অসিযুদ্ধ
সৌরভ অস্ট্রেলিয়ায় জিততে আরও মরিয়া ছিল
গ্লেন ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশনের দেওয়া হাই টি-তে নির্ঘাত থাকবেন! যেখানে এখুনি বলতে উঠলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী! আশ্চর্য— সেখানে নেই। তাঁকে পাওয়া গেল সিডনি গ্রাউন্ডস ট্রাস্টের লাউঞ্জে। রিসেপশনিস্ট জানালেন, এখানে বসে ভাবশিষ্য মাইকেল ক্লার্কের ট্রিপল সেঞ্চুরি-উত্তর ব্যাটিং উপভোগ করছেন। লর্ডসের মতোই ড্রেস কোডের দিক থেকে ভীষণ কঠোর সিডনি মাঠের কিছু সংরক্ষিত এলাকা। সুট-টাই ছাড়া সেখানে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। তিনি-- স্টিভ ওয় তাই নীচে নেমে এলেন। এ বারের সফরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া তাঁর প্রথম ইন্টারভিউ দিলেন রিসেপশনে দাঁড়িয়ে। এর পর এগোলেই যে ড্রেস কোডের সীমান্ত শুরু...

প্রশ্ন: স্টিভ ওয় মডেলে ভারতও এ বার বলেছিল, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজ হারানো তাদের চূড়ান্ত সীমান্ত। এখনই বলা যাচ্ছে সিরিজ জেতা হল না। শপথ করে ইন্ডিয়ান টিম সেটা রাখতে পারল না কেন মনে হয়?

স্টিভ: মেলবোর্ন টেস্টে যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল ওরা। কাজে লাগাতে পারল না ব্যাটসম্যানরা ঝুলিয়ে দেওয়ায়। সিডনিতে এমন পিচে প্রথম দিন পড়ল যা চ্যালেঞ্জিং। তবে চ্যালেঞ্জটা প্রথম তিন-চার ঘণ্টার। সেই শৃঙ্খলা দেখাল কোথায়? গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে যে পরিবেশ অনুযায়ী পড়ে থাকতে হয় সেই নিষ্ঠাটাই দেখিনি ওদের মধ্যে। বোলাররা ট্রাই করেছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। জাহির আর ইশান্ত দু’জনেই চোট সারিয়ে ফিরেছে। সে ভাবে তৈরিই হতে পারেনি সফরের জন্য। দু’জনের কাউকেই আমার তাজা মনে হয়নি। ক্যানবেরাতে যে প্রস্তুতি ম্যাচটা ওরা খেলেছিল সেটা প্রস্তুতির পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এক কথায় আমি বলব-- কাঁচা রান্না খেতে দিলে যেমন হয়, সফরের জন্য ভারত সে ভাবেই এসেছে।

প্র: আপনি ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন। ধোনি নন। টস জিতলেন সিডনি টেস্টে। কী করবেন?
স্টিভ: আমি ব্যাটই করব। প্রথমত টস নিয়ে আমি এত কিছু ভাববই না। ওটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমার ফোকাস হল, যা-ই ভাগ্য আমার ওপর চাপিয়ে দিক সেটাকে আমি কাজে লাগাব। ভারতের এই টিমটায় আমি সেই মনোভাব দেখছি না।
সহবাগকে যেমন টেস্টের প্রথম দিন কয়েকটা শট খেলতে দেখে আমি খুব বিরক্ত। অন্তত তিরিশ বার চালাতে গিয়ে প্লে অ্যান্ড মিস হল। আমার কথা হল, তুমি সিনিয়র ব্যাটসম্যান হয়ে এমন শট খেলবে কেন? তুমি নাহয় পার পেয়ে যাচ্ছ। কিন্তু ড্রেসিংরুমের জন্য কী উদাহরণ তৈরি করছ! উইকেটে বল সিম করছে। সুইং করছে। বাউন্স আছে। কোনও কোনও ডেলিভারি কিপার বল ধরছে মাথার পাশে। সেখানে কেউ এ ভাবে খেলে নাকি? একমাত্র সচিনকে দেখলাম, ফার্স্ট ইনিংসে ঠিকঠাক ব্যাট করছে। হাফ ভলি না পেলে ড্রাইভ-ই মারছিল না। সেটাই করা উচিত ছিল। এই উইকেটে ড্রাইভ মারা মানে নিজের বিপদ চমৎকার ভাবে ডেকে আনা।

