সাক্ষাৎকার...
অণ্ণা সংসদ-বিরোধী? মানতে প্রস্তুত নই

আশিস: অণ্ণাকে এ বার একটু ক্লান্ত মনে হল। অণ্ণার আসল শক্তি নৈতিক, বলা যেতে পারে, এক ধরনের আত্মিক শক্তি। তাঁর সঙ্গে সেই অর্থে বিশেষ কোনও দলের যোগাযোগ নেই। এক ধরনের সারল্যই তাঁর অস্ত্র।

আশিস: ‘ইনোসেন্স’ শব্দটার কোনও যথাযথ বাংলা হয় কি না, জানি না। ইনোসেন্স অর্থে সারল্যও হয়, অতিসারল্যও হয়। অণ্ণা সরল, এ কথা অনেকেই বলে। কিন্তু, সমস্যা হল, তিনি অতিসরলও বটে। ‘ইনোসেন্স’ই অণ্ণাকে মুশকিলে ফেলল। তিনি রাজনীতির প্যাঁচ পয়জার সে ভাবে রপ্ত করেননি। দলীয় রাজনীতির চালটা ধরতে পারলেন না। ফলে, লোকপাল-এর বিষয়টি নিয়ে যে ভাবে এগোনো উচিত ছিল তিনি সেটা করতে পারলেন না।

আশিস: সমস্যাটা হল, উনি এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত নন যে, আসলে সমস্ত দলই লোকপালের বিপক্ষে। কেউই চায় না, এই ধরনের কোনও একটা নজরদার তৈরি হোক, যে তাদের বিভিন্ন কাজকর্মের খেয়াল রাখবে। অণ্ণা যখন লোকপালের কথা বললেন, সামনাসামনি প্রধানমন্ত্রী জিনিসটা মেনে নিলেন। বিরোধীরাও মেনে নিল। অণ্ণা ভাবলেন, দিন বদলের সূচনা হল বোধহয়। আসলে যে তা হল না, এবং এই পরিস্থিতিতে তা হওয়ারও নয়, সেটা তিনি বুঝতে পারলেন না। সব রাজনৈতিক দলই দলীয় স্বার্থে নির্বাচনী তহবিল বাড়াতে চায়। লোকপাল হলে সেই কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তাই বিরোধিতা। বি জে পি এমন একটা ভাব করল যেন তারা লোকপালের খুবই সমর্থক। অথচ, শেষ পর্যন্ত কুশওয়াহার ক্ষেত্রে দেখা গেল তারাও অন্য দলের মতোই নির্লজ্জ ভাবে অর্থের পূজারি। এবং, শুধু বি জে পি কেন, বিভিন্ন প্রাদেশিক দলও তো লোকপাল-এর বিরুদ্ধেই দাঁড়াল। খেয়াল করে দেখুন, লোকসভায় বিতর্কের সময় লালুপ্রসাদ যাদব যখন লোকপালের বিরুদ্ধে চোখা চোখা বাক্যবাণ প্রয়োগ করছিলেন, তখন সবার মুখেচোখে একটা বিচিত্র, চাপা উল্লাস। লালু স্বয়ং অসম্ভব উঁচু দরের অভিনেতা, ওঁর ব্যাপারটা আলাদা, কিন্তু পুরো কক্ষের উল্লাসটাও চাপা থাকেনি।

