মনোরঞ্জন ১...
ব্রহ্মাস্ত্র ১২
০১১ সালটা বাংলা ছবির জন্য একটা দুর্দান্ত বছর ছিল। বাঙালি দর্শক আবার বাংলা ছবি দেখতে শুরু করেছেন। টালিগঞ্জের কিছু ধারার ছবি সম্বন্ধে যে দূর-ছাই ব্যাপারটা ছিল, সেটাও অনেকটাই কেটে গেছে।
‘ইচ্ছে’র মতো একটা খুব কম বাজেটের ছবি অবাক করা ব্যবসা করেছে, ‘২২শে শ্রাবণ’-এর মতো একটা ক্রাইম থ্রিলার ব্লকবাস্টার হয়েছে, দেব-এর হোর্ডিং-য়ে শহর ছেয়ে গেছে।
সত্যি! আলো আর আলো।
কিন্তু আলোর তলাতেই তো থাকে অন্ধকার। টলিউড জমিয়ে দিয়েছে গত বছরটা।
কিন্তু তার পাশাপাশিই আছে বেশ কিছু ধূসর জায়গা। সেগুলো নতুন বছরের শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার।
যা বলব সেটা একেবারে মন থেকে বলব। ২৮ বছর কাজ করছি। সুতরাং এই ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা যে আছে, সেটা এতদিনে বোধহয় প্রমাণিত। তাই, এ বছর আরও উন্নতির জন্য টলিউডের কোন পথে এগোনো উচিত, তার ব্লু প্রিন্ট... আমার মতে

অভিনেতারা, সারাক্ষণ স্ট্র্যাটেজি পাল্টাতে থাকুন
গত দু’টো বছর আমার দারুণ কেটেছে। ‘মনের মানুষ’, ‘অটোগ্রাফ’, ‘২২শে শ্রাবণ’। সব ব্লক বাস্টার হিট। এই ছবিগুলো মাল্টিপ্লেক্স আর সিঙ্গল-স্ক্রিনের মধ্যে তফাতটা মুছে দিয়েছে। কিন্তু আমার তাতেও মন ভরছিল না। মনে হচ্ছিল, এটা যথেষ্ট নয়। তাই খুব সচেতনভাবে স্ট্র্যাটেজি বদলালাম আবার। ট্র্যাক পাল্টালাম। বাণিজ্যিক ছবিতে ফিরলাম। যে ধরনের বাণিজ্যিক ছবি আমি বেশ কিছু দিন করছিলাম না। এই যে নিজেকে সারক্ষণ পাল্টে চলা, বদলে ফেলাএটা আমি দারুণ উপভোগ করি। আর সেই কারণেই রাজীবের ছবিটায় কাজ করছি।
নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এই পাল্টে ফেলাটা আমার সত্যি ভাল লাগে। তা ছাড়াও রাজীবের ছবিটায় হ্যাঁ বলার আরও একটা কারণ আছে। আগের যে তিনটে ছবির কথা বললাম সেগুলো আমাকে নতুন ধরনের দর্শক দিয়েছে। আমার মনে হল, এ রকম একটা অবস্থায় যদি আবার একটা ভাল বাণিজ্যিক ছবি করতে পারি তা হলে আমার দর্শক সংখ্যা (যেটা এখন শহর আর গ্রাম মেশানো) সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। যাতে ইন্ডাস্ট্রিরই সুবিধে হবে।
এখানে একটা কথা বলতে চাই। আমার থেকেও বড় নায়ক এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। কিন্তু আমাকে যেটা টিকিয়ে রেখেছে সেটা হল নিজেকে এই ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া। যে পাল্টে যাওয়াটা আমি ক্রমাগত করতে থাকি। এই যেমন, রাজীবের ছবিটা শেষ করে গৌতম ঘোষের ছবির কাজ শুরু করব। যেটায় আমি আর সৌমিত্রকাকু (চট্টোপাধ্যায়) আছি। তার পর সৃজিতের পরের ছবিটায় আছি।
এটা চলতেই থাকবে। যে দিন এই পাল্টে যাওয়াটা থেমে যাবে সে দিনই আমার অভিনেতা সত্তাটার মৃত্যু ঘটবে। শুধু আমি কেন, সব অভিনেতারই অক্সিজেন দরকার। অভিনেতারা যদি চেনা ছক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, প্রযোজকরা নতুন বিষয় নিয়ে ছবি করার কথা ভাববে। তাতে ইন্ডাস্ট্রিরই সুবিধা।
পরিকাঠামোর ওপর জোর দিন, এমন একটা ফিল্ম সিটি গড়ে তুলুন যেটা পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠে
