আদিগঙ্গায় দূষণ কতটা, তা জানে না খোদ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদই। রাজ্যের যে সব নদী ও জলাশয়ের দূষণ-মাত্রা পর্ষদ নিয়মিত মাপে, সেই তালিকায় ঠাঁই হয়নি কালীঘাট মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই প্রাচীন নদীটির। কারণ, সেটি আর ‘নদী’ পদবাচ্য নয়, আদিগঙ্গা এখন কার্যত নর্দমা। গত সোমবারই কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ পটেল পর্ষদের কাছে জানতে চেয়েছেন, আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে তারা কী করছে?
আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাঁদের যে প্রায় কিছুই করার নেই, তা মেনে নিয়েছেন পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কান্তি দত্ত। তবু পর্ষদের ইঞ্জিনিয়ার এবং আধিকারিকেরা মঙ্গলবার আদিগঙ্গার জলের নমুনা সংগ্রহ করেছেন দূষণের মাত্রা পরীক্ষার জন্য। তার ফলাফল আজ, বৃহস্পতিবার জানা যাবে। বিনয়বাবু বলেন, “শুধু আদিগঙ্গা নয়, রাজ্যের যে কোনও জলাশয়ের দূষণ পর্যবেক্ষণ করা এবং যারা দূষণ করে, তাদের নিষেধ করে নোটিস পাঠানো আমাদের কাজ।” কিন্তু পর্ষদ কি আদিগঙ্গার দূষণ পর্যবেক্ষণ করে? এর স্পষ্ট জবাব বিনয়বাবুর কাছে মেলেনি। তিনি শুধু জানিয়েছেন, আদিগঙ্গার দূষণ নিয়মিত মাপা হয় না। শেষ কবে আদিগঙ্গার দূষণের মাত্রা পর্ষদ পরীক্ষা করেছে, তা-ও জানাতে পারেননি তিনি।
পর্ষদ আদিগঙ্গাকে নদী মনে না-করলেও সারা দেশের লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী কালীঘাটের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আদিগঙ্গার জলকে ‘পবিত্র’ মেনে মাথায় ছোঁয়ান। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র মনে করেন, অন্তত ওই পুণ্যার্থীদের কথা ভেবেও আদিগঙ্গা দূষণমুক্ত করা উচিত। আদিগঙ্গার মতো একটি ঐতিহ্যশালী নদীর এমন অবস্থা মোটেই কাম্য নয়। কলকাতা পুরসভার অন্তত ২৪টি নিকাশি নালা আদিগঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। সেই বর্জ্যের পুরোটাই আদিগঙ্গা হয়ে গঙ্গায় যায়। বস্তুত, আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারলে গঙ্গাকেও দূষণমুক্ত করা যাবে না।
কল্যাণবাবু বলেন, “গোটা দক্ষিণ কলকাতার সমস্ত নোংরা জল আদিগঙ্গা বহন করে। ভাটায় ওই নোংরা জলের পুরোটাই গঙ্গায় গিয়ে পড়ে।” এখনও আদিগঙ্গার জোয়ারের জল পৌঁছে যায় প্রায় টালিগঞ্জ পর্যন্ত। এমন জোয়ার-ভাটা খেলা গঙ্গার একটি উপনদীকে নর্দমা হিসেবে গণ্য করাটা কোনও ভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। |
মধ্যযুগ থেকে স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে পর্যন্তও আদিগঙ্গা নৌ-বাণিজ্যের প্রধান পথ হিসেবে বিবেচিত হত। এ কথা জানিয়ে কল্যাণবাবু বলেন, “মেট্রো রেলের স্তম্ভ এবং স্টেশন তৈরি হওয়ার পরে আদিগঙ্গার সর্বনাশ সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখনও টালিগঞ্জ থেকে গঙ্গা পর্যন্ত আদিগঙ্গার দূষণমুক্তি সম্ভব। সে জন্য ওই নদীতে শহরের বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। পলি তুলে নদীর গভীরতা বাড়াতে হবে। তার পরে ওই নদীতে স্বচ্ছন্দে জোয়ার-ভাটা খেলতে দিতে হবে।”
কিন্তু সে কাজ করবে কে? গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের দু’টি পর্যায়ে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার পরেও আদিগঙ্গার দূষণমুক্তি নিয়ে এক পা-ও এগোয়নি কলকাতা পুরসভা। পুরসভার এক আধিকারিক জানান, নিকাশির জল আদিগঙ্গায় না-ফেলে তা ঘুরিয়ে বালিগঞ্জের নোংরা জল পরিশোধন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে ১২টি পাম্প বসানো হয়েছে। কিন্তু সেগুলি আদৌ কাজ করছে কি না তা তাঁর জানা নেই। কিন্তু আদিগঙ্গার দু’পাশের বাসিন্দা এবং কালীঘাটের পুণ্যার্থীরা জানেন, কী বিপুল পরিমাণ বর্জ্য বহন করে ওই ‘পবিত্র’ নদী। এ শহরে দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে সব কাজ এখনও পর্যন্ত হয়েছে, তার প্রায় সবই আদালতের নির্দেশে। রাজ্য প্রশাসন বা পুরসভার উদ্যোগ প্রায় সব ক্ষেত্রে অত্যন্ত হতাশাজনক। আদি গঙ্গার দূষণমুক্তির জন্যও শেষ পর্যন্ত ভরসা সেই আদালতই। |