অসিযুদ্ধ
ডনকে সম্মান দেখিয়ে ডিক্লেয়ার কি না একমাত্র বিতর্ক তা নিয়েই
ক্রিকেট-ধর্মভীরু সত্তাই কি বরাবরের মতো মাইকেল ক্লার্কের আগ্রাসী ব্যাটসম্যানশিপ সত্তাকে হারিয়ে দিল? এমন অদ্ভুত দিন যে, ভারত ০-২ হারছে। তা নিয়ে কৌতূহল নেই। যাবতীয় জিজ্ঞাসা ক্লার্কের মনোভাব সমর্পিত।
নইলে ডন ব্র্যাডম্যান আর মার্ক টেলরের কীর্তি ভাঙার মাত্র ৬ রান দূরে থেকে কেন ডিক্লেয়ার করে দেবেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক! ৩২৯ অপরাজিত ব্যাট করছেন। বোলিংয়ের এমন হাল যে, স্বেচ্ছামৃত্যু ছাড়া প্যাভিলিয়নে ফেরা সম্ভব নয়। স্বয়ং স্টিভ ওয় বলছেন, “চারশো দেখার জন্য তৈরি হচ্ছি।” এই অবস্থায় আচমকা ক্লার্ক ডিক্লেয়ার করে দিলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যাখ্যা দিলেন, নিজের স্কোর নয়। লিড সাড়ে চারশো হওয়া অবধি অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু কথার সঙ্গে এ জন্যই মিলছে না যে, ডিক্লেয়ার করলেন তো ৪৬৮ রানে এগিয়ে। অতিরিক্ত ১৮ রান করতে মিনিট কুড়ি গেল। যেটা বরাদ্দ করা হয়েছিল মাইক হাসিকে তাঁর দেড়শো রান পূর্ণ করার জন্য। ওই সময়ে একটা ছক্কাতেই তো তাঁর কাজ হয়ে যেত। সেই গরজ দেখাতে কেন তাঁকে দেখা গেল না?
গ্যালারিতে সেই সময় অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গেলার্ড। ডিক্লেয়ারেশনের কিছু পরে যিনি চ্যানেল নাইন-কে বললেন, “ব্যক্তির আগে যে দেশ সেটা ক্লার্ক দেখাল স্বার্থপরতাকে কোনও ভাবে মস্তিষ্কে আসতে না দিয়ে। এটাই অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতি। টিমের জেতা আগে। ব্যক্তি-আকাঙ্ক্ষা পরে।”
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে নাম কিনতে চাওয়াটা কারণ নয়। কোথাও আবছা মনে হচ্ছে আসল কারণ, ব্র্যাডম্যান-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবনত থাকা। অস্ট্রেলিয়ায় একটা সেন্টিমেন্ট ইতিহাসমনস্ক ক্রিকেটারদের মধ্যে কাজ করে। বিশেষ করে যাঁরা ব্র্যাডম্যানের রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলসে খেলেন। খেলতেন। ব্র্যাডম্যান এই সিডনির আশেপাশের অঞ্চল থেকেই উঠে আসা ব্যাটিং-বিস্ময়। তাই মার্ক টেলর থেকে মাইকেল ক্লার্কসবাই অলিখিত একটা সংস্কৃতি মান্য করেন। সম্ভব হলে ডনের আগে নয়। এমন মানসিকতা থেকেই পেশোয়ারে ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর ৩৩৪ স্পর্শ করা মাত্র ডিক্লেয়ার করে দেন মার্ক টেলর। ক্লার্ক যতই অস্বীকার করুন, ঘটনাপ্রবাহ বলছে মাত্র ৬ রান দূরে ছেড়ে আসার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। যখন তিনি তিনশো অতিক্রম করেছেন তখন থেকেই ভিভিআইপি বক্স তাঁকে চিৎকার করে বলছিল, মাইকেল ভুলেও ৩৩০ অতিক্রম কোরো না। এমনিতেও ক্লার্ক ‘স্টিভ ধর্মে দীক্ষিত’। বরাবরের রোম্যান্টিক। অস্ট্রেলীয় অধিনায়কত্বকে অন্য ঝঙ্কারে গোনেন। ব্যাগি গ্রিন টুপিকে মনে করেন নিজের ঈশ্বর। তাঁর পক্ষে এই মানসিকতাই স্বাভাবিক।
তিনশোর উল্লাস। সিডনিতে ক্লার্ক। ছবি: রয়টার্স