টালিগঞ্জ এখন একটা দারুণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মানে ধরুন, নতুন আইডিয়ার কথা যদি বলেন আমাদের কাছে এমন সব গল্প, ভাবনা আছে যা বলিউডের কাছেও নেই। কিন্তু পরিকাঠামোর দিকটা এ বার আমাদের আরও বেশি করে ভাবতে হবে।
এটা ঠিক যে কলকাতার আশেপাশে কয়েকটা ফিল্ম সিটি গড়ে উঠছে এবং যাঁরা সেগুলো গড়ে তুলেছেন তাঁদের কুর্নিশ করেও বলছি আমাদের দরকার এমন ফিল্ম সিটির যেটা পর্যটক টানবে। পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে। হায়দরাবাদের কথা ধরুন। আজকাল কেউ হায়দরাবাদে গেলে রামোজি রাওয়ের ফিল্ম সিটি ঘুরতে যাবেই। যেটা থেকে ওদের একটা বিরাট রেভিনিউ আসে। আমরা সেটা ছাড়ব কেন? যাঁরা কলকাতায় ফিল্ম সিটি বানাচ্ছেন তাঁদের বলব প্লিজ এটা মাথায় রাখুন। যাতে আপনার শু্যটিং স্পটটায় শু্যটিংও হয়। আবার সেটা দেখে দর্শক টাকাও দিয়ে যায়। এতে সারা দেশেও কলকাতাকে ঘিরে একটা আকর্ষণ তৈরি হবে। আর বড় প্রোডাকশন হাউসরাও এখানে কাজ করতে আসতে চাইবে।
নতুন ১০০টা থিয়েটার তৈরি হোক আগামী তিন বছরে
ফিল্ম সিটি বানানোর থেকেও বেশি দরকার আগামী তিন বছরের মধ্যে গোটা রাজ্য জুড়ে ১০০টা নতুন থিয়েটার বানানো। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ, তাঁকে বলব এই দিকটায় একটু নজর দিতে।
এই থিয়েটারগুলোতে বাংলা ছবিকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। তার মানে এই নয় যে এরা হিন্দি ছবি দেখাতে পারবে না। ও রকম সংকীর্ণ মনোভাব নিয়ে কোনও ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। তবে হ্যাঁ, বাংলা ছবিকে এই থিয়েটারগুলো একটু বেশি সুবিধে দেবে সেটা চাইব। যেমন করেন অরিজিৎ দত্ত। ওঁর প্রিয়া বা স্টার থিয়েটারে। এটা করতে পারলে বাংলা ছবির বাণিজ্য-মডেলটাই পুরো পাল্টে যাবে। টাকা আসতে শুরু করবে অনেক বেশি। ইন্ডাস্ট্রিকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার কাজটাও আরও সহজ হয়ে যাবে।
বড় কিছু ভাবুন, ব্র্যান্ড টালিগঞ্জ সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করুন
আমার কর্মজীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে টালিগঞ্জ সম্পর্কে একটা অদ্ভুত নিচু মনোভাব লক্ষ করেছি। পজিটিভ কিছু যেন ভাবতেই পারত না লোকে এই ইন্ডাস্ট্রিটাকে নিয়ে। ভাগ্য ভাল গত তিন বছরে সেই মনোভাব অনেকটাই পাল্টেছে। ফিকি (এফআইসিসিআই)আমাদের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। মিডিয়াও নানা ভাবে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। হঠাৎই যেন টালিগঞ্জ সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সেটা একটা বিরাট ব্যপার।
দশ-দশটা বছর দেখেছি, আউটডোর মানে ফলতা। আমি যখন ঠিক করলাম সান্দাকফুতে শু্যট করব লোকে আমার পেছনে বলেছিল, “বুম্বার সাহস কম নয়। সান্দাকফুতে বাংলা ছবির আউটডোর!” আগে আমি সেই ধরনের ছবি করতাম যার বাজেট ছিল ১৪ লক্ষ টাকা আর আমি পেতাম ২৫ হাজার টাকা।
