বাম আমলের আর্থিক দুর্নীতি খুঁজে বের করতে রাজ্যের বিভিন্ন দফতর ও স্বশাসিত নিগমগুলিতে অডিটের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে নানা অনিয়ম ধরা পড়তে শুরু করেছে বলে দাবি করেছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। কিন্তু আসানসোল পুরসভায় ‘বেসিক সার্ভিসেস ফর আরবান পুওর’ প্রকল্পের অডিট রিপোর্টে অভিযোগের আঙুল উঠেছে তৃণমূল মেয়রের দিকেই।
আসানসোল পুরসভায় বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময়ে শহরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে চাঁদমারি এলাকায় ১০৫৬টি বাড়ি তৈরি হয়েছিল বিএসইউপি প্রকল্পের আওতায়। খরচ হয়েছিল প্রায় ২৬ কোটি টাকা। তখন বিরোধী আসনে থাকা কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের অভিযোগ ছিল, দরপত্র না ডেকে পছন্দের সিপিএমের নেতৃত্বাধীন পুরবোর্ড ঠিকাদার সংস্থা দিয়ে বাড়ি গড়েছে। ফলে অর্থ নয়ছয় হয়েছে। ২০০৯ সালে পুরভোটের প্রচারে এ নিয়ে সরব হন বিরোধীরা। প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতায় এলে এ সবের তদন্ত হবে।
পুরভোটে জিতে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ক্ষমতায় আসার পরে মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লেখেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, সরকারি নির্দেশ মেনে বাড়িগুলি গড়া হয়নি। এক তলার পরিবর্তে হয়েছে বহুতল। ব্যবহার হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী। এ সবের তদন্ত দাবি করেন তাপসবাবু। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে ঠিকাদারের বিল মেটানো হবে না বলেও জানিয়ে দেন তিনি।
বিষয়টির তদন্ত শুরু করে মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিরেক্টরেট (এমইডি)-এর মুখ্য বাস্তুকার দফতরের পশ্চিম চক্রের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু বছরখানেক আগে জানা যায়, ওই ঠিকাদারের বিল মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে বিল মেটানো হল, তা নিয়ে প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করেন মেয়র নিজেই। তিনি বলেন, ‘এমইডি এখনও আমাকে তদন্তের রিপোর্ট পাঠায়নি। তাই তদন্তের ফল জানি না। তার আগেই কী ভাবে ঠিকাদারকে বিল মেটানো হল বুঝতে পারছি না!” কিন্তু এমইডি-র আসানসোলের কার্যকরী ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা দাবি করেন, ঠিকাদারের পাওনা মিটিয়েছে পুরসভা। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন দফতর ও তাঁর দফতর যৌথ ভাবে এই বিষয়টির তদন্ত করেছে। কোনও অসঙ্গতি বা দুর্নীতি ধরা পড়েনি। মেয়রকে তা জানানোও হয়েছে। দিলীপবাবু সাফ বলেন, “মেয়রের স্বাক্ষর ছাড়া ঠিকাদারদের পাওনা মেটানো সম্ভব নয়।” পরে অবশ্য মেয়র বলেন, “ওই বিল না মেটালে দ্বিতীয় পর্যায়ের টাকা অনুমোদন হত না। তাই টাকা দেওয়া হয়েছে।”
সম্প্রতি পুরসভার চাঁদমারিতে বাড়ি তৈরির বিষয়ে অডিট করতে আসেন রাজ্যের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের লোকাল অডিট দফতরের একটি দল। ডিসেম্বরের শেষে পেশ করা রিপোর্টে সহকারী অডিট অফিসার তপন বারিক বেশ কয়েকটি অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে বাড়ি তৈরির অভিযোগ তোলার পরেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে পুরো বিল মিটিয়ে দিয়েছেন মেয়র। পাশাপাশি, এমইডি-র তদন্ত রিপোর্ট-ও অডিটরদের দেওয়া হয়নি। অযৌক্তিক কারণে বাড়িগুলি দেরি করে বানানোর অভিযোগ তুলেছিলেন খোদ মেয়র। তবুও সংশ্লিষ্ট ঠিকা সংস্থার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তদন্ত বা অন্য কোনও পদক্ষেপ করেননি। অডিট রিপোর্টে আরও অভিযোগ তোলা হয়েছে, আসানসোলের রেলপাড় অঞ্চলে বিএসইউপি প্রকল্পের বাড়ি এলাকার লোকজনকে না দিয়ে অন্য জায়গার বাসিন্দাদের দেওয়া হয়েছে। ফলে পুরসভার রেলপাড় এলাকার ২২, ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তিবাসীরা সমস্যায় পড়েছেন।
এ নিয়ে সরব হয়েছে পুরসভার বিরোধী তথা বাম কাউন্সিলরেরা। প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র, সিপিআই নেতা বিনোদ সিংহের দাবি, “বাড়ি নির্মাণের তদন্ত না করে কেন বিল মেটানো হয়েছে, তা নিয়ে আমরাই প্রথম অভিযোগ তুলেছিলাম।” পুরসভার মেয়র পারিষদ তথা কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, “অডিট দফতরের বিশেষজ্ঞেরা যা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে নিশ্চয়ই সত্যতা আছে।”
মেয়র তাপসবাবু অবশ্য বলেন, “আমি রাজ্য সরকারকে বিশেষজ্ঞ দিয়ে তদন্ত করতে বলেছিলাম। তৎকালীন বাম সরকার এমইডি-কে দিয়ে তদন্ত করিয়েছিল। রিপোর্টে সন্তুষ্ট ছিলাম না। কিন্তু প্রথম পর্যায়ের ওই বাড়িগুলির বিল না মেটালে দ্বিতীয় পর্যায়ের টাকা পাঠাতো না কেন্দ্রীয় সরকার। বর্তমান পুরবোর্ড এখনও পর্যন্ত যে কাজ করেছে, তার মধ্যে কোনও অনিয়ম নেই।” বিএসইউপি-র দ্বিতীয় পর্যায়ে কেন্দ্র ১৭ কোটি টাকার অনুদান পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। |