তবু কখনও ‘স্টিভ’ হবেন না। কোথাও তাঁর ক্রিকেটে পুরুষালি মিশ্রণের সামান্য কমতি আছে। স্টিভের অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানকে খেলাত। খেলিয়ে আউট করত। বোলিংয়ের লাইনে ‘মাচো’ ব্যাপার ছিল। ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া বল করছে ব্যাটসম্যানের শরীর থেকে দূরে। বিশেষ করে সচিনের জন্য তো ক্রমাগত অফস্টাম্পের বাইরে বাইরে। নেগেটিভ লাইনে। দিনের শেষ ১৫ ওভারে ভারত ১৫ রান করল। সচিন তো বল শুধু ছেড়েই গেলেন। রাতে তাঁর এক বন্ধু এসএমএস দেখালেন। সচিন লিখছেন, ‘শুক্রবারও যদি ওরা বাইরে বল করে যায় আমি ছেড়ে যাব। দেখি ধৈর্যে কে জেতে।’ সিডনি মাঠে টেস্টের চতুর্থ দিন নাকি ট্রাম্পারের আত্মা নামে। তা, রডনি কেভেলিয়ার্স বললেন, এত নেগেটিভ বোলিং দেখলে ট্রাম্পার রেগে যাবেন।
এ বার চতুর্থ দিনে উইকেটে ফাটলও আস্তে আস্তে তৈরি হওয়া উচিত। এই অবস্থায় ৩৫৪ রানে এগিয়ে থেকেও যদি একটা দল পজিটিভ বোলিং করার ঝুঁকি না নেয়, তা হলে তো বুঝতে হবে ভেতরে ভেতরে তাদেরও ভয় কাটছে না। তারাও আর যা-ই হোক সেই ভয়ডরহীন অস্ট্রেলিয়া নয়। নামেই শুধু সিরিজটা পকেটে পুরে ফেলছে।
প্রয়াত জেন ম্যাকগ্রার জন্মদিন হিসেবে বিশেষ ভাবে পালিত হল থার্ড ডে। না দেখলে বিশ্বাসই হত না কী গভীর ভাবে অস্ট্রেলিয়ানরা স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ক্রিকেট মাঠের লড়াইকে নিয়েছে! যেন গোলাপি রং দিয়ে হোলি এই ছিল গোটা দিনের থিম। স্টেডিয়াম, দর্শক, ভাষ্যকার, প্রাক্তন ক্রিকেটার, প্রধানমন্ত্রী, স্টেডিয়ামে ভোডাফোনের বিজ্ঞাপন সব কিছু গোলাপিতে। ব্রেট লি-মার্ক টেলররা চুল অবধি গোলাপি রং করিয়ে এলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো যাঁরা সেটা করেননি তাঁরা আবার গোলাপি টুপি পরে এলেন। পায়ে গোলাপি জুতো। উপলক্ষ ক্যানসার যুদ্ধের জন্য টাকা তোলা মানেই যে একটা গম্ভীর-গম্ভীর গোছের আবহ তা একেবারেই নয়। বরঞ্চ ফুর্তি-রং-আলো-হাসি।
মাঠের ক্রিকেটও সেই মেজাজের সরলরেখায় চলল। মনে হচ্ছিল টেনশনহীন ফেস্টিভ্যাল খেলা। ভারতীয় বোলিং দেখলে সত্যিই কেউ বলবে, টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় দিন? জাহিরের গতি কমে ১২৫ কিমিতে নেমে এল। ইশান্ত তো এই বোলিংয়ে উইকেট কেন পাবেন তা নিয়েই একটা কমিটি আজ গড়া যেত। ধোনি তাঁকেও দেখে মনে হল গোলাপি, শান্তিপূর্ণ ক্রিকেট উপহার দিতে চান আজকের দিনে। নইলে ক্লার্ক যখন ২৯৯। গোটা ইনিংসে প্রথম বার টেনশনে। তাঁকে সহবাগ বল করবেন কেন? নিয়মিত কোনও বোলারই করবে। যদি কিছু হয়! বিদেশে ধোনির অশুভ অধিনায়কত্ব-বৈশিষ্ট্য ইংল্যান্ড থেকে প্রকট হচ্ছে যে, এক বার পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে তিনি পুরো হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন। ধোনির অধিনায়কত্ব নিয়ে সমালোচনা এত বাড়ছে যে, ০-২ যদি ০-৪-এ পরিণত হয়, নতুন মরসুমে গদিতে কাকে দেখা যাবে বলা শক্ত।
একই সঙ্গে ধোনির ব্যাটসম্যানরাও যাচ্ছেতাই ক্রিকেট খেলছেন। রাহুল দ্রাবিড় আবার ব্যাট-প্যাডের মাঝখান দিয়ে বোল্ড। এ বার ৭৩ বলে ২৯। চার ইনিংস মিলিয়ে মাত্র ১১২ করেছেন। গড় ২৮। আর বল নিয়েছেন ৩২২। ইংল্যান্ডের ছন্দ আসছে না। সহবাগের খরা তো চলছেই। যে ভাবে এ দিন আউট হয়ে গেলেন তাতে কড়া কোচ হলে জরিমানা করতেন। লক্ষ্মণও রান পাচ্ছেন না। টিম দাঁড়াবে কী করে? তা-ও দ্বিতীয় ইনিংসে কপাল ভালগম্ভীর আউট হতে হতে কয়েক বার বাঁচলেন। তাঁর সহজ ক্যাচ পড়ল। সচিন ছাড়া সবাইকে এখনও টলমল দেখাচ্ছে।