সেই সব দিন দেখেছি বলেই আজ গর্ব হয় ‘অপরাজিতা তুমি’র মতো ছবিতে কাজ করতে। যেখানে গোটা ছবিটা আমরা সান ফ্রান্সিসকোয় শু্যট করেছি। সান ফ্রান্সিসকোর টপ শট নিয়েছি হেলিকপ্টারে। বাংলা ছবি! ভাবতে পারেন? এই ভাবনার পুরো কৃতিত্বটাই অবশ্য টোনির (অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী) আর ওর প্রযোজক মুম্বইবাসী সুজিত সরকারের। কিন্তু এই যে সুজিত মুম্বই থেকে একটা বাংলা ছবির পেছনে এত টাকা ঢালতে রাজি হয়েছে তার কারণ কিন্তু বাংলা ছবি ঘিরে সাম্প্রতিক এই বাZ। লোকের আগ্রহ বেড়ে গেছে।
আরও উদাহরণ দেব? শুনুন তা হলে। নীরজ পাণ্ডের পরের ছবিতে কাজ করছি আমি। নীরজ পাণ্ডে হল সেই ছেলে যে ‘আ ওয়েডনেসডে’র মতো ছবি বানিয়েছে। এবং ও ওর পরের ছবিটা বাংলায় বানাতে চায়। এই পরিবর্তনটাতেই আমাদের গর্ব হওয়া উচিত।
কাজ জানা লোকজনদের বাছুন
এই ক’বছরে বাংলা ছবির ধরন বদলেছে। সেই সঙ্গে ছবি যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের ধরনটাও বদলেছে। আজকাল যে সব ছেলেমেয়ে ফিল্ম বা চ্যানেলগুলোয় কাজ করে, তারা যথেষ্ট শিক্ষিত, চালাকচতুর। ঝরঝরে ইংরেজিতে সারাক্ষণ কথা বলে। কিন্তু এই সব ছেলেমেয়ের মধ্যে থেকে সত্যি কাজ জানে যারা, তাদের বেছে নিতে হবে। এবং বাছার পর তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে কাজটা করাতে হবে। না হলে কিন্তু ট্যালেন্ট ধরে রাখা যাবে না। আমার মনে আছে, পার্থ ঘোষের সঙ্গে একটা ছবি করার সময় রাজীব সহকারী পরিচালক ছিল। ওকে দেখে মনে হয়েছিল ছেলেটা কাজটা খুব মন দিয়ে করে। তখন আমি পরিচালক রানা (অভিজিৎ বসু) আর সুদেষ্ণা (রায়)-কে বলেছিলাম ছেলেটাকে কাজ শেখাতে। আর আজ? রাজীবের তৈরি ছবির সাফল্যই বলে দেবে ওর প্রতি নজর দেওয়ার ডিসিশনটা একদম ঠিক ছিল। প্রযোজক আর পরিচালকদের ক্ষেত্রে এই ট্যালেন্ট-স্পটিংটা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।
বড্ড বেশি ছবি হচ্ছে। সংখ্যাটা কমানো উচিত
আমি সত্যি মনে করি এখন বড্ড বেশি বাংলা ছবি হচ্ছে। এই যে ১৫ লাখ থেকে ৫০ লাখের মধ্যে ছবিগুলো হচ্ছে তাতে ইন্ডাস্ট্রির কোনও লাভ হচ্ছে না কিন্তু। এগুলো আমার কাছে একটু লম্বা টেলিফিল্ম ছাড়া কিচ্ছু না। আমাদের মাথায় রাখা উচিত ফিচার ফিল্ম কিন্তু একটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যপার। টেলিফিল্মের মতো করে একটা ফিচার ফিল্ম শু্যট করা যায় না। এই ছোট ছবিগুলোর প্রযোজকদের গৌতম ঘোষের উদাহরণটা মাথায় রাখা উচিত। ‘কালবেলা’ একটা টেলিফিল্মই তো ছিল। কিন্তু শু্যট করার সময় গৌতমদা এমন ভাবে শু্যট করেছিলেন মানে ফিচার ফিল্মের ফ্রেম, সেই ধরনের ভাবনা। ফলে দর্শকের ছবিটা দেখতে এত ভাল লেগেছিল।
সৃজিত মুখোপাধ্যায় যখন আমার কাছে ‘অটোগ্রাফ’এর গল্পটা বলতে এসেছিল তখনই বলেছিল, ও একটা বড় ছবি বানাতে চায়। এই অ্যাটিটিউডটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুদা’, রীনাদি’, টোনি, রাজএরা কিন্তু কখনও ছোট করে ভাবে না। এরা ফিচার ফিল্মের স্কেলে ভাবতে পারে। সেই ভাবে না ভেবে এই এত ছবি ইন্ডাস্ট্রির কিন্তু বড় বেশি ক্ষতি করে দিচ্ছে।
ডিভিডি আর স্যাটেলাইট রাইট নিয়ে এত হইচই। কিন্তু বক্স-অফিসে আসলে কত টাকা উঠছে?
