আসলে বি-টিম তৃণমূলই, সুর চড়াল কংগ্রেস
রও ‘চড়া মাত্রা’য় পৌঁছল রাজ্য সরকারের দুই শরিক কংগ্রেস-তৃণমূলের ‘চাপানউতোর’।
মঙ্গলবার প্রকারান্তরে কংগ্রেসকে সিপিএমের বি-টিম বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার প্রকাশ্য সভা থেকে তার পাল্টা তোপ দাগলেন কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সি। বললেন, “আমরা নই। তৃণমূলই সিপিএমের বি-টিম!”
প্রিয়রঞ্জন-জায়া দীপার সঙ্গে মমতার সম্পর্ক বরাবরই ‘শীতল’। এ দিন রায়গঞ্জের সাংসদের কড়া মন্তব্যের পর তা আরও ‘তিক্ততা’র দিকে যাবে নিঃসন্দেহে। দীপা অবশ্য আগেও মমতার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে মুখ খুলেছেন। কিন্তু এ দিন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তীব্র তৃণমূল তথা সরকার-বিরোধিতা করেছেন রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য মানস ভুঁইয়া এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও।
মমতা অবশ্য ওইসব মন্তব্যকে ‘গুরুত্ব’ দিতে চাননি। মহাকরণে তাঁকে কংগ্রেসের সভা নিয়ে প্রশ্ন করলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এটা (মহাকরণ) সরকারি মঞ্চ। এখানে কোনও রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেব না। তবে কতগুলো জায়গায় উত্তর দেওয়ার দরকার হয়। আমি জানি, কোনটার উত্তর দেওয়া উচিত, কোনটার নয়।” কংগ্রেসের বক্তব্য নিয়ে তৃণমূলের ‘রাজনৈতিক জবাবে’র জন্য তিনি দলের নেতা মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পার্থবাবু, ফিরহাদ এবং মদন যা বলেন, তার মোদ্দা কথা কংগ্রেস ‘দ্বিচারিতা’ করছে এবং তৃণমূল ছাড়া কংগ্রেসের অস্তিত্ব এ রাজ্যে ‘বিপন্ন’।
কংগ্রেসের সভা চলতে চলতেই অবশ্য তৃণমূল সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী সোমবার ময়দানে গাঁধীমূর্তির পাদদেশে তারা কংগ্রেসের ‘জবাবি সভা’ করবে। তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী জানিয়ে দেন, সিপিএম-কংগ্রেসের ‘যৌথ কুৎসা’র জবাব দিতে তাঁরা ওই ‘পাল্টা জমায়েত’ করবেন। শুভেন্দুর কথায়, “মানুষকে বিভ্রান্ত করতে যে কুৎসা সিপিএম এবং কংগ্রেস করছে, তারই জবাব দেওয়া হবে ওই সমাবেশে।”
মহাকরণে মমতার ‘প্রতিক্রিয়া’ এবং পাশাপাশি শুভেন্দুর নেতৃত্বে সভা করানোর সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট যে, মমতা নিজে কংগ্রেসের অভিযোগকে তেমন ‘গুরুত্ব’ আপাতত দিচ্ছেন না। যদিও কংগ্রেসের তরফে যাবতীয় অভিযোগ ছিল সরকার, প্রকারান্তরে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই।
রাজ্যে ধান-চালের সহায়ক মূল্য, সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনের নামবদল এবং বড় শরিকের ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূল ‘টানাপোড়েন’ চলছিলই। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি বলেন, “সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেস আমাদের সরকারকে বিপাকে ফেলতে চায়।” তারই ‘রাজনৈতিক জবাব’ এ দিন দিয়েছে কংগ্রেস। দীপার কথায়, “লোকসভায় এফডিআই প্রশ্নে ওয়েলে নেমে একসুরে গলা মিলিয়েছে সিপিএম, আরএসপি, তৃণমূল। তা হলে কি তৃণমূলকে সিপিএমের বি-টিম বলতে পারি না!” তাঁর আরও যুক্তি, “লোকপাল বিল সংক্রান্ত সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের সুখেন্দুশেখর রায় কিন্তু একটিও নোট অফ ডিসেন্ট দেননি। কিন্তু আমরা তিনটি নোট অফ ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। সুখেন্দুবাবু নোট অফ ডিসেন্ট দিলেন রাজ্যসভায় বিল পেশের পরে! লোকসভায় তৃণমূল আমাদের পক্ষে রায় দিল। কিন্তু রাজ্যসভায় সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিলের বিরোধিতা করল বিজেপি-তৃণমূল। তা হলে কি তৃণমূলকে সিপিএমের বি-টিম বলতে
পারি না!”
বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ভোটে লড়ার বিষয়ে তৃণমূলের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য মানসবাবুর বক্তব্য, ‘‘সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ, রাহুল গাঁধী ও কংগ্রেসকে অপদস্থ করার জন্য সারা ভারত জুড়ে এক চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইটা চালাতে হবে।”
কংগ্রেসের এ দিনের অবস্থানে ভিড় হয়েছিল ভালই। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধানের ছড়া, হাল নিয়ে কৃষক ও জনতার উপস্থিতি দেখে অবস্থান মঞ্চ থেকে ‘উৎসাহিত’ প্রদীপবাবু বলে ফেলেন, “এর পরের সমাবেশ শহিদ মিনারের পাদদেশে করা হবে।” বস্তুত, ‘উৎসাহিত’ কংগ্রেস এ দিন ঘোষণা করেছে, ধান-পাটের সহায়ক মূল্যের দাবিতে গোটা জানুয়ারি মাস জুড়ে প্রত্যেক জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হবে। ঘটনাচক্রে, বহুদিন পর প্রদেশ কংগ্রেসের সমাবেশে দলের সব গোষ্ঠীর নেতারাই উপস্থিত ছিলেন। প্রাক্তন বিধায়ক আব্দুল মান্নানের কথায়, “তৃণমূল খোঁচা দিয়ে ভাল করেছে। পুরো দলটা এককাট্টা হয়ে গিয়েছে।” তবে ‘ব্যতিক্রম’ ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি ও বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। তাঁকে এ দিনের কর্মসূচিতে ‘আমন্ত্রণ’ জানানো হয়নি বলেই অধীরের দাবি। তবে প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “অধীরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।”
সভায় না-এলেও অধীরও দীপার সুরেই বলেছেন, “লোকপাল থেকে এফডিআই নিয়ে তৃণমূল তো বিজেপি-সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে!”
তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণের’ সুর বেঁধে দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেত্রী মালা রায়। তিনি বলেছিলেন, “মার খেয়ে, মার দিয়ে আমরা বেঁচে আছি। ৩৪ বছর ধরে সিপিএমের মার খেয়ে এবং মার দিয়ে কংগ্রেস করছি। কংগ্রেসের উপর যে দল আক্রমণ করবে, তাদেরও মার দেব। সে দল জোটে থাকুক বা না-থাকুক।” দীপা প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, “আপনি জনবিরোধী কোনও সিদ্ধান্ত নিলে কংগ্রেসও তার বিরোধিতা করবে।” কিন্তু এতদিন বিভিন্ন প্রশ্নে যে কংগ্রেস নেতা তথা মন্ত্রী মানসবাবুর অবস্থান তুলনায় ‘নরম’ ছিল, তিনিও এদিন সুর যথেষ্ট চড়িয়েছিলেন। তবে তাঁর বক্তব্য পুরোটাই ছিল ‘কংগ্রেসকর্মী’ হিসেবে। ‘রাজ্য সরকারের মন্ত্রী’ হিসেবে নয়। সম্ভবত সেই কারণেই সরকার-বিরোধী কথা বলেও ‘সমস্যা’ সমাধানের দায় মানসবাবু ছেড়ে দেন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপবাবুর উপরেই। তাঁর কথায়, “প্রদেশ সভাপতি রাতেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সঙ্গে কথা বলুন। জোটে রয়েছি বলেই লক্ষ্মণরেখা মেনে চলি। কিন্তু সহযোগীরা সেই নিয়ম মানছেন না। জোট ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য দলের নির্দেশে পেলেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব।” তাঁর আরও বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে উন্নয়নের যৌথ রূপরেখা তৈরি করুন প্রদেশ সভাপতি। আমরা সৈনিক হয়ে মাঠেঘাটে তার রূপায়ণ করব।”