প্র: সচিনের শততম সেঞ্চুরি নিয়ে এই যে ব্যান্ডপার্টি চলছে এটাকে অবাস্তব মনে হচ্ছে না?
স্টিভ: অবাস্তব তো বটেই।

প্র: জনতার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সেঞ্চুরি সিডনির যে কোনও সুপার মার্কেটে কিনতে পাওয়া যায়!
স্টিভ: ঠিকই। প্রচণ্ড রকম ওভার দ্য টপ। বাড়াবাড়ি বললে কমিয়ে বলা হয়। ভারতে আসলে ক্রিকেট নিয়ে এমন মাতামাতি চলে যে স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে ভারতীয়রা একেবারে মাতোয়ারা হয়ে যায়। আর এক বার লেখালেখি শুরু হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। ব্যাপারটা আরও ফুলে যায়।
অ্যালবাম থেকে

প্র: শুধু ভারত বলছেন কেন? ইংল্যান্ড হাইপ করল। এ বার অস্ট্রেলিয়া করছে। আইসিসি করছে।
স্টিভ: ঠিকই। এক বার একটা ফ্যাশনের মতো হয়ে গেলে সবাই সেটা নকল করতে শুরু করে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি শুক্রবার ওর শততম সেঞ্চুরি এলেও দারুণ অভিভূত হয়ে পড়ব না। সচিনে আমি অলরেডি অভিভূত। আর সেটা ওর ৫১ টেস্ট সেঞ্চুরির জন্য! আমার কাছে টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে-তে হান্ড্রেডের মূল্য একই রকম দামি নয়। টেস্ট সেঞ্চুরি হল আসল। সচিনের আসল বেঞ্চমার্কিং হল টেস্ট ক্রিকেটে ও-ই একমাত্র পঞ্চাশতম শতরানের অবিশ্বাস্য শৃঙ্গে উঠেছে। এর পরে আর কোনও শৃঙ্গ জয়ের ব্যাপার-- অন্তত আমার কাছে নেই।

প্র: কিন্তু এই যে সেঞ্চুরি সেঞ্চুরি নিয়ে নিত্যকার কথাবার্তা, এতে সচিনের ব্যাটিংয়ের ক্ষতি হচ্ছে না!
স্টিভ: হয়তো হচ্ছে। নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে কুরে খাচ্ছে। তবু ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আমার সচিনের খেলাই ভাল লাগছে। প্রবলেম হচ্ছে একা সামলাতে গিয়ে বেচারি চাপে পড়ে যাচ্ছে।

প্র: আজ মাইকেল ক্লার্কের ইনিংস?
স্টিভ: অনবদ্য। সিডনি মাঠের রিঅ্যাকশন দেখলেন ওর তিনশো হওয়ার পর! অনবদ্য! সবাই দাঁড়িয়ে উঠল। হাততালি থামছেই না। কী জাদুগরি সব মুহূর্ত পরের পর তৈরি হচ্ছে। কম্পিটিটিভ স্পোর্ট এ জন্যই লোকে খেলে। এই সব মুহূর্তগুলোর জন্য।

প্র: আপনার বংশের পরম্পরা কি ক্লার্কের মাধ্যমে অক্ষুণ্ণ থাকছে?
স্টিভ: আমার পরম্পরা বলতে?

প্র: এই যে ব্যাগি গ্রিনের জন্য সর্বস্ব দাও। কোনও কিছুর জন্যই ব্যাগি গ্রিনকে ত্যাগ করো না।
স্টিভ: নিশ্চয়ই। অস্ট্রেলিয়ার জন্য জীবন দিয়ে ঝাঁপাও। রোদ্দুরে বার হও নিজের সব কিছু নিয়ে। ছায়াতে কিচ্ছু রেখে যেও না। নিজেদের খেলাটাকে অন্য লেভেলে নিয়ে যাও। আর বিপক্ষকে ভয় পাওয়াও। এরা যেন কখনও মনে না করে যে উইকেটে কেউ পার্টি দিয়েছে। এই তো ছিল আমার মন্ত্র।