যে কথা বলছিলাম, এটা তারই আরেকটা দিক। প্রযোজকরা আজকাল ছবি তৈরির আগেই সে ছবির ডিভিডি আর স্যাটেলাইট বিক্রি করে কত উঠবে তার হিসেবটা আগে করছেন। এটা কিন্তু অদূরদর্শিতার প্রমাণ। ইন্ডাস্ট্রিই বলুন আর একটা ছবিদু’টোরই লাভ হবে যখন বক্স অফিসে ব্যবসাটা ঠিকঠাক হবে। সিনেমা হলে না চললে ছবিটার কথা কেউ মনে রাখবে না। কিন্তু প্রযোজকরা আজকাল ব্যবসার এই দিকটাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। তাঁরা কেবল স্যাটেলাইট আর ডিভিডি রাইট বেচা নিয়ে মাথা ঘামান। কিন্তু তাঁরা যেটা মনে রাখছেন না, সেটা হল আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও যথেষ্ট চালাক হয়ে গিয়েছে। তারাও কিন্তু আর খারাপ ছবির পেছনে টাকা ঢালতে প্রস্তুত নয়। তাই যাঁরা ছবি তৈরির আগে স্যাটেলাইট আর ডিভিডি রাইট নিয়ে মাথা ঘামান, সেই সব প্রযোজকের কাছে আমার একটাই অনুরোধএমন একটা ছবি বানান, যার আসল ব্যবসাটা হবে বক্স অফিসে। সেটা না পারলে কিন্তু লম্বা সময়ের জন্য ছবি প্রযোজনার ব্যবসাটা করতে পারবেন না।
একটা ফিল্ম চেম্বারের ভীষণ দরকার
দক্ষিণের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো কেন এত সফল জানেন? কারণ ওখানে প্রত্যেকটা প্রাদেশিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা করে ঠিকঠাক ফিল্ম চেম্বার আছে। আমি এখানে অনেককে বলেছি যে আর দেরি না করে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্যও একটা ফিল্ম চেম্বারের মতো কিছু তৈরি করা উচিত। ঠিক যেমন তামিল, তেলুগু ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। আমাদের এখানে এমন চেম্বার হলে, সেখানে কারা থাকতে পারে? উদাহরণস্বরূপ, সেখানে টোনি, সৃজিত (মুখোপাধ্যায়), শ্রীকান্ত (মোহতা)-রা থাকতে পারে। ওরা ছাড়াও বাংলা সিনেমা নিয়ে যাঁদের সুদূরপ্রসারী কার্যকরী ভাবনাচিন্তা আছে, তাঁরাও থাকুন। এবং তাঁরা একসঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির মঙ্গলের জন্য কাজ করুন। এ ছাড়া ইন্ডাস্ট্রিটা ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারবে না।
সেরাদের জন্য চাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বীকৃতি
টালিগঞ্জ এত ভাল করছে। আমার মনে হয় এটাই সেরা সময় সরকারি পর্যায়ে একটা পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। শুধুমাত্র বাংলা ছবির জন্য। একটা কথা বলি। নিজের লোকেদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়াটা যে কোনও অভিনেতা বা কলাকুশলীর সারা জীবনের স্বপ্ন। সে রকম একটা পুরস্কার এঁদের আরও বহু দূর নিয়ে যাবে। আমি বরাবর বলে এসেছি, টালিগঞ্জেই সব সেরা কলাকুশলীরা আছেন। আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না এ রকম একজন টেকনিশিয়ান আমাদের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পেলে কতটা পুলকিত হবেন। একভাবে সেটাও ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেকটাই সাহায্য করবে।
টেলিভিশন আর সিনেমার মধ্যে একটা সাযুজ্য দরকার
