ফের কংগ্রেসকে ‘সিপিএমের বি-টিম’ বলার তত্ত্বে ফিরে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন বারবার তিনি ওই অভিযোগ তুলতেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও একবার তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘সিপিএমের সঙ্গে হাত মেলানোর’ অভিযোগ এনেছিলেন। কিন্তু তা ছিল একটি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি চ্যানেলকে বলা। মঙ্গলবার মহাকরণে সংবাদমাধ্যমের সামনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিভিন্ন প্রশ্নে সিপিএম-কংগ্রেস ‘আঁতাতের’ অভিযোগ তুলেছেন।
ঘটনাচক্রে, যে বিষয়গুলি নিয়ে মমতা ওই অভিযোগ এনেছেন, সেখানে সিপিএম-কংগ্রেসের ‘অবস্থান’ একই। প্রথমত, সল্টলেকের ইন্দিরা ভবন। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে ধান-পাটের সহায়ক মূল্য। তৃতীয়ত, জেলায় জেলায় তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’।
মহাকরণে এক দীর্ঘ সাংবাদিক বৈঠকে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন
• “সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেস ইন্দিরা ভবন নিয়ে পথে নেমে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চাইছে।”
• “সিপিএম এবং আরও একটি রাজনৈতিক দলের (কংগ্রেস) জানা উচিত, ধানের দাম রাজ্য সরকার ঠিক করে না। ঠিক করে কেন্দ্রীয় সরকার। সেটাই মানতে হয় আমাদের। আগের সরকারের আমলে প্রতিবাদ করলে এটা কার্যকর হত না।”
• “সন্ত্রাস নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস-সিপিএম হাত মিলিয়েছে।”
ঘটনাচক্রে, এই তিনটি বিষয়েই জোটসঙ্গী কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের ‘টানাপোড়েন’ চলছে। যা শুরু হয়েছিল জেলায় তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ দিয়ে। আর সাম্প্রতিকতম ঘটনা ইন্দিরা ভবনের নাম ‘নজরুল ভবন’ করে সেখানে নজরুল অ্যাকাডেমি এবং ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী কেন্দ্র গঠন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা।
১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠনের সময় থেকেই মমতা-কংগ্রেস সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয়। বাম-বিরোধী জনতার দাবিতেই দু’দল জোটবদ্ধ হয়ে প্রথমে লোকসভা এবং তার পর বিধানসভা ভোটে লড়ে। যার ফলে রাজ্য থেকে দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের বাম জমানার অবসান হয়। সেই জোট গঠনেও প্রতি বারই মমতার মতামত ‘প্রাধান্য’ পেয়ে এসেছে। মমতা ভোটের আগেই বলেছিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে লড়লেও একক গরিষ্ঠতা না-পেলে তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্বে যাবেন না। তার কারণও খুব স্পষ্ট মমতা গরিষ্ঠতা পেলে তাঁকে কংগ্রেসের ‘মুখাপেক্ষী’ হয়ে থাকতে হবে না। কেন না, মমতা এবং কংগ্রেস উভয়পক্ষই জানে, একপক্ষের ক্ষমতা হারানোর মূল্যেই অপরপক্ষ ক্ষমতাশালী হবে। কারণ, উভয়েরই ভোট-ব্যাঙ্ক এক।
কংগ্রেসের একাংশের বক্তব্য, সেই ‘অঙ্ক’ থেকেই তৃণমূলের তরফে তাদের ‘কোণঠাসা’ করার চেষ্টা শুরু হয়। সরকার গঠনের পরেও যে ‘দাদাগিরি’ জারি রয়েছে। অন্য দিকে তৃণমূলের বক্তব্য, কেন্দ্রে তাদের জোরালো সমর্থনের জোরেই কংগ্রেস সরকারে টিকে আছে। কিন্তু কেন্দ্রে শরিক হিসেবে কংগ্রেস তাদের কোনও ‘মর্যাদা’ দেয় না। বরং রাজ্যে শরিক হিসেবে কংগ্রেসকে অনেক বেশি ‘সম্মান’ দিচ্ছে তৃণমূল। তাদের সাত জন মন্ত্রীও দেওয়া হয়েছে। সরকার গঠনের পর থেকেই অবশ্য কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতা জেলায় জেলায় তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে সরব। যেমন সরব সিপিএম-ও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেগুলি ‘মনগড়া ও ভিত্তিহীন’ বলে নস্যাৎ করেছেন। তার মধ্যেই রায়গঞ্জে প্রস্তাবিত এইমসের ধাঁচের হাসপাতাল নদিয়ার কল্যাণীতে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে ‘তিক্ততা’ বাড়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের। সংসদে লোকপাল এবং লোকায়ুক্ত বিতর্ক নিয়েও দু’দলের মধ্যে খানিকটা ‘প্রকাশ্য দূরত্ব’ তৈরি হয়। সেই আবহেই এসে পড়ে ইন্দিরা ভবন বিতর্ক এবং ধান-পাটের সহায়ক মূল্য নিয়ে ‘কৃষক-সঙ্কট’। যার প্রেক্ষিতে মমতার এ দিনের অভিযোগ।