প্রায় চার মাস আগে দায়িত্ব নিয়েই ‘জনসংযোগ ও ‘দক্ষতা’ বাড়ানোর উপরে জোর দিয়েছিলেন উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। কিন্তু সেই জনসংযোগের এমনই হাল যে, কোথায় আগাম হামলা হবে তা আঁচ করতে প্রতি ক্ষেত্রেই পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি, চার মাসের মধ্যে জেলায় এমন সব ঘটনা ঘটেছে যে বামেরা তো বটেই, কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যেও জেলা পুলিশের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি সূত্রের খবর, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই পুলিশ সুপারের কাছে রিপোর্ট তলব করছেন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, আইসি শুধু
নন, প্রয়োজনে পুলিশ সুপারকেও সরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এ ব্যাপারে অবশ্য পুলিশ সুপারের কোনও বক্তব্য জানা যায়নি। কারণ, দিনভর চেষ্টা করলেও তাঁর ফোন বেজে গিয়েছে। যা কি না স্বীকার করেছেন রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তাও। তিনি জানান, রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যক্ষকে কলার ধরে কিলচড়, লাথি মারার ঘটনার ছবি দেখার পরে মহাকরণ থেকে বহুবার ফোন করা হলেও পুলিশ সুপারের মোবাইল বেজে দিয়েছে। ওই কর্তার কথায়, “উত্তর দিনাজপুরে পুলিশের সামনে পর পর দু’টি বড় ঘটনা ঘটল। ক’দিন আগে ইটাহারে পুলিশের সামনে বোমাবাজি, গুলি চালানোর জেরে তৃণমূলের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তার পরে পুলিশের সামনে অধ্যক্ষকে যে ভাবে নিগ্রহ করা হল তাতে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। যাঁদের বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ মিলবে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
গত বছরের অগস্টের শেষে দায়িত্ব নেওয়ার পরে জনসংযোগ ও দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলে জেলায় হইচই ফেলে দেন পুলিশ সুপার। আইনশৃঙ্খলাজনিত যে কোনও সমস্যায় যে কেউ যাতে ফোন করতে পারেন, সে জন্য মোবাইল নম্বর বিলি করেন। পুজো মণ্ডপে গিয়ে ঢাকও বাজান। ওই সময়েই একাধিক অপরাধমূলক কাজ হওয়ায় রায়গঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত প্রকাশ্য সভায় ‘আইনশৃঙ্খলা সামাল না-দিয়ে ঢাক বাজিয়ে বেড়ানোর’ কথা উল্লেখ করে এসপি-র সমালোচনা করেন। এসপিও পাল্টা মোহিতবাবুর সমালোচনা করেন। তা নিয়ে গোলযোগ বাড়তে থাকায় বিধানসভার স্পিকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কংগ্রেস সূত্রের খবর, বিধায়কের মর্যাদার প্রশ্ন তুলে এসপিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের ডিজিও এসপিকে ‘বিবাদ এড়িয়ে’ কাজে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দেন।
ডিজির নির্দেশেও যে পুলিশের ভোল পাল্টায়নি তা ২ জানুয়ারি ইটাহারে পুলিশের সামনেই বোমা-গুলিবৃষ্টিতে একজনের মৃত্যুর পরে স্পষ্ট হয়ে যায়। চার দিনের মাথায় রায়গঞ্জ কলেজেও পুলিশ দর্শকের ভূমিকায় থাকায় তৃণমূলের মধ্যেও ক্ষোভ বেড়েছে। খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবকে পর্যন্ত বলতে হচ্ছে, “বুধবার রায়গঞ্জে এক কলেজকর্মীকে মারধরের পরে এসপিকে ব্যবস্থা নিতে বলি। কাউকে গ্রেফতার করলে হয়তো ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না।”
পাশাপাশি, অধ্যক্ষ নিগ্রহের সময়ে পুলিশ কেন দাঁড়িয়ে থাকল, সেই প্রশ্নে জেলা পুলিশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “আমাদের উপরে নির্দেশ ছিল যাতে সংঘর্ষ না হয়। সে জন্য ছাত্র পরিষদকে আটকাতে পুলিশ ব্যস্ত ছিল। রায়গঞ্জ কলেজের শিক্ষক দেবাশিস বিশ্বাস (যিনি ঘটনার পরে তৃণমূল শিক্ষা সেল থেকে পদত্যাগ করেছেন) আগাগোড়া ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি বলেন, “পুলিশকে বললাম স্যারকে মারছে। আপনারা আটকান। এক অফিসার বললেন, কিছু করার নেই। এসপিকে ফোন করুন। এটা নিরপেক্ষতার নমুনা!”
বস্তুত, পুলিশ সুপারের নির্দেশ কী ছিল, তা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে স্বরাষ্ট্র দফতরও। এক সরকারি কর্তার কথায়, “পুলিশের কার কী ভূমিকা ছিল শীঘ্রই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।” |