ভারতের হয়ে সামান্য যে খেলতে পারে সেই বৃষ্টি এ দিন রাতে শুরু হল। শুক্রবারও নাকি হতে পারে। পূর্বাভাসের এই ভরসাটুকু ছাড়া ভারতের পঞ্চম দিনে ম্যাচ টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও কারণ নেই। বড়জোর বিদায়ী যাওয়াটা মোটামুটি মর্যাদাব্যঞ্জক যাতে হয় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এক-এক সময় মনে হচ্ছে, অন্য বার সিডনি টেস্ট ঘিরে এত লড়াই, সংঘর্ষ আর তৎপরতা জারি থাকে। আর এ বার কী অনুত্তেজক ভাবেই না একপেশে! ক্লার্ক যখন ব্রায়ান লারার ২৭৭ ভেঙে দিলেন তখন মনে হচ্ছিল রেকর্ডই শুধু নয়, ক্রিকেটের একটা অমর স্থাপত্যও অপঘাতে ভেঙে পড়ল। এমনিতে অস্ট্রেলিয়ার বুকে ট্রিপল সেঞ্চুরি প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। বিগত একশো চৌত্রিশ বছরে মাত্র দু’বার হয়েছে। স্বয়ং ব্র্যাডম্যানের নামও সেই দুই-এর তালিকায় নেই।
সেখানে ক্লার্ক অঙ্কের একটা বিশাল প্রাসাদ গড়ে ফেললেন একটাও মনে রাখার মতো শট না খেলে। তাঁর ইনিংসকে একটা বাক্যে বর্ণনা করা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বোলিংকে ক্ষুধার্ত মনোভাব দেখিয়ে ফায়দা লুটেছেন। মনে পড়ে যাচ্ছিল, ১৯৯০-তে সিডনিতেই অনেক ভাল অজি বোলিংয়ের বিরুদ্ধে লারার ডাবল সেঞ্চুরি দেখে পিটার রোবাক কী লিখেছিলেন। ‘সিডনি মাঠের ধারের গাছগুলো। আর তার ওপর বসে থাকা পাখিদেরও মনে থাকবে লারার ইনিংসটা।’
জিম ম্যাক্সওয়েল অস্ট্রেলিয়ার নামী রেডিও ভাষ্যকার। কেপটাউনে রোবাক সে দিন জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার দু’মিনিট আগে তাঁর ঘরেই ছিলেন। তাঁকেই ফোন করে বিপন্ন রোবাক ডাকিয়েছিলেন। ম্যাক্সওয়েল মনে করেন, ক্লার্কের ইনিংস দেখলে রোবাক দারুণ খুশি হয়ে লিখতেন, ‘অবশেষে নিজের ভেতরকার জুজুগুলোকে নিকেশ করে দিয়ে মাইকেল উঠে দাঁড়াল ওর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনে।’ ম্যাক্সওয়েলের মতো রোবাককে অবশ্যই চিনতাম না। কিন্তু লারাতে এত উচ্ছ্বসিত থাকা আবেগের মন ক্লার্কের অঙ্কশিক্ষায় অভিভূত হত বলে মনে হয় না।
সম্ভবত এ ভাবে বলা ভালরোবাক পরপারে যাওয়ায় স্মৃতির ওপর বুলেট-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেয়েছেন!

স্কোরবোর্ড


ভারত
প্রথম ইনিংস: ১৯১

অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস:
(আগের দিন ৪৮২-৪)
ক্লার্ক নঃআঃ ৩২৯,
হাসি নঃআঃ ১৫০,
অতিরিক্ত ২২।
মোট ৬৫৯-৪ ডি.।
পতন: ৮, ৮, ৩৭, ৩২৫।
বোলিং: জাহির ৩১-৪-১২২-৩, উমেশ ২৪-২-১২৩-০, ইশান্ত ৩৩-২-১৪৪-১,
অশ্বিন ৪৪-৫-১৫৭-০। সহবাগ ২৩-১-৭৫-০, কোহলি ৮-০-২৩-০।

ভারত
দ্বিতীয় ইনিংস:
গম্ভীর ব্যাটিং ৬৮,
সহবাগ ক ওয়ার্নার বো হিলফেনহস ৪,
দ্রাবিড় বো হিলফেনহস ২৯,
সচিন ব্যাটিং ৮,
অতিরিক্ত ৫।
মোট ১১৪-২।
পতন: ১৮, ১০০।
বোলিং: প্যাটিনসন ১২-১-৪০-০, হিলফেনহস ১৬-৬-৩৭-২,
সিডল ১১-৭-২৩-০, লিয়ঁ ২-০-১১-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.