আমরি-কাণ্ডের জেরে এ বার পরিষেবা বন্ধ করে দিতে চাইছে দাতব্য ট্রাস্ট পরিচালিত কলকাতার ছ’টি হাসপাতাল। মধ্য ও উত্তর কলকাতায় অবস্থিত ওই হাসপাতালগুলির কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এমনিতেই তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর জোগাড়। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য দফতর ও দমকলের বিধি মানার জন্য প্রয়োজনীয় ‘বিপুল’ পরিমাণ টাকার ব্যবস্থা করা তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে। অতএব, হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
যথাযথ পরিকাঠামো এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য দফতর হাসপাতাল পরিচালন কমিটির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে এমন আশঙ্কায় বড়বাজারের ১৫১ শয্যার বিশুদ্ধানন্দ হাসপাতাল গত প্রায় এক সপ্তাহ রোগী ভর্তি বন্ধ রেখেছিল।
মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি, মাতৃমঙ্গল, লোহিয়া, আশারাম ভিওয়ানিওয়ালা ও বিশুদ্ধানন্দ মারোয়াড়ি হাসপাতালের পরিচালকেরা বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ ক’দফা বৈঠক করেছেন। দমকল ও স্বাস্থ্য দফতরের সব বিধি মেনে চলা যে তাদের পক্ষে অসম্ভব, দুই দফতরকে তা লিখিত জানিয়েও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দাতব্য ট্রাস্টগুলি। ছ’টি দাতব্য হাসপাতাল মিলিয়ে শয্যা রয়েছে প্রায় ৭০০।
হাসপাতাল পরিচালনা বোর্ড এ কথা বললেও স্বাস্থ্য দফতর কিন্তু মানছে না যে, হাসপাতালগুলোর আর্থিক অবস্থা এত খারাপ। স্বাস্থ্য-কর্তাদের মতে, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হাসপাতাল হওয়ার সুবাদে মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি পরিকাঠামো সংস্কারে সরকারি সাহায্য পেতে পারে। বাকি পাঁচটি হাসপাতালও বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতি মাসে মোটা চাঁদা তোলে বলে স্বাস্থ্য-কর্তাদের দাবি। এক কর্তার অভিযোগ, “এত দিন চাঁদা বাবদ পাওয়া টাকার কোনও হিসাব দিতে হতো না। আমরির ঘটনার পরে এখন আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। জানিয়ে দিয়েছি, প্রতিটা পাই-পয়সার হিসাব দিতে হবে। তাতেই ওঁদের (ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের) কেউ কেউ পিছিয়ে যাচ্ছেন।”
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “এত দিন হাসপাতালগুলো কোনও নিয়ম না-মেনে যেমন ইচ্ছে চালিয়ে গিয়েছে। ফায়ার লাইসেন্স এবং ট্রেড লাইসেন্সের কোনও ঠিকঠিকানা ছিল না। রোগীর নিরাপত্তা শিকেয় তুলে যেমন ইচ্ছা চালাচ্ছিল। এ বার স্বাস্থ্য দফতর কড়া হতেই তারা বুঝেছে সব ধরা পড়ে যাবে। তাই শাস্তি পাওয়ার আগেই ভয় পেয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাইছে।”
সংশ্লিষ্ট দাতব্য ট্রাস্টি বোর্ডের বিভিন্ন সদস্য অবশ্য ফায়ার লাইসেন্স-ট্রেড লাইসেন্সের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে জানিয়েছেন, আমরি-র ঘটনায় এস কে তোদি-সহ ওই হাসপাতালের পরিচালন বোর্ডের একাধিক সদস্য গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁরা আর কোনও হাসপাতালের বোর্ডে থাকার সাহস পাচ্ছেন না। অনেকে হাসপাতাল বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছেন। অনেকে দাবি তুলেছেন, রাজ্য সরকারই হাসপাতাল কিনে নিক, অথবা বিধি শিথিল করুক। স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য এতে রাজি নয়।
দাতব্য হাসপাতালগুলোর পক্ষে সুরেন্দ্রকুমার অগ্রবাল (মাতৃমঙ্গল), পি ডি অগ্রবাল (লোহিয়া) কিংবা গোবিন্দরাম অগ্রবাল (মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি) দাবি করেছেন, আর্থিক টানাটানির মধ্যেই অত্যন্ত কম পয়সায় তাঁরা চিকিৎসা-পরিষেবা দেন। কিন্তু দমকলের ফিরিস্তি মেনে অত অত্যাধুনিক নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই। ওঁদের আশঙ্কা, পরে কিছু অঘটন ঘটলে বোর্ডের সদস্য হিসেবে পুলিশ তাঁদের ধরবে। উত্তর কলকাতার এমন বেশ কয়েকটি হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা পুষ্করমল কেডিয়ার কথায়, “সমাজসেবা করতে এসে বোর্ডের সদস্যেরা টাকা দেবেন, নিঃস্বার্থে খাটবেন, সব দায়িত্ব নেবেন, আবার তেমন পরিস্থিতিতে পুলিশ তাঁদেরই ধরবে এমন হলে তো মুশকিল! তাই কেউ থাকতে চাইছেন না।”
স্বাস্থ্য-কর্তারা অবশ্য নিজেদের যুক্তিতে অটল। তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, যে কোনও মূল্যে রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ম থেকে ছাড় পাওয়ার ‘ফিকির’ হিসাবে দাতব্য ট্রাস্টের হাসপাতালগুলি যতই হাসপাতাল বন্ধের হুমকি দিক, তার সামনে স্বাস্থ্য দফতর মাথা নোয়াবে না। উল্টে জানতে চাইবে, কেন এত দিন তারা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। |