জন ইনভেরিটির মাথা কি পিছনে কাজ করল? না কি অস্ট্রেলীয় ড্রেসিংরুমের কোনও কর্তার ভাবনা?
অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকেরা বলতে পারলেন না। সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত ‘সোর্স’-এর অভাবেও ঝুঁকি নিয়ে লিখছি ইনভেরিটি! অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানের মতো শরীরী ভাষার ওপর এত গুরুত্ব আরোপ এই গোলার্ধে আর কেউ করে না। পার্থবাসী ইনভেরিটি যখন শেফিল্ড শিল্ডে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিতেন, যে কোনও বিপক্ষ তাঁর টিমের শরীরী ভাষাকে গ্রাহ্য করতে বাধ্য হত। এত লড়াকু আর হাড় হিম করে দেওয়া ছিল সেই ভাষা!
বুধবার খেলা শুরুর সময় একটা অদ্ভুত শরীরী ভাষা দেখাল অস্ট্রেলিয়াও। দলবল নিয়ে ধোনি দড়ির ধারে ‘হাডল’ করছেন। তাঁরা মুখ তুলে দেখলেন দুই ব্যাটসম্যান কখন ক্রিজে পৌঁছে শ্যাডো প্র্যাক্টিস শুরু করে দিয়েছেন। রিকি পন্টিং আর মাইকেল ক্লার্ক তখনও তাঁদের তিনশো ছুঁইছুঁই পার্টনারশিপের শৃঙ্গারোহণ থেকে অনেক দূরে। বলা যেতে পারে বেস ক্যাম্পে। কিন্তু মোক্ষম ওই একটা শরীরী সংকেতেই তাঁরা বোলিংকে বিশাল হুক-পুল মারলেন: ওহে ইন্ডিয়া, এসো। নামো। আমাদের তো আর তর সইছে না। কতক্ষণে তোমাদের পেটাব! |
ভারতের শরীরী ভাষা তখন থেকেই ঝুলে গিয়েছে। রাতে প্রসিদ্ধ অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক মাইক কাওয়ার্ডের দেওয়া ক্রিকেট পার্টিতে সবার এক প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া তো তখনও ৭৫ রান পিছিয়ে। তখনই ইন্ডিয়া লড়াই ছেড়ে দিল কেন? পিচ যে দ্বিতীয় দিনে একেবারে ভারতীয় উপমহাদেশোচিত হয়ে গিয়েছে সেটা অবশ্যই সবচেয়ে বড় কারণ। আর তার সঙ্গে ছোট কারণ হল, অস্ট্রেলীয়দের এই ঠিকরে আসা বিশ্বাসে ভারত আরও বিপন্ন বোধ করতে শুরু করে। যখন দিনের প্রথম বলটাই কিনা হয়নি!
