‘আশায় বাঁচে চাষা।’
অতিবর্ষণে সব্জি-চাষ জলে যাওয়ায় তড়িঘড়ি সেই জমিতে ধান বুনেছিলেন অনেক চাষি। ভেবেছিলেন, আনাজের লোকসান ধানে পুষিয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম!
পোড় খাওয়া চাষিরা কি তা হলে ফলনের আন্দাজ করতে পারেননি?
বিভিন্ন জেলার চাষিদের বক্তব্য, তাঁরা অত কিছু ভাবেননি। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ধান ফলিয়েছিলেন। তারকেশ্বরের গোপাল পাল যেমন নিজের সাড়ে চার বিঘের পুরোটাতেই ধান লাগিয়েছেন। এবং এখনও তাঁর ঘরে ধান মজুত। বর্ধমানের গলসির সিরাজুল চৌধুরী বা বোলপুরের মালেক মণ্ডলেরও একই হাল। এমন পরিস্থিতি অবশ্য এই প্রথম নয়। ১৯৯৫ সালেও পশ্চিমবঙ্গে ধানের অতিরিক্ত ফলন হয়েছিল। খাদ্য দফতর ছাড়াও নানা সংস্থা মারফত ধান কিনে কিছুটা সামাল দিয়েছিল রাজ্য। বছর পাঁচেক আগেও একই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, পঞ্চায়েত, ইসিএসসি, বেনফেড, কনফেডের মতো সংস্থাকে ধান কিনতে নামানো হয়। চালকল-মালিকদেরও চাপ দেওয়া হয় বেশি বেশি ধান কিনতে।
এ বারও সরকার ধান কিনছে। চাষিদের থেকে সরাসরি ধান খরিদের জন্য শিবির হচ্ছে। শিবিরে কৃষি সমবায় সমিতি, চালকল ও তিনটি সরকারি সংস্থার লোকজনও থাকছেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা যে মিটছে না, তা টের পাচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তৃণমূল বিধায়কেরা প্রায় প্রতি দিন তাঁর অফিসঘরে এসে বলছেন, ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় চাষিরা সঙ্কটে। কেউ কেউ বলছেন, “চাষিরা এত ক্ষুব্ধ যে, জেলায় যেতে পারছি না!”
এই পরিস্থিতিতে মিল-মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন খাদ্যমন্ত্রী। ধানচাষিদের অনেকের অভিযোগ, রাজ্যে গত ক’বছরে চালকলের সংখ্যা সে ভাবে বাড়েনি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ১০১৮টি চালকল, তার মধ্যে শ’তিনেক নানা কারণে বন্ধ। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা কৃষকসভার সভাপতি মদন ঘোষের অভিযোগ, “বর্ধমান-হুগলিতে চালকল থাকলেও দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর বা উত্তরবঙ্গে তার অভাব রয়েছে। চাষিরা ধান বেচবেন কোথায়?” শিবির করে ধান কেনার সরকারি প্রয়াস সফল হচ্ছে না বলেই মনে করছেন মদনবাবু। যে প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, “কৃষক-স্বার্থ নয়, ওঁরা দলের স্বার্থ দেখার খেলায় মেতেছেন। মিথ্যে তথ্য দিচ্ছেন।” তবে রাজ্যে যে অন্তত চার হাজার চালকল দরকার, মন্ত্রীও মঙ্গলবার তা মেনে নিয়েছেন।
তবে ঘটনা হল, সরকারি ব্যবস্থায় অনেক চালকল-মালিকও খুশি নন। তাঁদের ক্ষোভের কারণ, সরকারি শিবির মারফত যেখানে যত ধান কেনা হচ্ছে, তা সরাসরি চালকলে চলে যাচ্ছে। বর্ধমান জেলা চালকল-মালিক সমিতির সম্পাদক দেবনাথ মণ্ডলের আক্ষেপ, “প্রশাসন আমাদের সাধারণ মানের ধান কিনতে বাধ্য করছে। চালকলগুলো যাতে চলতে পারে, সে দিকে নজর নেই!” ‘সারা ভারত চালকল-মালিক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক, বোলপুরের সুশীল চৌধুরী বলছেন, “দুই মেদিনীপুর বাদে রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় স্বর্ণধানের চাষ হয়। ওই চাল লাল, মোটা। তেমন বাজার নেই। কিনে লাভ হচ্ছে না।”
গত তিন মাসে একাধিক ধানচাষির আত্মহত্যায় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে। চাষিদের ক্ষোভকে পুঁজি করে মাঠে নেমে পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও। বামপন্থী চারটি কৃষক সংগঠন আজ, বুধবার গ্রামবাংলা