প্রদীপবাবু অবশ্য আলোচনার রাস্তায় যাওয়ার লক্ষণ দেখাননি। বরং কটাক্ষের সুরে তিনি বলেন, ‘‘সরকার সুষ্ঠুুভাবে চালাতে আমরা সমন্বয় কমিটি গড়তে বলেছিলাম। কিন্তু আমরা ৪২টি আসনে জিতেছি, ওঁরা ১৮৪টিতে। তাই আমাদের দাবি মানা হয়নি।” প্রদেশ সভাপতির পাল্টা হুঁশিয়ারি, “পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসকে দুর্বল ভাববেন না। গত ৩৪ বছর লড়েছি। দরকারে আরও পাঁচ বছর লড়ব। সিপিএমকে নিয়ে লড়তে হবে, এমন দৈন্যদশা কংগ্রেসের কোনও দিনও হবে না।”
কংগ্রেস নেতাদের পাল্টা প্রশ্ন, মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই সরকারকে অপদস্থ করা হচ্ছে বলে কেন শুনতে হবে? মানসবাবুর বক্তব্য, “দয়া করে কানে দেখবেন না। চোখ দিয়ে দেখুন। কান দিয়ে শুনুন।”
মুখ্যমন্ত্রীকে কড়া ভাষায় তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মী বলেছেন, “কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করার যে অভিযোগ উঠছে, তার জবাবে বলব, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মর্যাদা দেয় একমাত্র কংগ্রেসই। কেন্দ্রীয় সরকারকে গালমন্দ করেও দাবি করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, সনিয়া গাঁধী-সহ কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কিছু নাকি বলা হচ্ছে না! কেন্দ্রীয় সরকারকে গালমন্দ করলে প্রধানমন্ত্রী, সনিয়া’জি বাদ পড়েন কী ভাবে? যিনি ওই দাবি করেছেন, তাঁকে (মমতা) বলছি, এর জবাব দিন!”
কংগ্রেসের আক্রমণের আরও ‘কড়া’ জবাব এসেছে তৃণমূলের তরফে। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যখন বলেছেন, “তৃণমূলের সঙ্গে থেকে কংগ্রেস ফায়দা তুলছে। কংগ্রেসের সঙ্গে যে দিন তৃণমূল থাকবে না, সে দিন পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে ওরা মুছে যাবে!” মন্ত্রী মদন মিত্রের বক্তব্য, “চ্যালেঞ্জ করছি, জোট ছেড়ে পদত্যাগ করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ছেড়ে একা লড়ে জিতে আসুন!”
আর বর্ষীয়ান মন্ত্রী পার্থবাবুর বক্তব্য, “ওঁরা দিল্লিতে গিয়ে ধর্না দিন না! কেউ কাউকে দুর্বল ভাবছে না। জোটধর্ম মানে সবকিছু বিসর্জন দেওয়া নয়। কেউ মিথ্যাচার, দোষারোপ, রাজনৈতিক আক্রমণ করলে তার উত্তর না-দিয়ে চুপ করে থাকব, ভাববেন না।”
ইন্দিরা ভবনের নামবদল বিতর্ক নিয়ে কংগ্রেসিরা প্রত্যাশিত ভাবেই ‘আবেগতাড়িত’। সেই বিতর্কের সূত্রেই সরাসরি মমতাকে আক্রমণ করে দীপা এদিন বলেছেন, “পারলে ইন্দিরা ভবনের নাম মুছে দিন! আপনারাও যতগুলো প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন, আমরা সবক’টা শিলা মুছে দেব!”
দেখার, কংগ্রেস সাংসদের এই ‘প্ররোচনা’ও এ দিনের মতোই এড়িয়ে যান কিনা ‘উন্নয়নকামী’ মুখ্যমন্ত্রী।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.