যা বাধ্যতামূলক, সেটা মানার জন্যই ফের নতুন করে নির্দেশ জারি করতে হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা-বিল নিয়ে গরমিলের অভিযোগ আকছার ওঠে। এ বার চিকিৎসার প্রাথমিক শর্ত না-মানার অভিযোগও উঠল বেসরকারি হাসপাতালগুলির একাংশের বিরুদ্ধে। আমরি-কাণ্ডের পরে শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে পরিদর্শন চালিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা দেখলেন, বহু জায়গাতেই রোগীর ‘বেড-হেড টিকিট’ রাখা হচ্ছে না। ফলে তাঁর কী চিকিৎসা হচ্ছে, কোন ওষুধ বা ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে, কোন কোন চিকিৎসক তাঁকে দেখছেন সে সবের কোনও তথ্যই জানতে পারছেন না রোগী বা তাঁর পরিজনেরা। পরবর্তী ক্ষেত্রে অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য গেলে পুরনো চিকিৎসার কোনও তথ্যও দাখিল করা যাচ্ছে না। রোগীদের এই প্রাথমিক অধিকারটি যাতে অবশ্যই রক্ষা করা হয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন হাসপাতালকে ইতিমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “এটা নতুন কোনও নিয়ম নয়, যে নিয়ম হাসপাতালগুলির বরাবর মেনে চলার কথা, সেটার জন্যই আমাদের ফের নির্দেশ দিতে হচ্ছে। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। বছরের পর বছর বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপরে সরকারের যে কোনও রকম নিয়ন্ত্রণই ছিল না, এই প্রবণতা সেটাই আবার স্পষ্ট করে দিচ্ছে।”
হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেড-হেড টিকিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই টিকিট থেকেই চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানা যায়। কোন চিকিৎসক কখন রোগীকে দেখলেন, কী কী ওষুধ বা ইঞ্জেকশন দিলেন, কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল তার সবই জানা যায় ওই টিকিট থেকে। এমনকী, পরবর্তী সময়ে রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ উঠলে ওই বেড-হেড টিকিট থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন তদন্তকারীরা। স্বাস্থ্য দফতরের প্রশাসনিক বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর হিমাদ্রি সান্যাল বলেন, “বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এসে আমরা বিস্মিত। বেড-হেড টিকিট না-রেখে দিনের পর দিন এঁরা কাজ চালাচ্ছেন কী ভাবে, সেটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। আমরা জানতে চাইলে অনেকেই বলেছেন, ওঁদের কম্পিউটারে সব রেকর্ড থাকছে। আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, কম্পিউটারে রেকর্ড থাকলেও শয্যার সঙ্গে এই কাগজটি রাখতেই হবে।”
রোগীর শয্যার সঙ্গে বেড-হেড টিকিট লাগিয়ে না-রাখলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, ওই টিকিট না-থাকার ফলে হাসপাতালের বিলে যে যে ওষুধ বা ইঞ্জেকশনের দাম নেওয়া হচ্ছে, যে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ আদায় করা হচ্ছে হাজার হাজার টাকা, আদৌ সেগুলি দেওয়া বা করা হয়েছে কি না, তা জানার কোনও উপায়ই থাকছে না। এমনকী, চিকিৎসা যথাযথ হয়েছে কি না, সেটাও জানতে পারছেন না রোগী বা তাঁর পরিবার।
বেড-হেড টিকিট নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই নানা অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ছিল স্বাস্থ্য দফতরে। অনেকেই অভিযোগ করছিলেন: তাঁদের রোগী ভর্তি রয়েছেন, চিকিৎসা-বাবদ লাখ লাখ টাকা বিলও হচ্ছে। কিন্তু কী চিকিৎসা হচ্ছে, সেটা তাঁরা জানতে পারছেন না। চিকিৎসক বা নার্সকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা সব সময়েই এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাই বিলে যা লেখা রয়েছে, সেটার উপরেই বাধ্য হয়ে ভরসা করতে হচ্ছে তাঁদের। আমরি-কাণ্ডের পরে বিভিন্ন হাসপাতালের পরিকাঠামো পরিদর্শনে গিয়ে বহু জায়গাতেই এই অনিয়ম চোখে পড়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। হিমাদ্রিবাবু বলেন, “সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতাল আমাদের বলেছিল, তাদের কম্পিউটারে সব তথ্য মজুত রয়েছে। আমরা পাল্টা বলেছি, কম্পিউটারে যা-ই থাক, শয্যার পাশে টিকিট রাখতেই হবে। আর বিদেশের ধাঁচে কম্পিউটারে তথ্য রাখতে হলে সব রোগীর তথ্য সংবলিত ওয়েবসাইট চালু করুন, যাতে রোগীর পরিবার সেই তথ্য সরাসরি জানতে পারেন।”
বেসরকারি হাসপাতালগুলি অবশ্য দাবি করেছে, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতেই তারা সব তথ্য কম্পিউটারে রাখার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে রোগী বা তাঁর পরিবার প্রতি দিন কী ভাবে চিকিৎসার অগ্রগতির কথা জানবেন, বিলে উল্লিখিত ওষুধ বা ইঞ্জেকশনের প্রয়োগ সম্পর্কে কী ভাবেই বা তাঁরা নিশ্চিত হবেন, সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারেনি হাসপাতালগুলি। |