সন্ধেবেলা ক্লার্ক আর পন্টিংকে জমিয়ে যৌথ প্রেস কনফারেন্স করতে দেখে মনে হল, তেন্ডুলকর-উৎসবে তাঁরাই যাবতীয় জাঁকজমক আর আলো নিয়ে চলে গেলেন! নভেম্বরে এঁরাই কিনা কুখ্যাত সেই ‘ফর্টি সেভেন অলআউট’ অধ্যায়ে জড়িত ছিলেন। আর আজ সারা দিনে রেকর্ডের পর রেকর্ড মড়মড়িয়ে ভেঙে দিতে দিতে এগোলেন। ৩৬৬ রান উঠল। একমাত্র পন্টিংয়ের উইকেট গিয়ে।
ক্লার্ক গড়পড়তা দিনে আবেগের লোক। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করার আগে বেঙ্গালুরুতে হেলমেট খুলে ব্যাগি গ্রিন পরেছিলেন। যেহেতু তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্যাগি গ্রিন টুপিতে মর্যাদাব্যঞ্জক হোক জীবনের প্রথম টেস্ট মাইলস্টোন। মনে রাখবেন, শত প্রলোভনেও ক্লার্ক আই পি এল খেলেন না। আবেগ এবং ভরপুর রোম্যান্স না থাকলে এ জিনিস হয় না। অথচ এ দিন এস সি জি-তে তিনি নিছকই অঙ্ক শিক্ষক। সিডনি মাঠে কোনও অস্ট্রেলীয়র করা সর্বোচ্চ রানের ইনিংস (ডাগ ওয়াল্টার্স, ২৪২) ভাঙলেন। নিজে প্রথম দু’শো করলেন। ভারতের বিরুদ্ধে এক দিনে এত রান বাড়িয়ে রাখলেন। সবচেয়ে জরুরি-- সিরিজ থেকে বাইরে করে দিলেন ভারতকে। |
এসসিজি-র দর্শকদের দিকে আপত্তিকর ইঙ্গিত বিরাট কোহলির।
পরে তিনি টুইটারে লিখেছেন, “...দর্শকরা যখন আপনার মা এবং বোন নিয়ে
অত্যন্ত কুৎসিত কথা বলে তখন আর কী করা যায়?”--গেটি ইমেজেস |
রিকি পন্টিং! অন্য দিকে তাঁর অঙ্ক আর বিজ্ঞানভিত্তিক খেলা নিয়ে কামড়ে পড়ে আছেন। অথচ সেটাকেই সিডনি মাঠ আবেগের থ্রি-ডি চশমায় দেখছে। এমসিজি-র দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি আর হাসি মিলে অস্ট্রেলিয়াকে উদ্ধার করেছিলেন। আর এখানে বাঁচালেন ক্লার্ককে জুড়ি নিয়ে। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক রান অনেক বেশি করতে পারেন! কিন্তু পার্টনারশিপের অভিভাবকত্ব করলেন পন্টিং।
জাহিরকে তুলে তুলে খেললেন। ইশান্তকে ড্রাইভ আর স্কোয়ার কাট মারলেন। অশ্বিন যত বার পড়লেন পন্টিংয়ের সামনে, তত বারই মনে হল হরভজনের ব্যাপারে এত কঠোর হওয়া উচিত হয়নি। ভাজ্জির ফর্ম যা-ই থাক, অস্ট্রেলিয়াকে বল করতে গেলে ফর্মের আগে চাই বুকের ছাতি! সেটা মাঠে হাজির থাকলে পন্টিংয়ের কাজটা এত সহজ হয়ে যায় না। একটাই কাঁটা হাজির হল। যখন ৯৯ রানে মিড উইকেটে পুশ করে সিঙ্গলসটা নিতে গেছিলেন। জাহির বাঁ হাতে ছুুড়লেন। পন্টিং তখন ডাইভ দিয়ে পড়লেন। কাদাটাদা বুকে মেখে যখন উঠে দাঁড়ালেন, দেখলেন জাহিরের যে থ্রো-টা লাগলে তিনি অব্যর্থ রান আউট, সেটা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট। দুটো টেস্টের মধ্যে সবচেয়ে গভীর মুহূর্ত তখনই তৈরি হল যখন দু’বছর আর চৌত্রিশ টেস্টের খরা কাটিয়ে পন্টিং চল্লিশতম টেস্ট সেঞ্চুরিটা করে ফেললেন। কোথাও যেন