দলের ভিতরে প্রোমোটারি-ঠিকাদারির সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ‘আপসহীন লড়াই’ চেয়ে ফের সরব হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, সিপিএমের যে অংশ নানা ‘অনৈতিক কাজে’র সঙ্গে জড়িত, তাদের একেবারে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে দিতে হবে। শহরাঞ্চলে সিপিএমের জনসমর্থন ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার পিছনে দলের একাংশের দুর্নীতিই যে দায়ী, তাই প্রকারান্তরে স্পষ্ট করে দিয়েছেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবু।
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এই জেহাদের কথা মঙ্গলবার বুদ্ধবাবুর মুখে শোনা গিয়েছে দলের কলকাতা জেলার ২২তম সম্মেলনে। নগরায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যে জেলায় বহু দিন ধরে প্রোমোটার, ঠিকাদারদের রমরমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। এ বারের জেলা সম্মেলনের ‘রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদনে’ই মেনে নেওয়া হয়েছে, ‘মানুষের চোখে আপত্তিকর পেশায় যুক্ত থাকার ঘটনা ঘটে চলেছে। বারংবার সতর্কীকরণের পরেও এই বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি’। খসড়া প্রতিবেদনে এই স্বীকারোক্তি এবং রাজ্য কমিটির তরফে সম্মেলনের রূপরেখায় সতর্ক-বার্তার পরেও খাস কলকাতাতেই বেশ কিছু লোকাল কমিটিতে ঠিকাদার, প্রোমোটারদের নির্বাচিত হয়ে আসার ঘটনা ঘটেছে। সেই প্রেক্ষিতেই বুদ্ধবাবুর এ দিনের বক্তব্য যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কলকাতা জেলা সম্মেলনের উদ্বোধন করে যিনি প্রতিনিধিদের সামনে বলেছেন, ‘অবাঞ্ছিত ঘটনা’ দলের মধ্যে এখনও ঘটছে। ‘আলতু-ফালতু’ লোক কমিটি দখল করতে চাইছে! দলের ঐক্যের নামে এই সব ‘অনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে আপস’ করা হবে কি না, তা ঠিক করতে হবে সাফ বলেছেন বুদ্ধবাবু।
ঘটনাচক্রে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরব। কারণ, সিপিএমের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝেছেন, এই পথেই দলে দুর্নীতি বাসা বাঁধে। তবে রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যায়, তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী হিসাবে মমতা তাঁর দলে যে ‘অনুশাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সিপিএমের মতো যৌথ দায়িত্বে বিশ্বাসী দলে বুদ্ধবাবুর পক্ষে তা আদৌ সম্ভব নয়। যার প্রতিফলন বাম জমানার গত দেড় দশকে ঘটেছে।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলের পলিটব্যুরো সদস্যের এ দিনের এই বক্তব্য শুনে জেলার প্রতিনিধিদের বড় অংশের মধ্যেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে, নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত যে সব নেতা-কর্মী বিভিন্ন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন, সে সবের কি ‘পুনর্বিচার’ হবে? কারণ, বুদ্ধবাবু-সহ দলীয় নেতৃত্ব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বারংবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। বুদ্ধবাবু অবশ্য এ দিনও সম্মেলন-মঞ্চে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন, ‘আবর্জনা’ দূর করতে হবে।
শিল্পায়নের স্লোগান সামনে রেখে তাঁর নেতৃত্বে যে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, জমি অধিগ্রহণের ভুলেই তারা ‘জনবিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়েছে মেনে নিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, শিল্পায়নের লক্ষ্য সঠিক ছিল। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের সমস্যা এবং তার জেরে বিরোধীদের প্রচার মোকাবিলা করা যায়নি। কিন্তু এই সূত্রেই বুদ্ধবাবুর উদ্বেগ, জমি হারানোর ‘আতঙ্ক’ মূলত গ্রামাঞ্চলে থাকলেও শহরে সিপিএমের জনসমর্থনের এমন হাল হল কী করে? গত কয়েক বছরে কলকাতায় বামেদের ভোট ১০% কমে যাওয়ার কারণ খুঁজে বার করার কথা বলেছেন তিনি। দলের অন্দরে তাঁর বার্তা, ‘উত্তরণ’ ঘটাতে হবে। কিন্তু দল কি ‘প্রস্তুত’?
সিপিএম সূত্রের খবর, সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রায় এক ডজন প্রতিনিধি বক্তৃতা করেছেন। চিনের সমাজতন্ত্রের মডেলই ‘আদর্শ’ কি না, তা-ই নিয়ে তাঁরা যেমন কাঁটাছেড়া করেছেন, তেমনই প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দল থেকে বহিষ্কার নিয়ে। তাঁদের মতে, দল সংসদীয় গণতন্ত্রে আছে। অথচ স্পিকার পদের উপরে ছড়ি ঘোরাতে চেয়েছে। এতে মানুষের কাছে ‘ঠিক বার্তা’ যায়নি।
তবে ‘জনবিচ্ছিন্নতা’ মেনে নিয়েই জনসংযোগ বাড়ানোর জন্য কর্মীদের কাছে দক্ষিণপন্থীদের উপমা টেনেছেন বুদ্ধবাবু। তাঁর পরামর্শ, ‘৩৬৫ দিন’ পার্টিটা করতে হবে। দক্ষিণপন্থীদের পুজো আছে, বামেদের আছে লেনিন! দক্ষিণপন্থী দলের নেতারা নানা পুজোর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসংযোগ সেরে নেন। বামপন্থীরা সেটা পারবেন না ঠিকই। কিন্তু তা-ই বলে লেনিনকে পার্টি অফিসে রেখে দিলে চলবে না! প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে হবে। মন দিয়ে তাঁদের সমালোচনা শুনতে হবে। তাঁদের জীবন-যন্ত্রণার পাশে থাকতে হবে। তবেই ‘উত্তরণ’ ঘটবে কমিউনিস্টদের।
সরকারে থাকার ৩৪ বছরে যা হয়নি, বিরোধী শিবিরে থেকে বছরের ‘৩৬৫ দিন’ই কাজ করে সেই ‘ব্যর্থতা’ পোষানো সম্ভব কি না এরই উত্তরের চর্চায় আছে সিপিএম! |