সারা বিশ্বে টেলিভিশন আর সিনেমার মধ্যে একটা সাযুজ্য তৈরির প্রচণ্ড চেষ্টা চলছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার কোনও অস্তিত্ব ভাবাই যায় না। আর এ জন্যই আমার রাজ চক্রবর্তীকে নিয়ে এত গর্ব হয়। রাজ এখন সিনেমাও বানাচ্ছে, পাশাপাশি টেলিভিশনের জন্য সিরিয়াল প্রযোজনা-পরিচালনাও করছে। আমার যেটা ভাল লাগছে, তা হল পরিচালক হিসেবে সিনেমার যে টেকনিকগুলো ও শিখেছে, টেলিভিশনে সিরিয়াল তৈরির সময় সেগুলোকে ও বুদ্ধি করে কাজে লাগাচ্ছে। রাজ এই দরকারি তালমিলটা করে ফেলেছে। টেলিভিশনের সিনেমা থেকে আরও অনেক কিছু শেখার আছে। তার একটা উদাহরণ দিই।
সেই কবে থেকে টেলিভিশন সিরিয়াল মানেই হল স্টুডিয়োর মধ্যে শু্যট। যখনই সিরিয়াল দেখতে বসতাম, আমার কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে যেত। সে কারণে আমার প্রযোজনা সংস্থা আইডিয়াজ যখন টেলিভিশন সিরিয়াল করবে ঠিক করল, আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম‘বাংলা সিরিয়ালে আকাশ দেখতে চাই’। আমরা আউটডোর শু্যটিং শুরু করলাম। দর্শকদের সেই খোলামেলা ব্যাপারটা ভাল লাগল। আর আজ দেখুন, কত সিরিয়ালেরই তো আউটডোর হচ্ছে। কিন্তু আমি কোথা থেকে শিখলাম কম বাজেটে আউটডোর ম্যানেজ করা? আমায় এই ‘সস্তায় পুষ্টি’র আউটডোর দেখাতে শিখিয়েছে আমারই করা সেই ১৪ লাখ টাকা বাজেটের বাংলা ছবিগুলো। আমি জানি ঠিক কোথায় ‘চিট’ করে, কত কম টাকায় আকাশ দেখানো যায়, আউটডোরে কী করে শিল্পীদের ম্যানেজ করতে হয়।
সিনেমার স্টারডমকে টেলিভিশনের কাজের প্রচারে লাগানোটাও এখানে একটা স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। আমি নিজে যেমন, আইডিয়াজ-এর টেলিভিশনের কাজগুলোকে আমার তারকাসত্তা দিয়ে প্রোমোট করছি। আগামী সোমবার আমাদের সিরিয়াল ‘কণকাঞ্জলি’র বড় মেয়ে শ্রেয়ার বিয়ের টেলিকাস্ট। সেই প্রোমোটায় আমি নিজে বলছি, “শ্রেয়ার বিয়ে। আপনারা সকলে আসবেন।”
টেলিভিশন আর সিনেমার মধ্যে এই তালমিলটাই আগামিদিনে প্রযোজকদের কাছ থেকে আশা করব।
নতুনদের কাছ থেকে শিখুন, যৌবনকে আলিঙ্গন করুন
অনেক বয়ষ্ক অভিনেতাদের দেখেছি বলছেন, ‘আমাদের সময় সব কিছু কী দারুণ ছিল। আর এখন সব কিছুই যা-তা।’ আমি এই মনোভাবটাকে একেবারে সহ্য করতে পারি না। সত্যি বলতে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি তো প্রতিদিন নতুনদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখছি। চন্দন রায় সান্যাল‘অপরাজিতা তুমি’-তে আমার সহ-অভিনেতা। একসঙ্গে কাজ করতে করতে ওর কাছ থেকে কত কিছু শিখলাম। আবির (চট্টোপাধ্যায়) আর পরম (ব্রত)-এর ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। এরা নতুন ছেলে। এদের মাথায় নতুন-নতুন আইডিয়া। সারা বিশ্বের সেরা সিনেমার সঙ্গে এরা পরিচিত। ওদের বয়সে একটা ভাল বিদেশি ছবি দেখতে গেলে এক বছর অপেক্ষা করতে হত আমাদের, কবে ভিএইচএস-টা বেরোবে। আজকাল সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যায়। তা হলে আমি এদের কাছ থেকে শিখব না কেন? আমি তো ওদের দেখে নিজেকে নিজের মতো আধুনিক করে নিয়েছি।