স্টিভ ওয়কে ঘিরে এ মাঠেই তৈরি ঘন আবেগের বাষ্পের ঝলক সেখানে। গোটা মাঠ সাম্মানিক অভিবাদন দিচ্ছে উঠে দাঁড়িয়ে। গ্যালারির একটা অংশ গাইছে হিপ হিপ হুররে। টেনিস কোর্টের পিছনে রঙিন ঘুড়ি উড়ছে। পুলিশ কর্মীরা মাঠের দিকে পিছন করে পজিশন নিয়েছেন। যদি কেউ নেমে পড়ে। যদি কেউ উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে অবাঞ্ছিত কিছু ছোড়েটোড়ে।
ভারত যে চলতি সিরিজে এতদ্বারা তাদের পথ আহরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল। সচিনের পক্ষে আর যে চূড়ান্ত অস্ট্রেলিয়া জয় সম্ভব হল না এ সব জনতা আদৌ তখন ভাবছে না। পিছিয়ে পড়া এক মহাযোদ্ধা, খাদের কিনারা থেকে যে প্রত্যাগমন করেছে এই লড়াইতেই তাঁরা তখন ভিজে! পন্টিং অধ্যায়কে তখন মনে হচ্ছে লাইভ সোপ অপেরা। টেস্ট ম্যাচ ছিনিয়ে নেওয়াটেওয়া নয়।
সেঞ্চুরির হাততালি থামতে থামতেই দ্রুত শুরু হয়ে গেল ভারতকে টিকাটিপ্পনী আর ব্যঙ্গ। ধোনি তখন সম্পূর্ণ হুঁশ হারিয়েছেন মনে হচ্ছে। ভীষণ রক্ষণাত্মক ফিল্ড আর মোটামুটি যাঁকে পারছেন তাঁকেই বল করতে ডাকছেন। অনিয়মিত বোলাররা যত আসছেন তত দর্শকদের মেজাজ আরও তপ্ত হচ্ছে। বিরাট কোহলির সঙ্গে লাগল এই সময়েই। সচিন ছাড়া সবাই এখন ব্যারাকিং শুনছেন। এমনকী সময় সময় রাহুল দ্রাবিড়ও। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় ভারতীয় দর্শক-ভারতীয় ব্যাটসম্যান সম্পর্কটা ফের পরীক্ষিত হবে।
রাতে মাইক কাওয়ার্ডের বাড়ির পার্টিতে যখন বিশ্বকাপের সময়কার শঙ্কর মহাদেবনের গানটা বাজছে, ‘খেল খিলাড়ি বাহে বাহে, দে ঘুমাকে’ কোনও কোনও অভ্যাগত বললেন, “মনে হচ্ছে গানটা খ্রিষ্টপূর্ব যুগের। কেন-না টেস্ট সিরিজে মাত্র ছ’দিনেই ভারত এমন অবহাওয়া তৈরি করে ফেলেছে যে ক্রিকেট মহলে কেউ আর কোনও লগ্নিতে ভরসা পাচ্ছে না।” অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মহলের কিছু চাঁই হাজির সেখানে। শীর্ষস্থানীয় অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকেরাও। আলোচনার হাই ডেসিবল বিষয় মাত্র দু’টো: পরিবারের অনুরোধে পিটার রোবাকের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত এবং ভারতীয় বোলিং-ব্যাটিং।
সচিন তেন্ডুলকরের শততম নিয়ে যে বহু দিন বাদে একটাও কথা খোদ ক্রিকেট মহলে উচ্চারিত হল না, এটাই মনে হয় পন্টিং-ক্লার্কদের আসল সেঞ্চুরি!
|
সিডনির স্কোর |
ভারত প্রথম ইনিংস: ১৯১
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস (আগের দিন ১১৬-৩) |
পন্টিং ক সচিন বো ইশান্ত ১৩৪
ক্লার্ক ব্যাটিং ২৫১
হাসি ব্যাটিং ৫৫
অতিরিক্ত ১৮, মোট ১১৬ ওভারে ৪৮২-৪।
পতন: ৮, ৮, ৩৭, ৩২৫।
বোলিং: জাহির ২৬-৪-১০৬-৩, উমেশ ১৮-২-৯৪-০, ইশান্ত ২২-০-১০৬-১,
অশ্বিন ২৮-৪-১০৩-০, সহবাগ ১৪-১-৩৮-০, বিরাট ৮-০-২৩-০। |
|