ল্যাব বলছে, ডাক্তারেরা রোগী পাঠান না। ডাক্তারদের যুক্তি, তাঁরা ভরসা পান না।
এই চাপান-উতোরের জেরে গ্রামীণ হাসপাতালে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্যাথলজিক্যাল সেন্টার চালানোর প্রকল্প কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। যা কি না গ্রামীণ স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের ভবিষ্যতের উপরেও ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রশ্নচিহ্ন।
সরকারি চিকিৎসা-পরিকাঠামোকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তারের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে গ্রামীণ হাসপাতালে পিপিপি ভিত্তিতে প্যাথলজিক্যাল সেন্টার তৈরিতে জোর দিয়েছে রাজ্য সরকার। রক্ত বা মল-মূত্রের নমুনা পরীক্ষা করাতে গ্রামের মানুষকে যাতে শহরে ছুটতে না-হয়, সে জন্য বিগত সরকারের আমলেই বিভিন্ন জেলা এবং গ্রামীণ হাসপাতালে বেসরকারি সহায়তায় কিছু প্যাথলজিক্যাল ল্যাব তৈরি হয়েছিল। রাজ্যে পালাবদলের পর নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্থির করেন, রক্ত, মল-মূত্র পরীক্ষা বা এক্স-রের পাশাপাশি আলট্রাসোনোগ্রাফি ও ওই জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কেন্দ্রও বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে চালু করা হবে গ্রামীণ হাসপাতালের জমিতে। হাসপাতালের রোগীরা সেখানে সরকারি দরেই পরীক্ষা করাতে পারবেন। তা হলে দু’পক্ষই লাভজনক হবে। এটা আশা করে সরকার চেয়েছিল, যত বেশি সম্ভব সংস্থাকে প্রকল্পটিতে আগ্রহী করে তুলতে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নতুন প্রকল্প তো দূর, পুরনোগুলোরই বেহাল দশা। ফলে বেশ কিছু সংস্থা ইতিমধ্যে নতুন উদ্যোগে অনাগ্রহের কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাদের অভিযোগ: ডাক্তারেরা রোগী না-পাঠানোয় এমনিতেই তারা লোকসান গুনছে। অন্য দিকে চিকিৎসকদের বড় অংশের দাবি: ওখানে প্রশিক্ষিত কর্মী নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান অত্যন্ত নীচু। তাই তাঁরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না। |
সম্প্রতি স্বাস্থ্যভবনে এক বৈঠকেও দু’পক্ষের প্রতিনিধিরা স্বাস্থ্য-কর্তাদের সামনেই ক্ষোভ উগরে দেন। এক ল্যাব সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, “গ্রামীণ হাসপাতালে সেন্টার খুলে রোগী পাচ্ছি না। কর্মীদের বসিয়ে মাইনে দিতে হচ্ছে। অথচ ডাক্তারেরা রোগীদের বলছেন বাইরের বেসরকারি ল্যাবে যেতে!” এক চিকিৎসকের পাল্টা জবাব “দরকারের সময়ে ওখানে কাউকে পাওয়া যায় না। যে পরীক্ষা তৎক্ষণাৎ করা জরুরি, তার জন্য খামোখা অপেক্ষা করব কেন? তা ছাড়া ওদের পরীক্ষার ফলাফলও তো ভরসা করার মতো নয়। ”
চিকিৎসকদের একাংশের ‘অসহযোগিতা’র অভিযোগ যেমন উড়িয়ে দিচ্ছেন না, তেমন পরীক্ষার মান নিয়ে অভিযোগও নস্যাৎ করছেন না স্বাস্থ্য-কর্তারা। রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা শ্যামাপদ বসাক যেমন জানাচ্ছেন, “কয়েকটা সেন্টারে আচমকা পরিদর্শনে গিয়ে প্যাথলজিস্টের সই করা গোছা-গোছা ফাঁকা রিপোর্ট পেয়েছিলাম। সেই সব ফাঁকা রিপোর্টে টেস্টের রিডিংগুলো বসিয়ে দিলেই হল! শুধু তা-ই নয়, সেই টেস্ট যাঁরা করবেন, দেখা গেল তাঁদের ক’জনের ঠিকঠাক ট্রেনিং-ই নেই!”
ছবিটা এখনও খুব বেশি বদলায়নি। যেমন, নদিয়ার করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের পিপিপি কেন্দ্রে প্যাথলজিস্ট নেই। মাঝে-মধ্যে কেউ হয়তো আসেন। অথচ রোজ রোগীদের একাধিক পরীক্ষা হচ্ছে, রিপোর্টও দেওয়া হচ্ছে। কারা বানাচ্ছেন সেই সব রিপোর্ট?
ল্যাব-কর্তৃপক্ষ নিরুত্তর। আবার মালদহের গাজোলে পিপিপি ল্যাব থাকলেও ডাক্তারেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের ‘রেফার’ করেন অন্য বেসরকারি ল্যাবে। হাওড়া কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও মোটামুটি তা-ই। ডাক্তারদের অভিযোগ, দুপুর বারোটা না-বাজতেই সেন্টারে কাউকে পাওয়া যায় না। ল্যাব-কর্মীদের ব্যাখ্যা, “রোগীই আসে না! কাঁহাতক দোকান খুলে বসে থাকব?”
আর এই কাজিয়ার মাঝে পড়ে সবচেয়ে দুর্দশা রোগীদের। এক স্বাস্থ্য-কর্তার আক্ষেপ, “ওঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না, কোথায় গিয়ে ঠিকঠাক পরিষেবাটা পাবেন। সর্বত্র চক্র কাজ করছে। এক-এক জায়গায় তো বেসরকারি ল্যাব ডাক্তারদের বিলপিছু ৫০% কমিশন দেয় বলে শোনা যাচ্ছে! তাদের পরীক্ষাটাই বা কী মানের হয়?”
তা হলে গ্রামীণ স্তরে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির প্রচেষ্টা কি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে চলেছে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র অবশ্য হাল ছাড়তে রাজি নন। বরং আশাবাদের সুরেই তিনি জানাচ্ছেন, রাজ্যে এখন এমন ৬৫টি পিপিপি কেন্দ্র রয়েছে। চলতি বছরে তাঁরা সংখ্যাটা বাড়িয়ে একশোয় নিয়ে যেতে চান। পরীক্ষার গুণমানে যাতে কোনও আপস না-হয়, সে ব্যাপারে সংস্থাগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সচিবের মন্তব্য, “গোড়ায় এমন সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে হয়। ঠিকও হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। স্থিতিশীল হতে শুধু একটু সময় লাগছে।” |