বন্ধের ডাক দিয়েছে। এমনকী, চাষিদের ধানের দাম না-পাওয়ার প্রতিবাদে আজ ধর্মতলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করবে সরকারের জোটসঙ্গী কংগ্রেসও। মৃত চাষিদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবিও উঠছে। কৃষকসভার হুগলি জেলা সম্পাদক অনিল বসুর কথায়, “বিষ-মদে মৃত্যুতে সরকার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। এ দিকে রাজ্যবাসীর জন্য ফসল ফলিয়ে দাম না-পেয়ে চাষিরা আত্মঘাতী হচ্ছেন। কিন্তু
সরকার সেই সব পরিবারকে ক্ষতিপূরণ না-দিয়ে স্রেফ হাত গুটিয়ে বসে আছে।”
সোমবার মেমারির আত্মঘাতী ধানচাষি অমিয় সাহার বাড়ি গিয়েও ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে এসেছেন সিপিএম সাংসদ সাইদুল হক। যে প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবু এ দিন বলেন, “রাজ্য সরকার অমিয় সাহার মৃত্যুর তদন্ত করছে। রিপোর্ট পেলে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠাব। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবেন।” পাশাপাশি মন্ত্রী এ-ও বলেন, “অমিয়বাবুর পরিবারটিকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি।
বর্ধমানের বিত্তশালী পরিবার। এই মৃত্যুর পিছনে ধান নেই।
সিপিএম নোংরা রাজনীতির উদ্দেশ্যে পুরো বিষয়টি সাজানোর চেষ্টা করছে।” জ্যোতিপ্রিয়বাবুর মন্তব্য, “আমিও বর্ধমানের কৃষক পরিবারের ছেলে। যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু আরও দুঃখজনক সিপিএমের এই নোংরা রাজনীতি।”
কিন্তু দাম না-পেলে চাষিরা কি দুর্দশায় পড়বেন না?
রাজ্য সরকার মনে করছে, চাষিদের উদ্বেগ ভিত্তিহীন। কিছু ক্ষেত্রে চাষিরা যে অভাবী বিক্রি করছেন, তা মেনে নিয়েও খাদ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “প্রকৃত চাষিরা নন, ধানের দাম নিয়ে চিৎকার করছে ফড়েরা।” মন্ত্রী এ দিন জানান, এ পর্যন্ত ২ লক্ষ ৯ হাজার টন চাল কেনা হয়েছে। সরকার কুড়ি লক্ষ টন চাল কিনবে। প্রক্রিয়াটি চলবে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। “অতএব চাষিদের উদ্বেগের কারণ নেই।” আশ্বাস দিচ্ছেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু। কৃষি-কর্তাদের অনেকেও মনে করছেন, সঙ্কট সাময়িক।
প্রশাসনের ‘আশাবাদে’ও চাষিরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, গত মরসুমের ধান কেনা শেষ হতেই যদি সেপ্টেম্বর গড়িয়ে যায়, তা হলে চলতি মরসুমের ধানের কী হবে? ফের অতিফলন হলেই বা কী হবে? বস্তুত খাদ্যমন্ত্রীর কথাতেই স্পষ্ট, সরকার এখনও ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ১৮ লক্ষ টন পিছিয়ে। বিশেষত কোষাগারের সাম্প্রতিক দৈন্যদশার প্রেক্ষিতে সেপ্টেম্বরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে কৃষিজীবী মহলে।
মন্ত্রী অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সমস্যার কথা জানলেই সুরাহা করা হবে। তাঁর আশ্বাস: তৃণমূল, বাম, কংগ্রেস যে কোনও দলের বিধায়ক তাঁর কাছে বা খাদ্য দফতরে সরাসরি সমস্যার কথা জানাতে পারেন। তিনি ধান বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। উদাহরণ হিসেবে মন্ত্রী জানিয়েছেন, কিছু দিন আগে গলসিতে কৃষকেরা পথ অবরোধ করেছিলেন। খাদ্য দফতর ধান কিনবে বলে জেলা প্রশাসন আশ্বাস দেওয়ায় অবরোধ উঠে যায়।
কিন্তু এই ব্যবস্থা তো সাময়িক। সামগ্রিক ভাবে সঙ্কটমোচনের পথ বার হয়েছে কি? যার উত্তর খুঁজতে গিয়ে চাষিদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। |