|
|
|
|
রায়গঞ্জ করে দেখাল রামপুরহাট |
আঙুল উঁচিয়ে হুমকি ছাত্রদের, অজ্ঞান অধ্যক্ষ |
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় • রামপুরহাট |
২৪ ঘণ্টা আগে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, ‘রায়গঞ্জ করে দেব’।
বুধবার রামপুরহাট কলেজে এক দল ছাত্র দেখাল, তাদের যেমন কথা তেমন কাজ!
রায়গঞ্জ ইউনির্ভাসিটি কলেজের মধ্যেই মারধর করা হয়েছিল ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকারকে। আর বুধবার রামপুরহাট কলেজের অধ্যক্ষ শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় একদল পড়ুয়ার বিক্ষোভ ও দুর্ব্যবহারে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলা হুমকি ও তর্কের পরে অপমানিত ও বিধ্বস্ত অধ্যক্ষ জ্ঞান হারান। এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত শাসকদলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি। তবে এ দিন তাদের দোসর ছিল ছাত্র পরিষদও। এবং রায়গঞ্জে যেমন দিলীপ দে সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে তিলক চৌধুরীদের পাশে দাঁড়ানো হয়েছে, এ দিন রামপুরহাটেও ঠিক একই অবস্থান নেওয়া হল।
রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসার পরে রাতে অধ্যক্ষকে ছেড়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন তাঁর রক্তচাপ খুবই বেড়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার বীরভূম জেলা জুড়ে ‘কালা দিবস’ পালনের ডাক দিয়েছে এসএফআই। যে সংগঠনের সদস্যেরা ঘটনাচক্রে নদিয়ার মাজদিয়া কলেজে অধ্যক্ষ-নিগ্রহে অভিযুক্ত এবং আপাতত জেল হেফাজতেও।
শীর্ষ তৃণমূল নেতৃত্ব এবং রাজ্যের এক মন্ত্রী রামপুরহাট কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের অশালীন আচরণ ও দাপাদাপির মূল বিষয়টি থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর ‘আপ্রাণ’ চেষ্টা করেছেন। এক পা এগিয়ে রামপুরহাটের বিধায়ক তথা বীরভূম জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে গোটা ঘটনাকে ‘নাটক’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও, রায়গঞ্জ বা মাজদিয়া কলেজের মতো এ ক্ষেত্রেও রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঢেউ আটকানো যায়নি। শিক্ষাবিদেরা প্রশ্ন তুলেছেন, অধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রদের এমন ব্যবহার করার ‘সাহস’ হয় কী করে? হেনস্থার এই পালা চলতে থাকলে আগামী দিনে কেউ অধ্যক্ষ হতে চাইবেন না বলেও সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা। সকলেই একটা কথা বলছেন, এত কিছুর পরেও সরকার বা শাসকদলের কেউ বলছেন না, ঘটনাটি নিন্দনীয় এবং এর জন্য শাস্তি পাওয়া উচিত।
রামপুরহাট কলেজে অশান্তির বীজ অবশ্য পোঁতা হয়েছিল মঙ্গলবারই। |
|
অধ্যক্ষ শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে বিক্ষোভ। |
ওই দিন কলেজে বহিরাগতদের প্রবেশকে ঘিরে ছাত্র পরিষদ, টিএমসিপি এবং এসএফআই সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদ কার্যালয়ে ভাঙচুরের অভিযোগও ওঠে টিএমসিপি এবং ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে। ওই দিনই এসএফআইয়ের তরফে ৭ জন এবং ছাত্রপরিষদ ও টিএমসিপির তরফে ৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অধ্যক্ষ শিবাশিসবাবুর কাছে জমা পড়ে। অধ্যক্ষ দু’টি অভিযোগপত্রই পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেন। মঙ্গলবারই অধ্যক্ষ দাবি করেছিলেন, বহিরাগতদের আটকাতে ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখে ঢোকানো হচ্ছিল। তখন এক দল ছাত্র তাঁকে হুমকি দেয় ‘রামপুরহাট কলেজকে রায়গঞ্জ বানিয়ে দেব’! তাঁর অভিযোগের তির মূলত ছিল তৃণমূলের দিকেই।
বুধবার ঠিক কী হয়েছিল?
এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা অধ্যক্ষের ঘরে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে রয়েছেন টিএমসিপি এবং ছাত্র পরিষদের কলেজ ইউনিটের (জোট থাকায় একটাই কলেজ ইউনিট) সভাপতি তথা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অমিত ঘোষাল, টিএমসিপি সদস্য আকাশ শেখ, রবিউল ইসলাম-সহ জনা ২০-২৫ ছাত্র। ওই দলে ছিলেন কলেজের ছাত্র পরিষদ নেতা ইন্দ্রনীল চক্রবর্তীও। শুরু হয় বিক্ষোভ। ওই ছাত্ররা সরাসরি জানতে চান, রামপুরহাট কলেজকে রায়গঞ্জ করার হুমকি ডানপন্থী ছাত্র সংগঠনের সদস্যেরাই দিয়েছেন বলে মঙ্গলবার কেন অধ্যক্ষ সংবাদমাধ্যমের অভিযোগ করেছিলেন? পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, ছাত্র পরিষদ এবং টিএমসিপি-র সদস্য-সমর্থকদের বিরুদ্ধে এসএফআই ছাত্র সংসদ কার্যালয়ে ভাঙচুরের মিথ্যা অভিযোগ করেছে। সেটা অধ্যক্ষ কেন পুলিশের কাছে পাঠালেন? কলেজের পরিচালন সমিতির সভায় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতিকে কেন ডাকা হয়েছে, সে প্রশ্নও তোলা হয়।
এর পরেই বিতণ্ডার সূচনা। অমিত, রবিউলরা তর্জনী উঁচিয়ে বলেন, “অধ্যক্ষ হিসেবে আপনি যথাযথ ভূমিকা পালন না করে এসএফআইয়ের অভিযোগকে সমর্থন করেছেন। এসএফআইয়ের ছাত্র সংসদ নেতাকে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে পরিচালন সমিতিতে ডাকা হয়েছে।”
শিবাশিসবাবুর জবাব, “অধ্যক্ষ হিসাবে আমি আমার ক্ষমতাবলে এটা করতে পারি।”
টিএমসিপি এবং ছাত্র পরিষদের সদস্যরা বলে ওঠেন, “একে স্যার আপনি নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করছেন। তার উপরে আপনি নিয়মিত কলেজে আসেন না। আপনাকে সময় মতো কলেজে থাকতে হবে। সময়ে যেতে হবে।”
অধ্যক্ষের প্রতিবাদ, “আমি যদি কলেজেই না আসি, তা হলে তোমাদের এত কাজ হয় কী করে? তা ছাড়া তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
এ বার ছাত্রদের দাবি, “বহিরাগতদের নিয়ে কলেজ চত্বরে এসএফআই সমর্থকেরা দাঁড়িয়ে আছে, আপনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? এখনই চলুন সেখানে। নিজের চোখে দেখুন সব!’’
অধ্যক্ষ এর পরেই রেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। দু’তরফের বচসা আরও বাড়ে। ঘরে তখন উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও। এর পরেই অধ্যক্ষ বলেন, “তোমাদের অনেক কথার জবাব দিয়েছি। এ বার আমাকে ছাড়ো। তোমরা অনেকক্ষণ সময় নিয়েছ।’’
টিএমসিপি এবং ছাত্র পরিষদের নেতা-সদস্যেরা তর্ক চালিয়েই যান। বারবার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এসএফআই তথা সিপিএম-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলতে থাকেন। এক সময় অধ্যক্ষ রেগে বলে ওঠেন, “তোমাদের সব কথার জবাবদিহি করতে হবে নাকি?” এর পরেই শিবাশিসবাবু অসুস্থ বোধ করেন। বেগতিক বুঝে তখন ছাত্রদের মধ্যেই এক-দু’জন অধ্যক্ষের মাথায় ও চোখেমুখে জল ছেটান। কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বসেই শিবাশিসবাবু বলেন, “প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে ওই ছাত্ররা আমাকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। নানা দাবি নিয়ে আমার উপরে চাপ সৃষ্টি করছিল। তাতেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।” তাঁর আক্ষেপ, “২০০৮ সাল থেকে এই কলেজে আছি। ছোটাখাটো বিক্ষোভ যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু এ দিন যা হল, তাতে আমি প্রচণ্ড অপমানিত। যারা বিক্ষোভ দেখিয়েছে, তারা ছাত্র পরিষদ আর টিএমসিপি-রই সমর্থক। তার চেয়েও বড় ব্যাপার তারা আমার কলেজেরই ছাত্র। বিক্ষোভের নামে সেই ছাত্ররাই আমাকে মানসিক নির্যাতন করেছে। এর পরে নিজের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা হচ্ছে।” |
|
ঘটনার জেরে অসুস্থ অধ্যক্ষ। |