মুম্বইতে কী হয় দেখুন। ওখানে মাত্র ২২-বছর বয়সে অয়ন মুখোপাধ্যায়ের মতো একটি ছেলে একটা ছবি পরিচালনা করে ফেলছে। বয়সটা তাই আর আজ কোনও ফ্যাক্টর নয়। আর দর্শকের চাহিদা যে পাল্টাচ্ছে, সেটাও তো স্বাভাবিক। এই নতুন দর্শককে ধরার জন্য চাই নতুন পরিচালক। কারণ তারা জানে টার্গেট অডিয়েন্সকে কী ভাবে ধরতে হবে। এখন ইন্ডাস্ট্রির মূলমন্ত্র কী হওয়া উচিত জানেন? চলো, যৌবনকে আলিঙ্গন করো।
বড় প্রযোজকদের আক্রমণ করাটা বন্ধ করুন
এই যেমন ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। বহু দিন ধরে ওদের বিরুদ্ধে বাকিরা ঊষ্মা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এটা ঘটনা, যে সাফল্য শত্রু তৈরি করে। কিন্তু চারিদিকে যা দেখছি, তাতে আমি বেশ বিরক্ত। আমার সঙ্গে সব প্রযোজকেরই সম্পর্ক ভালভেঙ্কটেশ, সুরিন্দর ফিল্মস বা এসকে ফিল্মস। এটা মনে রাখতে হবে যে সবাই যদি উন্নতি করে, আমারও উন্নতি হবে। এটাই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত সবার মনে রাখা দরকার।
আমি কিন্তু মণি (মহেন্দ্র সোনি) আর শ্রীকান্তকে সেদিন থেকে চিনি যেদিন ওদের কেউ চিনত না। ইন্ডাস্ট্রিটা কী ভাবে চলে সেটা ঠিকঠাক জানতে রাতের পর রাত জাগত ওরা বিভিন্ন লোকেশনে। ওরা কিন্তু প্রথম থেকেই লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চেয়েছিল। চারটে ছবি করে পালাবার জন্য আসেনি।
আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ‘সখী তুমি কার’, ‘রণক্ষেত্র’ বা ‘বিদ্রোহ’র মতো ছবির সঙ্গীত পরিচালক কে জানেন? দেবজ্যোতি মিশ্র। কিন্তু ছবিগুলোর সুর সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল। কেউ মনে রাখেনি। ভেঙ্কটেশ কিন্তু রেখেছিল। এবং দেবুকে সমানে সাপোর্ট করে গিয়েছিল। আর আজ? দেবুর সুর করা ‘অটোগ্রাফ’-এর গান ফাটিয়ে হিট। একজন বড় প্রযোজকের কাছ থেকে তো এটাই আশা করা উচিত। পয়সা বানানোটা খারাপ ব্যাপার নয়। কিন্তু তার পাশাপাশি বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। সেটাই আমাদের সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

এই ১২-পয়েন্ট অ্যাজেন্ডাটা যদি সামনে রাখা যায়, তা হলেই মনে হয় আগামী ১২ মাসে ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে যেতে পারবে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা একটা বিরাট সুযোগ। একটাই কথা-- লক্ষ্যটা যেন হারিয়ে না যায়। আর এই কথাগুলো কিন্তু এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কত বছর? একটু হাল্কা ভাবে বোঝাই।
একটা ছবিতে আমি নায়ক ছিলাম আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ছিল নায়িকা। সেই ছবিতে আমাদের মেয়ের চরিত্রে কে অভিনয় করেছিল জানেন? আপনাদের আজকের নায়িকা শ্রাবন্তী। কত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে আছি, বোঝা গেল?
আপনাদের ২০১২ মুবারক। আশা করব টলিউড আর বাংলা ছবি আরও উচ্চতায় উঠবে এ বছর।

ছবি: অশোক মজুমদার


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.