প্র: আজ ক্লার্ককে নিয়ে নাচানাচির সময় আমাদের কারও কারও মনে পড়ছিল সিডনি মাঠেরই একটা অমর বিকেল। তাতে যেন হিস্টিরিয়া আরও বেশি ছিল। লোকে সারাক্ষণ লাল রুমাল নেড়ে যাচ্ছিল...
স্টিভ: আমারও মনে পড়ছিল চল্লিশ হাজার লোক কী ভাবে রং আর ছবি তৈরি করেছিলেন সে দিন। খুব স্যাটিসফাইং লাগে। জীবনের শেষ ইনিংসে ৮০ করেছিলাম চাপের মুখে। আউট হই তেন্ডুলকরের নেওয়া ক্যাচে। নিজেকে নিজে আজও বলি, এর চেয়ে ভাল শেষ আর কী হতে পারত!

প্র: সেই লাল রুমালটা কী হল?
স্টিভ: এস সি জি মিউজিয়ামকে দিয়ে দিয়েছি। আমার ব্যাগি গ্রিন টুপি আর লাল রুমাল দু’টোই ওখানে।

প্র: আর নিজের ব্রোঞ্জ মূর্তিটা দেখলে কেমন লাগে? গত বছর অ্যাসেজের সময় যেটা এস সি জি-তে উদ্ঘাটন করা হল?
স্টিভ: আমি খুব লজ্জায় পড়ে যাই। যখনই মূর্তিটার দিকে চোখ যায়। আমার বাচ্চারা ওটা দেখে হাসে। আমার নিজেরও কেমন যেন আনরিয়েল লাগে। মনে হয় যেন অন্য কারও মূর্তি।

প্র: কেন যেন মনে হয় আপনার সঙ্গে কথা বলে মূর্তিটা বানানো। কারণ মূর্তিটার এক হাতে ব্যাট। আর এক হাতে হেলমেট নেই। ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ।
স্টিভ: হ্যাঁ, আমার সেটাই পছন্দ। আমার সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল।

প্র: বিকল্পের সুযোগ থাকলে কোথায় নিজের মূর্তি চাইবেন? মাদাম তুসো? যেখানে ক্রিকেটের বাইরেও অনেক পর্যটকের আপনাকে দেখার সুযোগ থাকছে। না কি এস সি জি-ই ভাল?
স্টিভ: এস সি জি। এটাই তো আমার বাড়ি। এখানে ক্রিকেট খেলেই তো আমি বড় হয়েছি। এখানে থাকতে পেরেই আমি খুশি।

প্র: ক্রিকেট ছাড়ার পর একটা ইন্টারভিউতে আপনি বলেছিলেন, এটাই আসল জীবন। আগে যার মধ্যে বাস করতাম সেটা নিছক বুদবুদ ছিল।
এখনও তাই মনে হয়?

স্টিভ: অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন্সি করা। এত সব ম্যাচ জেতা। এগুলো দুর্মর অভিজ্ঞতা। সম্মানও। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জটা ক্রিকেটের বাইরে। ক্রিকেটে তো আমার সহজাত স্কিল ছিল। ওখানে এগোতে পারাটা সহজ। স্বাভাবিকও।
কিন্তু জীবনের মাঠে তো ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে নামতে পারবেন না। আপনার যাবতীয় সমস্যা আর সীমাবদ্ধতা নিয়েই চ্যালেঞ্জ জিততে হবে। সেটা আরও উত্তেজক। ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। এক্সাইটিং খুব!

প্র: চ্যালেঞ্জ বলতে কী?
স্টিভ: সব কিছুই তো চ্যালেঞ্জ! আমার ব্যবসা। আমার চ্যারিটি। আমার পরিবার।

প্র: উদয়ন নিয়ে কিছু ভাবছেন? যেখানে আজও আপনি মিস্টার স্টিভ ওয় নন। স্টিভ দা!
স্টিভ: ভীষণ উদার মনের ওরা। আগামী এক বছরের মধ্যে উদয়নের আর একটা উইংয়ের কাজ শেষ করে ফেলব। টাকাপয়সা তুলে ফেলেছি। ওই উইংটাতে আরও বাচ্চা থাকতে পারবে। উদয়নের দায়িত্ব যখন আমি নিয়েছি, মাঝপথে ছেড়ে আসার বান্দাই নই। এটা আমার গোটা জীবনের কমিটমেন্ট!

