চৌত্রিশ বছর ধরে অনেক অজুহাত শুনিয়েছেন। এ ভাবে কাজ ফেলে রাখবেন না। সময়ের মধ্যে কাজ শেষের চেষ্টা করুন। দেখছেন তো কাজ পড়ে থাকায় কত অসুবিধা হচ্ছে।
না, এই উক্তি তৃণমূলের কোনও মন্ত্রী বা নেতার নয়। তাঁরা এমন তো হামেশাই বলছেন। আশ্চর্যের হল, তৃণমূল সরকার নিয়োজিত কমিটির আধিকারিকরাও এখন প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে রাজনীতির ভাষাতেই কথা বলছেন! মঙ্গলবার মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু-ওয়ার্ড পরিদর্শনের সময়ে পূর্ত দফতরের কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র (বিদ্যুৎ) প্রণব সামন্ত-কে বামফ্রন্টের ‘চৌত্রিশ’ বছর টেনে রীতিমতো ধমক দিলেন স্বাস্থ্য বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গী রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সে দিন আর নেই। সমন্বয় রেখে কাজ করতে অসুবিধা কোথায়? এখন মেডিক্যাল এডুকেশন আর হেলথ সার্ভিস এক সঙ্গে কাজ করছে। কোনও সমস্যা হচ্ছে না। তা হলে আপনারাই বা পারবেন না কেন! কাজ আর ফেলে রাখা যাবে না।” দুই স্বাস্থ্য-কর্তার এ হেন বক্তব্যে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে প্রণববাবু বলেন, “আমরা সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।” |
মেদিনীপুর মেডিক্যালের শিশুবিভাগে প্রতিনিধিদল। নিজস্ব চিত্র। |
শিশু ও সদ্য মা-দের মৃত্যু-হার কমাতে টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে রাজ্য সরকার। চেয়ারম্যান ত্রিদিববাবুর নেতৃত্বে ওই কমিটিরই এক প্রতিনিধি দল এ দিন মেদিনীপুর মেডিক্যাল পরিদর্শনে আসে। রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুশান্তবাবুও ওই কমিটিরই সদস্য। পরিদর্শনে কিছুটা অসন্তুষ্টই কমিটির সদস্যরা। তাঁদের অসন্তোষের কারণ, পূর্ত দফতরের ‘কাজে গড়িমসি’। যে কাজ এক সপ্তাহে শেষ হওয়ার কথা, সেই কাজ এক বছরেও হচ্ছে না বলে অভিযোগ।
মেডিক্যালের শিশু-ওয়ার্ডের ছাদে জলের একটি ট্যাঙ্ক রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরেই সেই ট্যাঙ্কের জল চুঁইয়ে পড়ে। একটি ঘর কার্যত ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পাশেই নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট। সদ্যোজাত অসুস্থ শিশুদের রাখা হয় সেখানে। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, নতুন জলের ট্যাঙ্ক বসানোর কথা অনেক দিন আগেই পূর্ত দফতরকে বলা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। কর্তৃপক্ষের এই নালিশ শুনে পূর্ত দফতরের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র শ্যামল প্রতিহারের সঙ্গে কথা বলেন ত্রিদিববাবু। শ্যামলবাবু জানান, কাজটি জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের করার কথা। ডাক পড়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের (মেকানিক্যাল) এক্সকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র স্বপন খানের। দেখা যায়, দুই দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। খোদ পূর্ত দফতরের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেও সে ভাবে সমন্বয় নেই। পরিস্থিতি দেখে ত্রিদিববাবু বলে বসেন, “কেন হয়নি সে কথায় যাচ্ছি না। আমাকে বলুন, নিজের বাড়িতে যদি এ ভাবে দেওয়াল বেয়ে জল পড়ত, মেরামত করতে কত দিন সময় নিতেন? দেড়-দু’বছর লাগত?” তাঁর আরও মন্তব্য, “ছোট কাজ এ ভাবে ফেলে রাখবেন না। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়ান। কোনও সমস্যা থাকলে বলুন।”
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে এর আগে শেষ কবে এমন ‘কড়া’ কথা কেউ বলেছেন, তা মনে করতে পারছেন না অনেকেই। মঙ্গলবার সকালে মেডিক্যালে এসে প্রথমে অধ্যক্ষ সুকুমার মাইতির ঘরে বৈঠক করেন টাস্ক ফোর্সের প্রতিনিধিরা। পূর্ত দফতরের বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই মেডিক্যালে যে সব কাজ চলছে, তার খুঁটিনাটি জেনে নেন প্রতিনিধিরা। দুপুরে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এরই ফাঁকে হাসপাতাল পরিদর্শন। শুরুতেই শিশু-ওয়ার্ডে আসেন ত্রিদিববাবুরা। সদ্যোজাতদের জন্য এখানে একটি ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটে’র কাজ চলছে। কিন্তু, ঘর তৈরি হলেও বিদ্যুতের কাজ বাকি রয়েছে। ফলে ইউনিটটি এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। ইউনিটটি চালু হলে সেখানে ১২টি শিশুকে রাখা যাবে। স্বাস্থ্য-কর্তাদের প্রশ্নের উত্তরে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র বলেন, “এক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।” তবে কাজকর্মের ‘হালচাল’ দেখে ত্রিদিববাবু বলেন, “এ ভাবে চলতে পারে না। একটা রিভিউ কমিটি করে দেব। ওই কমিটি নিয়মিত যেন আলোচনায় বসে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে।” পূর্ত দফতরের আধিকারিকদের অবশ্য বক্তব্য, শুধু তাঁদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই ‘তৎপর’ হতে হবে।
মেডিক্যালের শিশু-ওয়ার্ডে ৪৫টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু, শিশু ভর্তি থাকে অন্তত ৮৫। ফলে, একই শয্যায় দু’টি করে শিশুকে রাখতে হয়। হাসপাতাল সুপার রামনারায়ণ মাইতি বলেন, “শয্যা-সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।” হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা বলেন, “রাজ্যে শিশু-মৃত্যুর হার কমেছে। আগে প্রতি ১০ হাজারে ৩৩ জনের মৃত্যু হত। এখন সংখ্যাটা কমে ৩১ হয়েছে। কিন্তু শিশু মৃত্যুর হার আরও কমাতে হবে।” তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজার চেষ্টা করছেন। প্রতিটি জেলায় ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ গড়ে তোলা হবে। ইতিমধ্যেই ১৫ টির কাজ সম্পূণর্র্ হয়েছে।” তবে, মেদিনীপুরে কাজের গতিতে অসন্তুষ্ট তিনিও। তাঁর মন্তব্য, “এ ভাবে কাজ করা যাবে না। অযথা কাজ ফেলে রাখা হচ্ছে। আমরা সমন্বয় বাড়ানোর কথা বলেছি। আর কোনও অজুহাত চলবে না।” এক মাসের মধ্যেই মেডিক্যালে ডায়ালিসিস পরিষেবা চালু হবে বলেও আশ্বাস দেন সুশান্তবাবু।
সাত মাস হল রাজ্যে পালাবদল হয়েছে। কিন্তু এখনও যে পরিস্থিতি তেমন পাল্টায়নি, সোমবারের পরিদর্শন শেষেই তা স্পষ্ট। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার অবশ্য বক্তব্য, “রোগ গভীরে। তাই সারতে আরও কিছুটা সময় লাগবে!” |