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, নানা প্রশ্নে কংগ্রেস-সিপিএম হাত মিলিয়েছে। ওঁর হাত কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছে কিনা, জানি না। দিল্লিতে উনি কংগ্রেসের হাত ধরেছেন। কংগ্রেস এখানে ওঁর হাত ধরেছে। ওঁদের পারিবারিক কলহ। আগে নিষ্পত্তি করুন, ওঁদের হাত ঠিক জায়গায় আছে কি না।” সূর্যবাবুর আরও বক্তব্য, “আমরা বলছি, সন্ত্রাসের শিকার শুধু বামেরা নয়, কংগ্রেসও। এমনকী, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তৃণমূলের কর্মীরাও মার খাচ্ছেন। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঠেকাতে ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি করতে হচ্ছে! সর্বশেষ উদাহরণ কেশপুর। কংগ্রেস বলছে বলেই সিপিএম বলবে না, বিষয়টা তো এমন নয়। ঘটনা ঘটলে যে কেউই বলবে।” কটাক্ষের সুরেই তাঁর বক্তব্য, “তা-ও তো কংগ্রেস বা কোনও বামদল এখনও পর্যন্ত সিবিআই তদন্ত দাবি করেনি! কিন্তু দু’টি ক্ষেত্রে তৃণমূলের লোকেরা তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হয়েই সিবিআই তদন্ত দাবি করেছে। কারণ, রাজারহাট এবং হাওড়ার দু’টি ঘটনায় দুই মন্ত্রীর নাম জড়িত। মুখ্যমন্ত্রী এগুলো ভুলে যাচ্ছেন না, গুলিয়ে দিতে চাইছেন, জানি না।”
আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং বস্তাপচা এই অভিযোগ বহুদিন ধরেই শুনতে হচ্ছে। এই অভিযোগ নিয়েই জোট হয়েছিল। জোট চলছেও। বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের হাত ধরাধরির কোনও প্রশ্নই নেই। আগের মতো এখনও বামেদের সঙ্গে সংঘাত করেই কংগ্রেসকে আন্দোলন করতে হচ্ছে।”
বাম কৃষক সংগঠনগুলি আজ, বুধবার কৃষকদের সঙ্কট নিয়ে গ্রামবাংলায় বন্ধ দিয়েছে। একই বিষয়ে কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে কৃষকদের নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি করছে কংগ্রেস। যা, স্বভাবতই, সরকারের বিরুদ্ধে। ফলে মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একধাপ এগিয়ে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, “প্রদীপবাবুরা ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ, নোংরা খেলায় নেমেছেন। এগুলো আমরা সিপিএমের থেকে প্রত্যাশা করতে পারি। শরিকদের থেকে করি না।”
আজ, বুধবার সকাল থেকেই মেট্রো চ্যানেলে দিনভর অবস্থান শুরু কংগ্রেসের। তার আগে একপ্রস্ত বিতর্ক হয় মঞ্চ বাঁধা নিয়ে। সকাল থেকে কংগ্রেস মঞ্চ তৈরি করতে শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। তাদের বক্তব্য, বিকেল বা সন্ধের পর মঞ্চ বাঁধা শুরুর কথা। নচেৎ ওখানে যান চলাচল ব্যাহত হয়। প্রদীপবাবু দ্রুত প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, “সরকার আমাদের কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে!” পরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করায় দুপুর থেকে মঞ্চ বাঁধার কাজ শুরু হয়।
মহাকরণে অবশ্য তার আগেই মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস-সিপিএম আঁতাঁতের অভিযোগ করে ফেলেছেন। বলেছেন, “ইন্দিরা ভবন সরকারি অতিথিশালা। এত দিন জ্যোতি বসু সেখানে থাকতেন। তখন কংগ্রেস কিছু বলেনি কেন? এখন সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে!” এ দিন সকাল থেকে থিয়েটার রোডের কাছে ইন্দিরা গাঁধীর মূর্তির পাদদেশে প্রতিবাদ সভা করে যুব কংগ্রেস। মমতার নাম না-করলেও সেখানে প্রদীপবাবু বলেন, “এখন যাঁরা তৃণমূলের নেতা-নেত্রী, তাঁরা তো আগে কংগ্রেসেই ছিলেন। সরকারে আসার পর ইন্দিরা’জির প্রতি তৃণমূল সম্মান জানাবে, আশা করেছিলাম।”
সূর্যবাবুর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী ধান ভানতে শিবের গীত গাইছেন। জ্যোতি বসু থাকলেও ইন্দিরা ভবনের নাম বদলানো হয়নি। এমন সংবেদনশীল বিষয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাঞ্ছনীয় নয়। বাম সরকারই নজরুল অ্যাকাডেমি ও নজরুল মঞ্চ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আরও কিছু করতে চাইলে স্বাগত। কিন্তু ইন্দিরা ভবনের নাম বদলে যেটা করতে চাইছেন, সেটা নজরুল ও ইন্দিরা কারও পক্ষেই সম্মানজনক হচ্ছে না।”
সরকার তো ইন্দিরা ভবনের নাম রেখেই নজরুল অ্যাকাডেমি করতে চাইছে?
সূর্যবাবুর জবাব, “সরকার কাঁঠালের আমসত্ত্ব গোছের কিছু একটা করতে চাইছে। ইন্দিরা গাঁধী শুধু কংগ্রেসের নেত্রী ছিলেন না। দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁর স্মৃতির সঙ্গে জড়িত কোনও সংগ্রহশালা ওই বাড়িতে করা যেতে পারে। তবে সেটা সরকারই ঠিক করুক।”
দেখার, সূর্য-প্রদীপের এই ‘যৌথ প্রস্তাবে’র পর মমতার অভিযোগের মাত্রা কোথায় যায়। |