু শাড়ি...,” বলছেন কৃষ্ণকলি।
একই কথা ‘বাঁশিওয়ালা’ এবং ‘হঠাৎ দেখা’র নায়িকা জয়া শীল ঘোষের মুখেও। ‘আমার একটা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য ছিল। শট শুরু হওয়ার আগে কাকু (বুদ্ধদেব) একটা ভিটামিন ট্যাবলেট পাঠিয়েছিলেন। যাতে ঠান্ডা না লাগে। কাকুুর সঙ্গে শেষ কাজ করেছিলাম সেই ১৯৯৯-এ। ‘উত্তরা’র সময়। ‘বাঁশিওয়ালা’ করতে গিয়ে আমি পুরুলিয়ার আকাশে-বাতাসে সেই পুরনো গন্ধটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। পেলামও। দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা!” জয়ার চরিত্রও গ্রামের মেয়ে। শান্তা। স্বামীর সঙ্গ না পাওয়া, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকা নিঃসঙ্গ নারী। তার সব কথা পোষা টিঁয়াপাখির সঙ্গে। এমন একটা চরিত্র যার রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত খুব একটা অদল-বদল হয়নি। এই নিঃসঙ্গতার মাঝেই আসে এক বাঁশিওয়ালা। যার বাঁশির সুর তার মধ্যে এক নতুন চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে। “কিন্তু যে ভালবাসার জন্যে তুমি পাগল সেটা পাওয়া হয়ে গেলে কী পড়ে থাকে? এটাই আমার চরিত্রের টানাপোড়েন,” বলছেন জয়া। জয়া আছেন ‘হঠাৎ দেখা’-তেও।
জয়া মগ্ন নিজের ‘বাঁশিওয়ালা’য়। আর পরিচালক? তাঁরও তো একটা নিজস্ব বাঁশিওয়ালা আছে। যার টানে তিনি চোখ সরাতে পারেন না মনিটর থেকে।
সে মনিটরে ফুটে উঠছে গোধূলি বেলায় গ্রামবাংলার নানা রং, রূপ, তার নিজস্ব স্বাদ-গন্ধ নিয়ে।
যা হলমার্ক ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’।

ছবি: স্বরূপ দত্ত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.