অনশন নামক অস্ত্রটি অদ্ভুত। যে উদ্দেশ্যে তাহা ব্যবহৃত হইতেছে, তাহাকেই ইহার দ্বারা আঘাত করা হয়, না কি যিনি এই অস্ত্র ব্যবহার করিতেছেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত বেশি আহত হন? সন্দেহ নাই, অনশনকারী নিজেকে ‘আহত’ করিয়াই উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করেন। নিজেকে আহত করিবার সহজতম পরিসরটি তাঁহার নিজেরই শরীর, সর্বাপেক্ষা ব্যক্তিগত সম্পদ। কিন্তু এক জটিল অর্থেও কথাটি সত্য বটে। অনশন যিনি করেন, তিনি নিজের দুর্বলতাকে প্রকট করিয়া দেন। সেই দুর্বলতা যুক্তির পরিবর্তে আবেগ, ‘সামাজিক’-এর পরিবর্তে ‘ব্যক্তিগত’র দ্বারস্থ হইবার দুর্বলতা। লোকপাল আন্দোলন যে মুহূর্তে অণ্ণা হজারের অনশন-নির্ভর হইয়া পড়ে, আলোচনা ও পর্যালোচনার মধ্যে লোকপাল বিলের সমপরিমাণ স্থান লন অণ্ণা নিজেও। ব্যক্তি-কে এই ভাবে উদ্দেশ্যের সহিত একীভূত করিয়া ফেলার পদ্ধতিটি আপত্তিজনক। সংসদীয় গণতন্ত্রমতে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা চলে, তাহার পক্ষে তো আপত্তিজনক বটেই। সম্ভবত এই কারণেই, প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটিয়া যাওয়ার পর হজারের অনশনের জনপ্রিয়তা অধুনা কমতির পথে। এত বড় দেশে, গণতান্ত্রিকতার মোড়কে আচ্ছাদিত বহুবিচিত্র সংস্কৃতির একত্রতায়, ব্যক্তিনির্ভর আন্দোলনের আহ্বান দীর্ঘমেয়াদি হইতে পারে না। আর এক উদাহরণ মণিপুরের ইরম শর্মিলা চানু। দ্বাদশ বৎসরের অনশনে তাঁহার অভিপ্রায়ের শক্তি ও গভীরতা দেশবাসীর মাথা নোয়ায়, কিন্তু তাঁহার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আস্থা আনে না। তাঁহার আন্দোলন যে রাষ্ট্রব্যাপী অনুরণন তুলিতে পারে নাই, তাহার অন্যতম কারণ কিন্তু তাঁহার একান্ত ব্যক্তিগত রণনীতি, সেখানে সম্মেলকের স্থান নাই, সামাজিক শক্তির প্রয়োজন নাই, তাঁহার নিজস্ব আবেগের পাশে যুক্তির অস্ত্র শানাইয়া তুলিবার তেমন প্রচেষ্টা নাই।
প্রশ্ন উঠিবে, পরাধীন এবং স্বাধীন ভারতে কি সফল অনশন আন্দোলনের উদাহরণের কোনও অন্ত আছে? এ ক্ষেত্রে দুই-একটি কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন। পরাধীন ভারতে গাঁধীজি যখন অনশনে ব্রতী হইতেন, তাহা ছিল বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে পরাধীন জাতির প্রতিবাদ। তাহার অন্তর্নিহিত আবেগের প্রকৃতিই ছিল ভিন্ন। গাঁধীজির অনশন যাঁহারা সমর্থন করিতেন না, তাঁহারাও সহসা তাঁহার সমালোচনা করিতেন না, বিরোধিতা তো দূরস্থান। ছয় দশক সগৌরবে অতিক্রান্ত স্বাধীন গণতন্ত্রী দেশের সহিত সেই সময়কার বাস্তবের তুলনা চলে না। স্বাধীন ভারতেও প্রথম দিকে সাফল্যের উদাহরণ রহিয়াছে, তাহা তেলুগুভাষী রাজ্যের জন্য ১৯৫২ সালে পট্টি শ্রীরামালুর আমরণ অনশন। তাঁহার মৃত্যুর পরই প্রধানমন্ত্রী নেহরু রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিপরীতে হাঁটিয়া অন্ধ্রপ্রদেশ তৈয়ারি করিয়া দেন। তখনকার মতো সফল হইলেও এই উদাহরণ ভারতের ইতিহাসে একটি লজ্জার অধ্যায় হইয়া থাকে। যুক্তির বিরুদ্ধে গিয়া জেদাজেদির নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ করা হয়। কিন্তু অসফল অনশনের তালিকাটিও কি দীর্ঘ নহে? শ্রীরামালুর পথ ধরিয়া তেলেঙ্গানা দাবির পক্ষে-বিপক্ষে কম অনশন ও আত্মহনন ঘটে নাই, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সে সকল কুনাট্য তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পাইলেও দীর্ঘমেয়াদি ছাপ রাখিয়া যায় নাই। গাঁধীজিও নিজেও একাধিক বার অনশন বাতিল ঘোষণা করিয়াছেন। ১৯১৮ কিংবা ১৯৩২, তাঁহার অনশন বাতিলের কারণ হিসাবে নৈতিক অপ্রস্তুতির কথা বলা হইলেও সন্দেহের কারণ বিস্তর যে সম্ভাব্য অসাফল্যের ইঙ্গিতেই তিনি পথ পালটাইয়াছিলেন। তিনি জানিতেন, এই অস্ত্র ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়া তাঁহার নিজের পক্ষে বিপজ্জনক, কারণ অস্ত্র তো তিনি নিজেই, স্বয়ং। ইতিহাস যেমন ব্যক্তির মহিমা ভোলে না, ব্যক্তির মহিমাস্খলনও ভোলে না। উত্তরণ ও স্খলনের সেই চুলপরিমাণ দূরত্বের পরিসরটুকুতেই অনশন নামক অস্ত্রটির লীলাখেলা। |