বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবৎসর শুরু হচ্ছে। তাঁকে স্মরণ করে নানা অনুষ্ঠান হবে। এই বছরভরা উদ্যোগ আয়োজনের মাঝে এমন কেউ তো থাকতেই পারেন, যিনি বিবেকানন্দের বাংলা লেখাগুলি পড়তে চান। রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে কিছু ছোট হলেও এই সন্ন্যাসী দীর্ঘজীবী ছিলেন না। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর প্রয়াণ হয়, তখন তিনি চল্লিশও স্পর্শ করেননি। এই স্বল্প দৈর্ঘের পার্থিব জীবনে তিনি বাংলায় খুব বেশি মৌলিক রচনা সম্পাদন করে যেতে পারেননি। বাংলায় লেখা চিঠিপত্র, কিছু কবিতা আর হার্বার্ট স্পেনসারের শিক্ষা বিষয়ক রচনার বাংলা অনুবাদ বাদ দিলে তাঁর নামে প্রচলিত বাংলা বই চারটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, ভাববার কথা, পরিব্রাজক এবং বর্ত্তমান ভারত। কোনও বই আকারে স্থূল নয়। রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের উদ্বোধন কার্যালয় থেকে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনার যে খণ্ডগুলি পাওয়া যায়, তার ষষ্ঠ খণ্ডে এই চারখানি বাংলা বই সন্নিবিষ্ট। আলাদা করে পাওয়া যায় পত্রাবলিও। সেখানে কোন চিঠিগুলি মূলে বাংলায় লেখা ও কোনগুলি ইংরাজি থেকে অনুবাদ করা, তা নির্দেশ করা হয়েছে। বাণী ও রচনায় তাঁর বাংলা কবিতাগুলিও আছে। তাঁর নামে প্রচলিত বাংলা বইগুলি একটা একটা করেও পাওয়া সম্ভব, প্রকাশক: উদ্বোধন কার্যালয়। সেই সব বইতে তাঁর লেখা বিষয়ে প্রয়োজনীয় কিছু টীকা ও তথ্য দেওয়া হয়েছে, বাণী ও রচনাতেও এমন টীকা, তথ্য আছে। এই সব প্রাপ্তির মধ্যেও বিবেকানন্দের বাংলা লেখা পড়তে গেলে কিছু অসুবিধে হয়।
বিবেকানন্দের বাংলা বাণী ও রচনার খণ্ডগুলিতে বিদেশে নানা সময়ে প্রদত্ত নানা বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ রয়েছে। বাণী ও রচনার এই দশটি খণ্ডে স্বামীজির পত্রাবলি সময়ানুক্রমে সাজানো এবং তাঁর বক্তৃতা ও রচনা, কথোপকথন যথাসম্ভব বিষয় অনুযায়ী সাজানো। কিন্তু মুশকিল হল, তাঁর ইংরেজি লেখার যত ভাল বাংলা অনুবাদই করা হোক না কেন, তার মধ্যে বিবেকানন্দের মৌলিক বাংলা লেখার স্বাদ ও শিল্পগুণ সঞ্চারিত করা সম্ভব নয়। বিবেকানন্দ সৃষ্টিশীল বাংলা লেখক ছিলেন না, লেখা তাঁর পেশা বা নেশাও ছিল না। কিন্তু তাঁর বাংলা গদ্যের বিশেষ এক স্টাইল ছিল। বাংলা ভাষায় কেমন করে আমবাঙালির বোধ্য গদ্য লেখা যায়, তা নিয়ে তিনি সচেতন ভাবে চিন্তা করতেন। ওস্তাদি গানের ওপর তিনি যেমন খাপ্পা ছিলেন, তেমনই পণ্ডিতি সন্ধি-সমাস কবলিত গদ্য দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। চলিত আর সাধু দুই ভাষাতেই অবশ্য তিনি লিখতেন। চলিত ভাষার গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় কলকাতার মুখের ভাষা ব্যবহার করেছেন। ব্যঙ্গকৌতুকে, বর্ণনার স্মার্টত্বে সেই চলিত গদ্য বড় রমণীয়, ঝকঝকে। পড়লে কানে মনে লেগে যায়। এই চলিতের পাশাপাশি সাধু গদ্যও লিখেছিলেন তিনি। বিশেষ করে দেশের মানুষকে উদ্দীপিত করে তোলার জন্য ধ্বনি-ঝঙ্কারময় তৎসমবহুল সাধু গদ্যের প্রয়োগ করেছিলেন। গদ্যের এই দুই চালের উদ্দেশ্য দু’রকম: চলিত গদ্যে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছেন, রসিকতা করছেন, আর সাধু গদ্যে দেশের সাধারণ মানুষকে উদ্দীপিত করছেন। এই গদ্যশিল্পী বিবেকানন্দের লেখা পড়তে গেলে আমাদের কিন্তু বাণী ও রচনার ষষ্ঠ খণ্ড অবধি অপেক্ষা করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের লেখা খণ্ডে খণ্ডে বাঙালি ঘরে সাজিয়ে রাখে বটে, কিন্তু তেমন পড়ে না। উল্টে-পাল্টে দেখে। তাই বিবেকানন্দের লেখার ক্ষেত্রে বই দিয়ে ঘর সাজানো বাঙালি ছয় নম্বর খণ্ডখানি পড়ে দেখবে কিনা সন্দেহ। প্রথম একটা-দুটো খণ্ড উল্টে দেখে হয়তো ছেড়ে দেবে। সেখানে বিষয়ের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেকানন্দের ইংরেজি বক্তৃতার বাংলা আছে। কিন্তু সেই বাংলায় তো বিবেকানন্দের গদ্যের ম্যাজিক নেই। তাই মনে হয়, আমবাঙালিকে বিবেকানন্দের বাংলা গদ্যের স্বাদ দেওয়ার জন্যই তাঁর বাংলা রচনাবলির প্রথম খণ্ডে মৌলিক বাংলা গদ্য-পদ্য সাজিয়ে দেওয়া উচিত।
