|
|
|
|
আদিম মানুষের ধাঁচে গুহায় জীবন কাটায় চার ভাইবোন |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • গুয়াহাটি |
একবিংশ শতাব্দীতে গুহামানব! থুড়ি, সুড়ঙ্গমানব বলা ভাল। মেরাপনি থানা এলাকার বেতনিপট্টি গ্রামে তাদের বাস। চার ভাইবোন। তারা দিনের আলো সইতে পারে না। বাড়ির ভিতরেই মাটিতে সুড়ঙ্গ কেটে থাকে বাস করে। খায় কাঁচা মাছ, জংলি ফল। পোশাক পরে না, কথাও বলে না। সভ্য জগতের শখ বলতে একটাই, রেডিওয় গান শোনা।
গল্প নয়। বাস্তবেই এমন একটি পরিবারের বাস গোলাঘাট জেলায়। অরুণাচল গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে বেতনিপট্টি গ্রামের বাসিন্দা পুনেশ্বর সোনোয়াল ও অনিমা সোনোয়ালের চারটি সন্তান। তাদের নাম মেমেরা, মুনিয়া, নীরদা ও হরেন। তারা সকলেই জন্মের সময় স্বাভাবিক ছিল। আর পাঁচটা শিশুর মতোই বেড়ে উঠছিল। কিন্তু বছর ছয়েকের মধ্যেই,তাদের আচরণে ঘটে আমূল পরিবর্তন। বাবা-মা ছাড়া বাইরের মানুষকে সহ্য করতে পারত না তারা। কমিয়ে দেয় কথা বলা। ছেড়ে দেয় পোশাক পরাও। স্থানীয় ডাক্তার, কবিরাজ, গুণিন কেউই রোগ ধরতে পারেননি। এর পর, দিনের আলো থেকেও পালিয়ে থাকতে শুরু করে এই চারজন।
চার সন্তানের ‘অপ্রকৃতিস্থ’ আচরণ সত্ত্বেও পুনেশ্বর ও অনিমা তাদের তাড়িয়ে দেননি। বাড়ির ভিতরেই মাটিতে বানিয়ে দেন লম্বা সুড়ঙ্গ। চার সন্তান সেখানেই থাকতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে, গাছের উপরেও ঘুমায়। জীবনযাপন ও চালচলন আদিমানবের মতোই। স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান, চুল, নখ না কাটলেও মাঝেমধ্যেই স্নান করে তারা। সেই জন্য নিজেরাই ঘরের ভিতরে কুয়ো খুঁড়ে নিয়েছে। বাইরের কেউ উঁকিঝুঁকি মারলেই চার ভাইবোন পাথর-লাঠি নিয়ে তেড়ে যায়।
বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও চার সুড়ঙ্গবাসী সন্তান বাবা-মাকে সাহায্য করে। স্থানীয় বনবিভাগের আধিকারিক জানান, ঘরের ভিতরে খোঁড়া সুড়ঙ্গটি চার ভাইবোন মিলে নিজেরাই বাড়িয়ে চলেছে। সুড়ঙ্গের একটি দিক গিয়ে উঠেছে পিছনের খেতে। সেখানে কপি ও সব্জি চাষ করে তারা। যে কোনও গাছে, তরতর করে বেয়ে উঠে যায়। ফল পেড়ে আনে। আর রাতভর এলাকার জলাশয় থেকে মাছ ধরে। সেই মাছ সকালে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বিশ্রাম। পুনেশ্বরবাবু ও অনিমাদেবী সকালে মাছ ও সব্জি নিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।
প্রায় বারো বছর ধরে মাটির নীচে বাস করা এই চার ভাইবোন গত রবিবার বেজায় খেপে যায়। তাদের একমাত্র নেশা, রেডিও শোনা। বাবা-মায়ের কাছে কাছে নতুন রেডিওর আবদার জানিয়েছিল। পায়নি। তাতেই রেগে পাশের বাড়ির গরুকে কোপায় বড় ছেলে মেমেরা। রুদ্রমূর্তি সন্তানদের সামলাতে পুনেশ্বরবাবু গ্রামবাসীদের সাহায্য চান। সবাই মিলে চার সুড়ঙ্গবাসীকে কোনওমতে পাকড়াও করে, চুল, নখ কেটে গাছে বেঁধে রেখেছিলেন। কিন্তু বাঁধন ছেড়ে তারা পালায়।
গ্রামবাসীরা স্থানীয় থানাকে ব্যবস্থা নিতে বললেও পুলিশের বক্তব্য, এরা কারও ক্ষতি করেনি। তাই, তাদের হাজতে রাখা চলে না। চারজনকে মানসিক চিকিৎসার মাধ্যমেই সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু দরিদ্র পুনেশ্বরবাবুর সেই ক্ষমতা নেই। তাই, ফের সুড়ঙ্গে সেঁধিয়েছে একবিংশ শতকের চার আদিম মানব-মানবী। সঙ্গী সেই পুরনো রেডিও।
কিন্তু বিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা কী? নৃতত্ত্ববিদ দিলীপকুমার মেধির মতে, ঘটনাটি ব্যতিক্রমী। কেবল কথা বন্ধ রাখা বা পোশাক না পরার ঘটনার উদাহরণ মেলে। নানা উপজাতির ক্ষেত্রে এটি সমষ্টিগত অভ্যাস। তবে এই ভাইরা সভ্য সমাজের মধ্যে থেকেও নিজেদের পৃথক করে নিয়েছে। এর পিছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে। ওদের বাবা-মা স্বাভাবিক হলেও পারিবারিক ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে কি না খোঁজ নিতে হবে। আবার আচমকা জিনগত বদলের মতো ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে। কোনও বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে দিয়ে চারজনকে পরীক্ষা করালে সূত্র হয়তো মিলতে পারে।
মনোবিদ জয়ন্ত দাস মনে করেন, সভ্য সমাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার পিছনে সামাজিক ও পারিবারিক বহু কারণ থাকতে পারে। তবে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন সময়ে চার কিশোর-কিশোরী নিজেদের একইভাবে আলোর জগত থেকে সরিয়ে নিয়েছে। আলোয় থাকছে না, কথা বলছে না এমন ঘটনা আগে শুনিনি। তবে উপর থেকে শুনে বিষয়টির গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়। চারজনকে কাছ থেকে বেশ কিছুদিন দেখে, তাদের মনোজগত ও ব্যবহারিক ধারাকে বিশ্লেষণ করে আদিমতার কারণগুলি সন্ধান করা সম্ভব। |
|
|
|
|
|