আশিস: এই প্রশ্নের উত্তর আমি একটু অন্য ভাবে দিতে চাই। অণ্ণার যে শক্তির কথা একটু আগেই বলছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরি। একটা ‘মরাল পাওয়ার’ থেকে, একটা নৈতিক শক্তির ধারণা থেকেই অণ্ণা হজারের উত্থান। এই নৈতিক শক্তির সঙ্গে কিন্তু দলীয় রাজনীতি, বা সেই ধরনের রাজনীতি থেকে যে সব ক্ষমতা জন্ম নেয়, তার কোনও যোগাযোগ নেই। বরং, বলতে পারেন, এটা এক ধরনের ‘মরাল স্ট্যাচার’, জানি না, এটারই বা ঠিক বাংলা প্রতিশব্দ কী হতে পারে! ‘নৈতিক প্রতিষ্ঠা’ বলা যেতে পারে হয়তো। এটা এক ধরনের সাধারণ নীতিবোধ। সেই নীতিবোধ যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে। আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা মা-ঠাকুমা যা আমাদের শেখান, করতে বলেন, এটা সেই নীতিবোধ। এবং, খেয়াল করলে দেখবেন, সেই নীতিবোধের মধ্যে কিন্তু এক ধরনের কর্তৃত্ববোধ আছে। এবং এর মধ্যে একটা স্বৈরতান্ত্রিক নীতিবোধেরও স্থান আছে। যেন, আমি যা বলছি, তার উল্টো কিছু আবার হতে পারে নাকি? এই বিশেষ ধাঁচটাই অণ্ণা হজারের শক্তির উৎস। তিনি যেন গাঁয়ের মোড়ল। সবাইকে নীতিবোধের প্রথম পাঠটি শেখাতে চাইছেন!
জন-কণ্ঠ? অণ্ণা হজারের সমর্থনে স্বাক্ষর-অভিযান।

আশিস: আমি একমত নই। যে সাধারণ নীতিবোধের কথা বলছিলাম, অণ্ণা হজারের শক্তির আসল ভিত কিন্তু সেটাই। মিডিয়ায় কিছু একটা দেখালেন আর অমনি দলে দলে লোক এসে ভিড় জমাল, একবারও ভেবে দেখল না, কেন এই জিনিসটা হচ্ছে, বা কী হচ্ছে, সেটা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। দ্বিতীয়ত, মিডিয়ার কথা যদি ওঠেই, তা হলে বলব, গাঁধীর ক্ষেত্রেও অনেকটা একই কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীই প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি সুকৌশলে তদানীন্তন প্রিন্ট মিডিয়াকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। গণমাধ্যমকে ব্যবহারের একটা সুযোগ ছিল। গাঁধী সেটা করেওছিলেন। এর মধ্যে আমি অন্যায়ের কিছু দেখি না। এখন সেই জায়গায় টেলিভিশন এসেছে। অণ্ণার আন্দোলনে যদি সেটার ব্যবহার হয়ে থাকে, তাতে দোষের কী আছে?

আশিস: হাস্যকর। গাঁধীর সঙ্গে অণ্ণা হজারের কোনও তুলনা টানাই উচিত নয়। বরং, আমি অন্য একটা নাম বলতে পারি। উত্তরপ্রদেশের এক কৃষক নেতা। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন তিনি। মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েত। অণ্ণা হজারেকে বড়জোর একজন ছোটখাট ‘টিকায়েত’ বলে বর্ণনা করতে পারেন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য এই সূত্রে আমি আরও একজনের নাম যোগ করতে চাইব। জেপি। জয়প্রকাশ নারায়ণ। অণ্ণা হজারের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণেরও একটা ছায়া আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু, এটাও ঠিক যে বিশ্বময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং তার সঙ্গেই ভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জেপি-র যে জ্ঞান, অণ্ণা হজারের মধ্যে তা নেই। ফলে, জেপি-র কথা ধরলে জেপি-র ওই সব গুণ বাদ দিয়ে ধরতে হবে।

আশিস: অণ্ণার প্রসঙ্গে ‘অথরিটারিয়ান’ হওয়ার একটা অভিযোগের কথা বলছিলেন একটু আগে। আমি বলব, এই ধাঁচটা ওই কৃষক নেতাদের পরিচালনা পদ্ধতির সঙ্গে, তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খুব ভাল খাপ খায়। বলতে পারেন, এ হল এক ধরনের কর্তৃত্ব, যা প্রায় প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবি করে। প্রশ্নহীন এই অর্থে যে সেই কর্তৃত্বের এমনই একটা ‘মরাল স্ট্যাচার’ আছে, তার বিরুদ্ধে কোনও কথাই বলা চলে না যেন। এটাও এক ধরনের অতি সরল মনোভাব। যাকে ‘নাইভ’ বলতে পারেন। বলা হচ্ছেও।