এর থেকেও বড় একটা সমস্যা আছে। বিবেকানন্দের বাংলা লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল উদ্বোধন পত্রিকায়। বিবেকানন্দের পরিকল্পনায় ও ত্রিগুণাতীতানন্দের সম্পাদনায় বিবেকানন্দের জীবৎকালে যে উদ্বোধন প্রকাশিত হত, সেই উদ্বোধন কিন্তু কোনও মতেই উনিশ শতকের সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা ছিল না। এই পত্রিকায় গিরীশচন্দ্র ঘোষের ঝালোয়ার দুহিতা-র মতো উপন্যাস প্রকাশিত হত, অনায়াসে মুসলমান দোকানদার এসেন্সের বিজ্ঞাপন দিতেন, প্রদীপের মতো সাহিত্যপত্রের বিজ্ঞাপন থাকত, প্রকাশিত হত বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা। বাঙালি ব্যবসার উদ্যোগ সম্বন্ধে খবর থাকত। সব মিলিয়ে পড়ার মতো পত্রিকা। ‘বেদব্যাস’ জাতীয় উনিশ শতকীয় হিন্দুত্ববাদী পত্রিকার চেয়ে উদ্বোধন ছিল ঢের এগিয়ে। এ পত্রিকা বাংলা ভাষা নিয়ে যে ভাবনাচিন্তা করত, তার প্রমাণ সম্পাদক ত্রিগুণাতীতানন্দের সাহিত্য-পরিষদ-পত্রিকা (সমালোচনা) নামক লেখাটি। পরিষদের সভাপতি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা বিষয়ে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এটি তার পর্যালোচনা। ত্রিগুণাতীতানন্দের এই কম আলোচিত রচনাটিতে বাংলা ভাষা নিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ মতামত ছিল। বিবেকানন্দের মতোই তিনিও ভাষা ব্যবহারে পণ্ডিতি শুচিবায়ু মানতে নারাজ যাকে লিখব ভাষা যেন সে বুঝতে পারে, বোঝানোর জন্য লেখক স্বাধীন ভাবে যে কোনও শব্দ ব্যবহার করতে পারেন, যুক্তাক্ষরের সংস্কারের তিনি পক্ষপাতী। এই উদ্বোধনে পাশাপাশি প্রকাশিত হত বিবেকানন্দের বর্ত্তমান ভারত ও বিলাতযাত্রীর পত্র। একটির ভাষা সাধু, অপরটির ভাষা চলিত। বিলাতযাত্রীর পত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় পরিব্রাজক নাম নেয়। পত্র জাতীয় সাহিত্য তখন চলিতে লেখাই দস্তুর, রবীন্দ্রনাথও তাঁর পত্র জাতীয় ভ্রমণ বৃত্তান্ত চলিতে লিখেছিলেন। পরে বিবেকানন্দের লেখাটি পরিব্রাজক নাম পাওয়ায় বাংলা ভাষার সমকালীন এই ইতিহাস যেন খানিক ঢাকা পড়ে গেছে। আর উদ্বোধনের পাতায় যে ভাবে বিবেকানন্দের বাংলা লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, পরে বাণী ও রচনায় গ্রহণ করার সময় তার থেকে বিন্যাসগত ও অন্যান্য কিছু বদল করা হয়েছিল। তার পিছনে যে যুক্তিই থাক, এই সব বদল যদি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর তাঁর পূর্বানুমতি না নিয়ে করা হয়ে থাকে, তা হলে লেখার রূপবিন্যাস পূর্বাবস্থাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।
খুব অসম্ভব কাজ কিন্তু নয়। বাংলা ভাষায় লেখা বিবেকানন্দের মৌলিক গদ্য-পদ্যগুলিকে এক সঙ্গে একটি আলাদা খণ্ডে প্রকাশ করতে হবে। তাঁর জীবৎকালে উদ্বোধনের পাতায় যে চেহারায় সেগুলি বেরিয়েছিল, সেই চেহারার বদল নিয়ে বিবেকানন্দের যদি কোনও নির্দেশ না থাকে, তা হলে সেই চেহারা বজায় রাখা চাই। যদি সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির সঙ্গে উদ্বোধনের পৃষ্ঠায় প্রকাশিত লেখার পাঠান্তর থাকে, তা হলে তার উল্লেখ জরুরি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য গবেষকরা রবীন্দ্রনাথের রচনার পাণ্ডুলিপি যে ভাবে অনুমতিসাপেক্ষে দেখতে পান, তেমন ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন। আর মনে রাখতে হবে, বিবেকানন্দ দেশকালনিরপেক্ষ নন। তাঁর ও উদ্বোধন পত্রিকার তৎকালীন ভাষা প্রকল্পের সাপেক্ষে লেখার বিচার করা দরকার। মোদ্দা কথা, তাঁর মতো গদ্যশিল্পীর বাংলা লেখাপত্রের ক্রিটিক্যাল এডিশন চাই।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলা ভাষা সাহিত্যের শিক্ষক |