এ দিনের গোটা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ থাকলেও বিধানসভার শিক্ষা বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তথা স্থানীয় বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “অধ্যক্ষ নাটক করেছেন! ঘটনাটি পুরোপুরি সাজানো। টিএমসিপি-র কেউ ওখানে ছিল না। অধ্যক্ষ সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই কাজ করেছেন। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য শুক্রবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার জনের একটি দল কলেজে আসার কথা। ওই দলের মুখোমুখি হতে চাইছেন না বলেই অধ্যক্ষ এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।”
ঘটনাচক্রে আশিসবাবু এই কলেজেই দীর্ঘদিন বাংলার শিক্ষকতা করেছেন। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মীর এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় এ দিন বিকেলে হাসপাতালের শয্যাতেই শুয়ে অধ্যক্ষ বলেছেন, “বিধায়কের এই মন্তব্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ওঁর মন্তব্য ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। কলেজে এখন সরকারি অডিট চলছে। দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার আগেই উনি আমার উপরে এত বড় দোষ চাপাচ্ছেন কী করে? এ দিনের ঘটনা নিয়ে পরিচালন সমিতির সঙ্গে কথা বলব। তার পরে ব্যবস্থা হবে।”
কলেজ সূত্রে জানা যাচ্ছে, পরিচালন সমিতির সরকারি প্রতিনিধি আব্দুল মোকিদ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। আব্দুল মোকিদ অভিযোগ করেন, “কলেজের বিভিন্ন উন্নয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে অধ্যক্ষ জড়িত। এর জন্য গত ১৮ নভেম্বর তদন্তের দাবি জানিয়েছিলাম শিক্ষা দফতর ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়-সহ প্রশাসনিক স্তরে। সেই তদন্তেই ১৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তকারী দল আসার কথা কলেজে। তার আগে অধ্যক্ষের অসুস্থতা সমস্যাটিকে জটিল করে দিল।”
অধ্যক্ষের দাবি, “দুর্নীতির তদন্তের জন্য আমি নিজেই চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তার কোনও সদুত্তর মেলেনি।” বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ষোড়শীমোহন দাঁ বলেন, “অভিযোগটি আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে ১৩ জানুয়ারি তদন্তকারী দল ওই কলেজে যাবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।” বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে বলা হয়েছে, কলেজ সমূহের পরিদর্শক চেন্নাইয়ে রয়েছেন। তিনি না ফেরা পর্যন্ত তদন্তকারী দল কবে যাবে, তা জানানো সম্ভব নয়। |
|
|
|
প্রশাসনের চূড়ান্ত
ব্যর্থতা।
এটা মেনে
নেওয়া যায় না।
মহাশ্বেতা দেবী |
আমাদের ছেলেমেয়েদের গুন্ডা
বানানো চলবে না। মুখ্যমন্ত্রী রায়গঞ্জের
ঘটনার নিন্দা করলে এমন হত না।
সুনন্দ সান্যাল |
এর পরে তো আর
কেউ অধ্যক্ষ হতে
চাইবেন না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
নৈরাজ্যের মাসকাহন দেখতে ক্লিক করতে হবে |
|
টিএমসিপি-র বীরভূম জেলা সভাপতি সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ছাত্ররা বুধবার যুক্তিপূর্ণ দাবি নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিল। কেউ মারামারি করেনি। এ দিন এমন কী হয়েছে যে অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে পড়লেন!” এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক শতদল চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্য জুড়ে বর্তমান সরকার যে নৈরাজ্য শুরু করেছে, রামপুরহাট কলেজে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।” ছাত্র সংগঠনগুলি নিজেদের মধ্যে তরজায় জড়ালেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুস্থ পরিবেশ ফেরানোর আবেদন করেছেন রামপুরহাট কলেজে শিক্ষকেরা। ওয়েবকুটার রামপুরহাট কলেজ শাখার আহ্বায়ক তথা অর্থনীতির শিক্ষক সুশোভন হাজরার কথায়, “সমস্ত স্তরের শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি আমাদের আর্জি, কলেজে সুস্থ পরিবেশ ফেরানো হোক।”
রায়গঞ্জ, গঙ্গারামপুর, মাজদিয়া, রামপুরহাটপরিস্থিতি কিন্তু অন্য রকমই ইঙ্গিত করছে। |
নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|