আশিস: এটা কিছুটা হয়েছে। রাজনীতির কুশলী খেলোয়াড় না-হলে যা হয়, অণ্ণার ক্ষেত্রেও সে রকমই ঘটেছে বলে আমার ধারণা। এবং, আন্দোলনের অভিমুখ যখন কিছুটা কংগ্রেসের দিকে ঘুরে গেল, তখনই এই আন্দোলনটার সামাজিক গুরুত্বটাও যেন কমে গেল খানিকটা। তা ছাড়া, আমি আগেই বলেছি, অণ্ণা বুঝতে পারলেন না, কংগ্রেস কেন, লোকপাল আসলে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই চক্ষুশূল।

আশিস: গণতন্ত্রের মধ্যে শুধু আন্দোলনেরই স্থান নেই, মূর্খতাবশত আন্দোলন, এমনকী আমি বলব পাগলামি-প্রসূত আন্দোলনেরও স্থান আছে। সুতরাং, অণ্ণা হজারের আন্দোলন গণতন্ত্রের বাইরে না ভিতরে, সেই প্রশ্নটি তোলার কোনও মানে হয় না। গত ষাট বছর ধরে বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি অনেক কিছু দাবি করেছে। সমাজের মৌলিক পরিবর্তন দাবি করেছে। নতুন সংবিধান দাবি করেছে। কেউই তাতে বিশেষ বিচলিত হননি। লোকতন্ত্রের মধ্যেই তাকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। বি জে পি গত ত্রিশ বছর ধরে জঙ্গি হিন্দুত্ববাদের কথা বলেছে। জোর গলায় হিন্দু রাষ্ট্র দাবি করেছে। এখন হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু রাষ্ট্র, এগুলো কি খুব সংবিধান-সম্মত? অথচ, এই দাবিগুলো উঠেছে। খুব জোরালো ভাবেই উঠেছে। বি জে পি তাদের দাবির সমর্থনে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনও দাবি করেছে। তখনও এমন ‘গেল গেল’ রব ওঠেনি। আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ অণ্ণা হজারের আন্দোলনকে ‘গণতন্ত্র-বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে এত হইচই করা হচ্ছে কেন! খেয়াল করে দেখবেন, অণ্ণার এই আন্দোলন কিন্তু সম্পূর্ণ অহিংস। অথচ, মার্ক্সবাদী আন্দোলনের মধ্যে হিংসার স্থান আছে। বি জে পি-র হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপও নানা সময়েই রীতিমতো সহিংস হয়ে উঠেছে। অথচ, অণ্ণা সরব হয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, এবং তা-ও অহিংস পদ্ধতিতে। একে যে কেন লোকতন্ত্র-বিরোধী বলা হবে, তা আমার বুদ্ধির অগোচর।

আশিস: অণ্ণা সংসদ-বিরোধী? সংসদকে এড়িয়ে যাচ্ছেন? আশ্চর্য! তিনি তো সংসদের মাধ্যমেই আইন আনার কথা বলছেন। যে শক্তিশালী লোকপালের দাবি তুলছেন তিনি, তা তো সংসদে আইন এনেই করার কথা। অর্থাৎ, সংসদের উপরেই এই জরুরি কাজটা যথাযথ ভাবে করার ভার দিচ্ছেন তিনি। একে আপনি কী বলবেন? সংসদ-বিরোধিতা নাকি সংসদকেই সমর্থন! ঠিক, এই আন্দোলন যে ভাবে চলেছে, তার মধ্যে কিছু মূর্খতা আছে, যাকে বলছিলাম অতি সরল মনোভাব, তা-ও আছে, কিন্তু একে সংসদের বিরোধিতা বলা হবে কেন? অণ্ণা কোনও রকম ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-এর ডাক দেননি। বিপ্লব চাননি। জয়প্রকাশ নারায়ণ তো সম্পূর্ণ বিপ্লব চেয়েছিলেন। তখন এই লালুপ্রসাদ যাদবেরই মতো অনেকে তা সমর্থন করেছিলেন। কেন সমর্থন করেছিলেন, কেন জয়প্রকাশের সম্পূর্ণ বিপ্লবের ডাক, সে সব ভিন্ন প্রশ্ন। আমার জিজ্ঞাস্য, অণ্ণা যখন সংসদের মাধ্যমেই লোকপাল আনার কথা বললেন, তখন তা নিয়ে এত গোলমাল করার কী আছে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.