প্র: আর বই লেখা?
স্টিভ: নতুন বই লেখার কাজ শেষ করে ফেলব আগামী বছর অ্যাসেজের আগে।

প্র: ২০১৪-১৫তে ভারত আবার অস্ট্রেলিয়া সফরে আসবে। মনে করা যাক টিমটা বলল চূড়ান্ত সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য এ বার আমাদের প্রোজেক্টে বিশেষ পরামর্শদাতা চাই। আর কেউ নন, স্বয়ং স্টিভ ওয়র বুদ্ধি নিতে চাই অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে আসার জন্য।
স্টিভ— আপনি তখন রাজি হবেন ব্যাগি গ্রিন বনাম ভারত যুদ্ধে ভারতের পথপ্রদর্শক হতে?
স্টিভ: আমার মনে হয় না কোনও আপত্তি হবে বলে। আমি যখন খেলতাম তখনও তো অপোনেন্ট টিম কথা বলতে চাইলে সব সময় বলেছি। ক্রিকেট নিয়ে টিপস। প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলায় আমার সমস্যা হবে না।

প্র: একটা কথা বলুন। সৌরভের টিমকে আপনি মাঠে নেমে খেলেছেন। ধোনির দলকে পর পর দু’টো টেস্টে দেখলেন। তফাত কীসে?
স্টিভ: সৌরভ বোধহয় অস্ট্রেলিয়ায় জেতার জন্য আরও মরিয়া ছিল। টিমকে ও প্রচণ্ড সাহস দিয়েছিল। সৌরভের মধ্যে একটা ইস্পাত-কঠিন ব্যাপার ছিল। ধোনি অন্য রকম ক্যাপ্টেন। খুব ঠান্ডা। রিল্যাক্সড ধরনের। একে আমি খারাপ বলতে পারি না। প্লেয়াররা ধোনির থেকেও ভরসা পায়। তবে অস্ট্রেলিয়ায় এসে অস্ট্রেলিয়াকে মারতে হলে ক্যাপ্টেনকে আরও তেজি হতে হবে। আরও মারকুটে মনোভাব তার দলের মধ্যে ঢোকাতে হবে। যেটা সৌরভ করতে পেরেছিল।

প্র: সৌরভ সম্পর্কে এত বছর পর আপনার মুখে প্রশংসাসূচক কথা শুনে অবাকই হচ্ছি। সাধারণ ধারণা হল যে আপনাদের সেই মাঠের তিক্ততার রেশ আজও রয়ে গেছে।
স্টিভ: না, না আমাদের দেখাটেখা হয় তো। কোনও প্রবলেম নেই।

প্র: বলছিলাম এই যে টসের সময় আপনাকে দাঁড় করিয়ে রাখা থেকে নানান ইস্যু নিয়ে সে বার বিতর্ক।
স্টিভ: টসের সময় দেরি করা নিয়ে আমি বিরক্ত তো হয়েইছিলাম। তবে বেশি বিরক্ত হয়েছিলেন সিরিজের ম্যাচ রেফারি ক্যামি স্মিথ। উনি বলতে থাকেন, এটা কী হচ্ছে?

প্র: সৌরভ গত বছর একটা রিয়ালিটি শো-তে কারণটা প্রথম ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, ড্রেসিং রুমে ব্লেজার ফেলে যান। ওটা ফের খুঁজতে যাওয়ায় টসে দেরি হয়ে গেছিল।
স্টিভ: সৌরভ যা কাহিনি বলছে তাকে আমি কন্ট্রাডিক্ট করব না। বিরোধিতাও না। যা গল্প বলছে বলুক। আমি শুধু জিজ্ঞেস করব, বন্ধু ব্লেজার ফেলে গেছিলে বুঝি? তার মানে কি পর পর টানা ন’বার ব্লেজারটা ফেলে যাচ্ছিলে ড্রেসিংরুমে (হাসি)!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.